বাবা-মায়ের ভাঙন শিশুকে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ করে তোলে
ছোট্ট মেয়ে নীলিমার জীবনটা মুহূর্তের মধ্যে শূন্য হয়ে গেল। একদিন সকালে উঠে সে দেখলো বাবা তাকে আর তার মাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় বাবা বলে গেল যে, নীলিমার সব খরচ তিনি বহন করবেন। নীলিমা কষ্টে নীল হয়ে গেল। তার ছোট মনটা ভয়ে, আশঙ্কায়, নিরাপত্তাহীনতায় কুঁকড়ে উঠলো। ঐ ছোট বয়সেই সে বুঝলো যে সে বাবাহারা হয়ে গেছে। বাবা তাকে আর আগের মতো ভালবাসবে না, কাছে ডাকবে না, সময় দিবে না। বাবা অন্য একজন মানুষের কাছে চলে গেল, যে তার মা নয়।
দশ বছরের মেয়েটি মাকে আকঁড়ে ধরে বাবার চলে যাওয়ার কষ্ট ভোলার চেষ্টা করতো। খুব ঝড়বৃষ্টি হলে মায়ের বুকে ঢুকে ভয় তাড়াতো। আগে সে ভয় পেলে বাবা মায়ের মাঝখানে এসে ঘুমাতো। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর মা-ই ছিল তার একমাত্র ভরসা। সবকিছুর পর অপেক্ষা করতো মা কখন হাতে কিছু একটা নিয়ে কাজ শেষে ঘরে ফিরবে। এইভাবেই নীলিমা হয়তো বড় হয়ে উঠতো, যদি না এর মাত্র দুইবছর পরে ওর মা বিয়ে করে আরেকটা সংসারে চলে না যেতো। নীলিমাকে অবশ্য ওর মা ফেলে যায়নি, সাথেই নিয়ে গেছে নতুন সংসারে। সেই সংসারে আরও একটি বাচ্চা রয়েছে ওর মতোই।
নীলিমার বয়স যতো বাড়তে লাগলো ওর ততোই মনে হতে থাকলো ও একা, বিচ্ছিন্ন, নিরাপত্তা এবং ভালবাসাহীন। ওর নিজের কোনও বাসা নেই, বাবা মা কেউ ওর একার নয়। তাদের ভালবাসা, সময় কাটানো সব টুকরো টুকরো হয়ে ভাগ হয়ে গেছে। নীলিমার পড়তে ভালো লাগতো না, খেলতে ইচ্ছা করতো না, এমনকি বন্ধুদের কাছেও যেতে ইচ্ছা করতো না। বন্ধুদের বাবা মাকে দেখলে ওর কান্না আসতো। নিজেকে আরো বঞ্চিত মনে হতো। একা একা ঘরের কোণে কান্না ছাড়া ওর যেন আর কিছু করার ছিল না।
এবং তারপর, সেই দুর্বলতার সুযোগে বন্ধু নামের শত্রুরা এসে ভীড় করে। ১৪-১৫ বছর বয়সে নীলিমা মাদক নিতে শুরু করে। বাবা মা অস্থির হয়ে ওকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। কিন্তু একদিন সব ছেড়ে নীলিমা আকাশের নীলে মিলিয়ে যায়, ও আত্মহত্যা করে। ঘটনাটি বিশ-বাইশ বছর আগের হলেও ভোলা যায় না।
যখন কোন ভেঙে যাওয়া পরিবারের শিশু দেখি আমার চোখের সামনে নীলিমার মুখখানি ভেসে ওঠে।
তবে, জাইনের জীবনটা কিছু অন্যরকম। জাইনের বাবা চলে গেলেও মা ছিল মাথার উপর। ওর মা বুক দিয়ে আগলে রেখেছিল জাইনকে। কিন্তু এরপরও পরিবারের ভাঙন জাইনের জীবনকে অস্থির করে তুলেছিল। ও অসম্ভব আবেগী হয়ে উঠেছিল। বাবাকে ঘৃণা করতো, ভয় পেতো। আর এই অতিরিক্ত আবেগ থেকে জাইনের জীবন লক্ষ্যহীন হয়ে উঠছিল। অসৎ সঙ্গ ওকে প্রায় ধরে ফেলেছিল। কিন্তু জাইনের মা এক ধরনের যুদ্ধ করেই ওকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে স্বাভাবিক জীবনে। জাইনের পাশে মা ছিল বলে জাইন ফিরে আসতে পেরেছে। কিন্তু নীলিমার পাশে কেউ ছিল না বলে নীলিমা হারিয়ে গিয়েছিল।
আমরা কি জানি কত শিশু শুধু এই পারিবারিক অশান্তির কারণে পথ হারিয়ে ফেলে? মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, অবসাদ বা বিষণ্ণতায় ভোগে? মাদকে আসক্ত হয়, বোহেমিয়ান হয়ে ওঠে? যারা শিশুদের মনোজগৎ নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন, এইসব শিশুর বেড়ে ওঠাটা কতটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। চারপাশে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায় বাবা মায়ের ভাঙন শিশুকে কীভাবে ভেঙে টুকরা টুকরা করে দেয়।
