বাইডেন যেভাবে নয়া আরব বসন্তে সমর্থন দিতে পারেন
আজ থেকে ১০ বছর আগে দুর্নীতি আর অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে নিজ গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন তিউনিসীয় ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ বোওআজিজি। তার মৃত্যু জন্ম দেয় রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে জনতার শক্তি প্রদর্শনের বিক্ষোভ, যা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পরে পুরো আরব বিশ্বে।
আকস্মিক লাখো মানুষের রাজপথের আন্দোলনে বিস্মিত হয় আরব দুনিয়ার একনায়কেরা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় তিউনিসিয়া, মিশর এবং ইয়েমেনের স্বৈরশাসকবৃন্দ। অন্যকিছু দেশ যেমন সিরিয়া, লিবিয়া এবং বাহারাইনে দেখা দেয় সশস্ত্র সংঘাত। তিউনিসিয়া বাদে আরব বসন্ত অন্য সকল দেশেই ব্যর্থ হয়েছে। নেপথ্যে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সমূলে উৎপাটন করেছে এসব দেশের সরকার। দমন-পীড়নে ব্যবহার করেছে আরও নিষ্ঠুরতম পন্থা।
এসময়ে হস্তক্ষেপ করা উচিৎ কিনা- তা নিয়ে যেন নিশ্চিত ছিল না পশ্চিমা বিশ্ব। কীভাবে স্থিতিশীলতা আনা যায়, সেটাও ছিল তাদের ধারণার বাইরে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম উদারপন্থী ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বয়ং আরব বিক্ষোভকারীদের পক্ষে জোর সমর্থন দেননি। মুখে কিছু বিবৃতি আর নিন্দাতেই ছিল তার প্রশাসনের বিচরণ।
বিক্ষোভকারীদের দমনের কালে দর্শকের ভূমিকা শুধু নয়, এসব শাসকদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক ছিল এবং আছে পশ্চিমা দেশসমূহের। আবার অনেক সময় সক্রিয় ভূমিকাও ছিল। যেমন লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর যুক্তরাজ্য মিলে মুয়াম্মার গাদ্দাফি'কে উৎখাত করে। কিন্তু, সরকার পতনের পর লিবিয়ায় দেখা দেয় গৃহযুদ্ধ। এই ডামাডোল থেকে গা বাঁচাতে সরে আসে পশ্চিমা জোট। আর বিবাদমান পক্ষগুলোর নিরন্তর লড়াইয়ে ধ্বংসস্তূপে রূপ নেয় আফ্রিকার সবচেয়ে সম্পন্ন দেশ লিবিয়া। এভাবে আরব বসন্তের স্বপ্নকে চুরমার করা হয়।
কিন্তু, মধ্যপ্রাচ্যের গতিপ্রকৃতি বলছে আরেক কথা; অনেকটা নীরবে দেখা দিচ্ছে আরব বসন্তের দ্বিতীয় জোয়ার। এবার আলজেরিয়া আর সুদানে জনতা জেগেছে দুর্নীতিবাজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। আর সমস্যাসঙ্কুল পথচলা নিয়েই টিকে আছে তিউনিসিয়ার নবজাত গণতন্ত্র। অন্যদিকে, ইসরায়েলের সঙ্গে কিছু আরব দেশের সম্পর্কের উষ্ণতায় ব্যবসা-বাণিজ্য, ভ্রমণ আর কারিগরি সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন হতে পারে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে হাতেগোনা যেকয়টি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন, তার একটি হলো উপসাগরীয় কিছু আরব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের স্বাক্ষরিত চুক্তি। বাইডেনের উচিৎ হবে এই সফলতাকে ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়া। বিক্ষুদ্ধ ওই অঞ্চলে সংস্কার এবং সমৃদ্ধি আনার ব্যাপারে পশ্চিমা দুনিয়ার যে স্বার্থ রয়েছে, তা নিশ্চিত করাই হবে বাইডেন প্রশাসনের প্রধানতম পররাষ্ট্র দায়িত্ব।
সবচেয়ে স্পষ্ট সুযোগ এখন সুদান। এই দেশটি সম্প্রতি ইসরায়েলের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারেও যোগ করেছে উল্লেখযোগ্য গতি, তবে সফলতার জন্য তাদের আর্থিক সহায়তা নিতান্ত প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে বাইডেন মার্কিন সহায়তা দিয়ে এক বিশাল পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন। সঙ্গে খার্তুমের বিশাল পূর্ববর্তী দেনাও মওকুফ করতে পারে ওয়াশিংটন। আর এসব ব্যাপারে বাইডেনের উচিৎ হবে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করা।
আলজেরিয়ায় পরিবর্তনের ব্যাপারে বাইডেন ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে কাজ করতে পারেন। ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের আলজেরিয়ার শাসকশ্রেণির অভিজাত বর্গের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাই তাদের সাহায্য নিলে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রভাব খাটানো একদিকে যেমন সহজ হবে; ঠিক তেমনি, রাজনীতিবিদ, সামরিক নেতৃত্ব আর ব্যবসায়ীদের সম্মীলনে গড়ে ওঠা ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার অশুভ চক্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে অপেক্ষা করছে মিশর। জেনারেল থেকে ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ও প্রেসিডেন্ট বনে যাওয়া আবদেল- ফাত্তাহ এল-সিসি তার পূর্বসূরি হোসনি মোবারকের চাইতে ইতিমধ্যেই নিজেকে অনেকগুণ বেশি নিষ্ঠুর প্রমাণিত করেছেন। গণবিচ্ছিন্ন সিসি সরকার মার্কিন সমর্থনের উপর নির্ভর করে টিকে আছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র চাইলে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংস্কারের তাগাদা দিতে পারে। বাইডেনকে সতর্কভাবে এ কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে।
সিরিয়া, লিবিয়া এবং ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ সাম্প্রতিক কয়েক বছরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তবে সেখানেও আছে কিছু আশার আলো। সাহায্যের হাত বাড়ানোর সুযোগ। সত্যি এটাই যে, ইয়েমেনে সংঘর্ষে লিপ্ত সকল পক্ষ এখন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। তার সঙ্গে করোনার মহামারী যোগ করেছে আরও বেশি মূল্যদান। এখনই সময় নিরন্তর সর্বনাশা এই খুনোখুনির গতিরোধের। সংঘাত নিরসনে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্বের স্থানে তুলে ধরতে পারেন। নিয়োগ দিতে পারেন কোনো বিশেষ প্রতিনিধি। যেমন ওবামা নিয়োগ দেন প্রয়াত রিচার্ড হলব্রুককে। এমন নিয়োগে অত্র-অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সদিচ্ছার বার্তা পাবে সবাই।
নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বিশ্বাঙ্গনে আবারও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব কায়েম করতে চান। ওভাল অফিসের দায়িত্বগ্রহণের পরপরই তিনি গণতান্ত্রিক দেশসমূহকে নিয়ে একটি সম্মেলন করার কথাও বলেছেন। সেই তুলনায় আরব বসন্তের সমর্থনে কাজ করা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জপূর্ণ; কিন্তু এটাই বাইডেনের জন্য শ্রেষ্ঠ উপায়- তার আন্তরিক ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ
- অনুবাদ: নূর মাজিদ