বিবিসি জানিয়েছে, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিকাল সায়েন্সের গবেষকরা বলেছেন বাবা-মায়ের তালাকের ২৪ মাসের মধ্যে শিশুদের সবচেয়ে বেশি ওজন বাড়ে, যা একই সময়ে এক সাথে থাকা বাবা-মায়ের শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি। আর তালাকের ৩৬ মাসের মধ্যে এসব শিশুর স্থূলকায় হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বিচ্ছেদের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু, নবজাতক থেকে টিনএজার, সবার বেড়ে ওঠার উপর নানাবিষয় প্রভাব রাখে। তাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে না, পারিবারিক বন্ধন আলগা হয়ে যায়, পড়াশোনা নষ্ট হয়, আবেগ ও মানসিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন এরকম হলে শিশুরা কান্নাকাটি করে, হতাশাগ্রস্ত হয়ে দিন কাটায়। আবার অনেকেই বাবা মায়ের এই বিচ্ছেদ নিয়ে কোন কথা বলতে বা শুনতেই চায়না। এর মানে এই নয় যে তারা বিষয়টি আমলে নেয় না, বরং তারা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে নিজেদের দু:খ ভোলার জন্য। আর যখন শিশু চুপ হয়ে যায়, তখন বাবা মা, শিক্ষক এবং থেরাপিস্ট কেউ কোনও সাহায্য করতে পারেন না। বাবা মায়ের বিচ্ছেদ এমন একটি বিষয় যা শিশুর পড়াশোনা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
এই বাচ্চাগুলো অন্যকে অপমান করে, সম্পর্ক গড়তে ভয় পায়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, বাবা মায়ের প্রতি অবিশ্বাস তৈরি হয়, চরমপন্থী হয়, কারো কথা বা পরামর্শ শুনতে চায় না। একটি আমেরিকান ম্যাগাজিনে পড়লাম, শিশু মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ছেলেমেয়েগুলো মানসিকভাবে এতোটাই ভাঙচুরের ভেতর দিয়ে যেতে থাকে যে তারা নিজেদেরকে একটা খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে এবং কারো সামনে আবেগ প্রকাশ করতে চায় না।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ এখন খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে বিয়ের পর যখন স্বামী স্ত্রীর বনিবনা হয় না, তখন পরিবারের মুরব্বিরা পরামর্শ দিতে থাকেন যে, যেন তারা বাচ্চা নেয়। কারণ বাচ্চা হলে সম্পর্কটা টিকে যাবে। কিন্তু এর চাইতে ভুল পরামর্শ আর হয় না। বরং এই ঝামেলা বছর গড়ানোর মাধ্যমে বাড়তে থাকে, আর সেই অবুঝ শিশুটা ভাঙা সংসারের মধ্যে পড়ে নিজেও ভেঙে যেতে থাকে।
বিয়ের পর থেকেই দাম্পত্য জীবনটা গোলেমেলে হয়ে যায় অনেকের। তখন বহুদিন অপেক্ষা করা বা জোড়াতালি দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা উচিত না। একটা শিশু ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কিন্তু বাচ্চা চলে আসার পর এই কাজ করা মানে শিশুর জীবন অনিশ্চিত করে তোলা।
এধরনের বাচ্চারা খুব স্পর্শকাতর হয় বলে মায়া, সহানুভূতি এবং খুব যত্ন দিয়ে এদের পাশে দাঁড়াতে হয়। বাচ্চা যে বাসাতে বড় হয়, খেলাধুলা করে, পড়াশোনা করে, পরিবারের সাথে সময় কাটায় - সেই স্মৃতি তার জন্য ভোলা খুব কঠিন হয়। সেই পরিবেশ থেকে যখন একটি শিশু ছিটকে পড়ে, তখন সে চরম ধাক্কা খায়।
একটা লেখায় লেখক জিন লিডলফের গবেষণমূলক বই "দ্য কন্টিনিউয়াম কনসেপ্ট"এর কথা লিখেছিলেন। পড়ে অনেককিছু জানা গেল। দ্য কন্টিনিউয়াম কনসেপ্টে লিডলফ লিখেছেন, শিশুর জন্মের পর কয়েক বছর তার প্রয়োজন মা-বাবা বা কেয়ারগিভারের শরীরের সাথে সেঁটে থাকা। এর ফলে অন্য ব্যক্তিদের সাথে তার যে শারীরিক বন্ধন তৈরি হয় সেটা তার মধ্যে এমন ব্যক্তিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। তাকে করে তোলে মানবিক, প্রেমাকাঙ্খী, সমাজ ও পরিবারের প্রতি ত্যাগী। আত্মকেন্দ্রিকতা তৈরি হয়না।
একটি শিশু মায়ের শরীরের ভেতরের উষ্ণতা ও নিরাপত্তায় বেড়ে ওঠে প্রায় একটি বছর ধরে। জন্ম হলেই সে শীতল একাকিত্বে নির্বাসিত হয়। আর একটি উষ্ণ দেহের স্পর্শ তাকে সেই নিরাপত্তা দিয়ে যেতে পারে, যেটা থেকে তার আবেগীয় সংশয় দূর হতে পারে। ভবিষ্যতের একটা নিরাপদ আবেগীয় সম্পর্কের প্রতিও সে উৎসাহী হতে পারে। দ্য কন্টিনিউয়াম কনসেপ্টে এই কন্টিনিউইটি বা ধারাবাহিকতার কথাই বলা হয়েছে, যেটা একবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সামনের প্রজন্মের জন্য শেষ হয়ে যায়।
এই ভয়াবহ ক্ষতি থেকে খানিকটা বাঁচার কী উপায় হতে পারে? তারেক আর বেলি ভালবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ের ১৬ বছর পর তারা যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আর একসাথে থাকবে না, তখন তাদের মেয়ে চৈতির বয়স ১৪ বছর। ওরা দুজনে বয়ঃসন্ধিকালের সন্তানের সাথে অনেকবার বসেছিল মনোচিকিৎসকের পরামর্শে। ওকে কথাটা বুঝিয়ে বলেছিল, কেন তারা আর একসাথে থাকতে পারছে না। বাচ্চাটাকে ফাঁকি দিয়ে বা পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ না ছড়িয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার। সত্যি ডাক্তারের এই পরামর্শ কাজে লেগেছিল। চৈতি এই ঘটনায় কষ্ট পেয়েছিল ঠিকই কিন্ত বাবা মায়ের সাথে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। আর নিজের জীবনটাও সে ভেসে যেতে দেয়নি।
আমার বন্ধু বেলি বলেছে, জানো ডাক্তার বলেছেন, বাবা-মা যখন আলাদা হয়ে যায় তখন একটি শিশুর মনে সবচেয়ে বেশি দানা বাঁধে ভালবাসা হারানোর ভয়। তাই, উনি বলেছেন আপনারা যদি মেয়ের ভাল চান, ওকে দুজনেই ভালবাসা দিবেন। আপনাদের এই ভাঙনের দুঃখ বাচ্চা ভুলতে পারবে, শুধু যদি আপনারা তাকে বোঝাতে পারেন যে আপনারা ওকে ঠিক আগের মতোই ভালবাসেন এবং আপনাদের জীবনে চৈতিই প্রথম।
আমাদের বুঝতে হবে আপনজনের মানসিক নৈকট্য বা শারীরিক স্পর্শ শিশুর জন্য খুব দরকার। এর ওপর নির্ভর করবে শিশুদের বড় হওয়া এবং অন্য ব্যক্তি ও সমাজের প্রতি শিশুর মধ্যে কতটুকু আকর্ষণ গড়ে উঠবে সেটা।
আমাদের মনোসামাজিক জগতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন। এই অস্থিরতা, ভালবাসাহীনতা ও সংঘর্ষের কারণে পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। এই ভেঙে যাওয়া পরিবারের শিশুগুলো তাদের জীবনের কোন এক সংকটে নিজের আবেগজনিত কষ্ট থেকে বাঁচতে এই ঘৃণা ও দুরত্বকেই বেছে নেবে ।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন