ভাষার পৃথিবী, পৃথিবীর ভাষা
আজ মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের এই দিনেই ভাষা শহীদদের আত্মদানের বীরগাথাই কালক্রমে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম থেকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকে সম্ভব করে তুলেছে। তারপরও নানা প্রশ্ন আজো বাকি রয়ে গেছে: একাত্তরের যুদ্ধের ভষ্মস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠা আজকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাংলাদেশেও বাংলা ভাষা ও বাংলা বর্ণমালা দুয়োরানী হয়ে পড়ে আছে কি না? ইংরেজিই আমাদের শাসক শ্রেণির পরম আদরের সুয়োরানী কি না?
কিন্তু এসব প্রশ্নের আলাপ তুলতে গিয়ে সারা পৃথিবীতেই বাংলা ভাষা কিভাবে একেকটি নির্দিষ্ট দেশ, অঞ্চল বা সংস্কৃতির প্রকাশ মাধ্যম বা বাহন, সে বিষয়ে আলাপ তোলাটাও জরুরি।
শুরুতে এই রচনা সে বিষয়েই কিছু আলোকপাত করবে।
ভাষা কি সংস্কৃতির বাহন?
অধুনা পৃথিবীর ভাষাবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকরা ভাষাকে সেই সুনির্দিষ্ট প্রতীকের সারি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করছেন বা করতে চাইছেন যা এক মানুষকে অপর একজনের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সমর্থ করে। ভাষাই মানুষকে 'শৈশবে জল পড়ে/ পাতা নড়ে'র মতো সরল ভাবনা থেকে যৌবনে 'অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়, আরো কোন এক বিপন্ন বিষ্ময়, আমাদের রক্তের ভিতরে খেলা করে, আমাদের ক্লান্ত করে'র মতো জটিল মনোভাবনা প্রকাশে সমর্থ করে।
সত্যি বলতে, ভাষার মাধ্যমেই মানুষ তার প্রত্যক্ষকৃত বাস্তবতা প্রকাশ করে। ভাষার মাধ্যমেই এক জনপদের সংস্কৃতি অন্য জনপদের মানুষের কাছে বাহিত বা পরিবাহিত হয়। সভ্যতার শুরুতে যখন লিপি বা লেখ্য ভাষা শুরু হয়নি, তখন শ্রুতির মাধ্যমেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাদের ধারাবাহিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতেন। যেমন, পন্টিক স্তেপের তৃণভূমি থেকে যে আর্যরা দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছিলেন বলে মনে করা হয় (যদিও ভারতে আর্য আগমন তত্ত্ব নিয়ে এখন প্রচুর মতভেদ আছে), তাদের তখনো পর্যন্ত লিখিত বর্ণমালা ছিল না বলে শ্রুতি বা স্মৃতির মাধ্যমেই বংশ পরম্পরায় সঞ্চিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো।
১৯২০ সালে দুই ইউরোপীয় ভাষাবিদ এডওয়ার্ড সাপির এবং বেঞ্জামিন হোরফ প্রথম এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন যে কোনো জনগোষ্ঠির বাস্তবতাকেই আসলে তার ভাষা প্রকাশ করে। তারা আরো বলেন যে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠির বাস্তবতা তার সংস্কৃতি কতৃর্ক নির্ধারিত হয়। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৩ সংখ্যাটিকে দুর্ভাগ্যের সাথে এক করে দেখা হলেও জাপানে আবার ৪ সংখ্যাটিকে মনে করা হয় দুর্ভাগ্যের প্রতীক।
যেহেতু জাপানি ভাষায় ৪ সংখ্যাটির উচ্চারণ সেই ভাষায় উচ্চারিত মৃত্যু শব্দটির মতোই শুনতে। এডওয়ার্ড সাপির এবং বেঞ্জামিন লি হোরফ মনে করেন যে মানুষ সহজে কোনো তত্ত্ব বা বিষয় বুঝতে পারে না যতক্ষণ না তার মাতৃভাষায় এর কোনো সমার্থক শব্দ না থাকে।
যেমন, প্রাচীন মিশরে পিরামিডের গায়ে লিখিত অক্ষরগুলো সেই সময়ের মিশরীয় সমাজের মানুষের মনোভুবনকেই প্রকাশ করে। প্রাচীন মিশরীয় বর্ণমালা বা হায়োরোগ্লিফিক (গ্রিক হায়েরো শব্দের অর্থ পবিত্র এবং গ্লিফো অর্থ খোদাই) ব্যবহার করে মিশরীয়রা পেঁচা, কুমীর, ষাঁড়, কৃষক, ফারাও, পুরোহিত, পাখি, সিংহ তথা নীল নদের দুই তীরের জীবনকেই তুলে ধরেছেন।
একইভাবে চীন বা জাপানের তাও বা জেন গল্পে আমরা পাই দুই দেশের পাহাড়-ঝর্ণা-শোগুনেত বা যোদ্ধা শ্রেণি-ভিক্ষু-চা অনুষ্ঠান-চন্দ্রমল্লিকা ও চেরি ফুল-কিমোনো ও মার্শাল আর্টের অনুষঙ্গ। সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনই প্রতিফলিত হয়েছে তাদের ভাষায়। একইভাবে এস্কিমো ভাষায় শুধুমাত্র বরফের সাথেই সম্পৃক্ত মোট ২০টি শব্দ রয়েছে। যেহেতু বরফ এস্কিমো জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এস্কিমোরা বরফের সূক্ষাতিসূক্ষ নানা ভেদাভেদে আগ্রহী। টোবোগ্গান স্লেজে চেপে ঘুরতে যে বরফে সুবিধা, তার এক রকম নাম, কোন ধরনের বরফে পরতে হবে বিশেষ ধরনের বরফ-জুতো, কোন ধরনের তুষার জমে থাকে গাছের পাতায়, কোন ধরনের তুষার বাতাসে ব্যত্যাহত হয় আর কী ধরনের বরফ দিয়ে ইগলু বানানো যায়, সে অনুযায়ী এস্কিমো ভাষায় আছে বরফের বিভিন্ন নাম।
ডাচ পিতা ও এস্কিমো মায়ের সন্তান ও এস্কিমো লোককাহিনি সংগ্রাহক ক্লু রাসমুসেন জানান যে কীভাবে মেরু ভালুক, কায়াক বা এস্কিমো নৌকোর সাথে সম্পৃক্ত বরফের বিভিন্নতা এস্কিমো ভাষায় উল্লিখিত। আবার আরবি ভাষায় এক উট ও উটের সাজপোশাকের বিবরণে ৬ হাজার শব্দ রয়েছে।
আফ্রিকার আশানি গোত্রে বাদামি, নীল ও বেগুনিসহ সব রঙকেই কালো বলে মনে করা হয় বলে জানান নৃ-তাত্ত্বিক মার্গারেট মীড (১৯৩৩-)। আবার তুর্কি ভাষায় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল লেখার পাশাপাশি স্বপ্ন ও স্মৃতি লিখতে একটি আলাদা টেন্স ব্যবহৃত হয়, যেমনটা নামি তুর্কি লেখক ওরহান পামুক ব্যবহার করেছেন তার 'মাই নেম ইজ রেড' উপন্যাসে।
আবার হিব্রু ভাষায় অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কাল বোঝাতে পৃথক টেন্স ব্যবহার করা হয় না [রাহনুমা আহমাদ, কাউন্টার ফটো ম্যাগাজিন, ২০০৪, ঢাকা, বাংলাদেশ]।
এমনি বিবিধ ভাষার বিভিন্নতা। বিখ্যাত ইদ্দিশ লেখক আইজ্যাক বাশেভিচ সিঙ্গার নাকি ইদ্দিশ ভাষায় তাঁর সব গল্প-উপন্যাস রচনা করে আবার ইংরেজিতে অনুবাদের দুরূহ পরিশ্রম করতেন শুধুমাত্র তার মাতৃভাষাকে জীবিত রাখার উদ্দেশ্যে। আবার পারস্যের মহাকবি ফেরদৌসী পারসিক সাম্রাজ্যের সূচনাকাল থেকে সপ্তম শতকে আরব কতৃর্ক পারস্য বিজিত হওয়া পর্যন্ত সময়ের পার্সি শাহানশাহ বা রাজাদের রাজকাহিনি লিখে গেছেন তার 'শাহনামা' মহাকাব্যে যেন প্রাচীন ইরানের নর-নারীর নাম, ইতিহাস, উদ্ভিদ ও রন্ধনপ্রণালীসহ সেই সংস্কৃতির সব উপাদান চিরতরে আরবি লিপি ও সংস্কৃতির চাপে হারিয়ে না যায়!
বাংলা ভাষা: কতটা লিঙ্গ ও বর্ণ সংবেদী?
ইংরেজির মতো হি বা শি কিংবা ফরাসির মতো ইল বা এল নয়, বাংলার আছে লিঙ্গ সংবেদী 'সে' সর্বনাম। ফরাসিতে যেমন খোদ ক্লিবলিঙ্গকেও পুং ও স্ত্রীলিঙ্গে বিভক্ত করা হয় (যেমন, লো স্তিলো অর্থ কলম যা পুং লিঙ্গ আর লা ক্রেওল অর্থ পেন্সিল বা স্ত্রী লিঙ্গ), এমন বিভাজন বাংলা ভাষায় নেই। তবে ভদ্রলোক/ছোটলোক বা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে বহুবছর ধরে আদিবাসীদের বোঝাতে 'উপজাতি'র মতো অবমাননাকর শব্দ প্রচলিত ছিল বা আছে, এটাও সত্য।
ভাষাবিদ ডেবোরা তান্নেন (১৯৯৩) যথার্থ বলেন যে গোষ্ঠিগত ঘৃণা অনেক সময়ই ভাষার আকারে প্রবাহিত হয়। ল্যাটিন বা সংস্কৃত যেমন প্রাচীন রোম বা ভারতে ছিল রাজসভা ও পুরোহিত শ্রেণির ভাষা, তবে কালপ্রবাহে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ভাষাগুলোই আজ মৃত বা অবলুপ্ত ভাষায় পরিণত। প্রাচীন যুগের সংস্কৃত নাটকে অভিজাত শ্রেণি ও পুরুষের সংলাপ নাকি হতো সংস্কৃত ভাষায় এবং ভৃত্য শ্রেণি তো বটেই, অভিজাত নারীদের সংলাপও নাকি ছিল প্রাকৃত ভাষায়। বাংলা ভাষায় অবশ্য গলেতে গুঞ্জর মালা পরে শবরী টিলায় তার জীবনের গল্প বলে, ডোম্বিনী সহস্র পদ্মের পাতায় চড়ে নাচে অথবা ঘরে নিত্য প্রেমিকের আনা-গোনায় ব্যস্ত অন্ত্যজ গণিকার হাঁড়িতে ভাত থাকে না। ইংরেজি বা ফরাসির তুলনায় জেন্ডার সংবেদী হলেও আমাদের ভাষাতেও নারী শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে অবলা, রমণী, কামিনী, জেনেনা, অবগুণ্ঠিতা জাতীয় নানা শব্দ আজো রয়েছে যা নারীর প্রতি বৈষম্যসূচক।
ভাষা দুনিয়ায় বাংলা লিপি বা বর্ণমালার অবস্থান
আনন্দের বিষয় হলো আজকের পৃথিবীতে মোট প্রধান ছয়টি লিখিত ভাষালিপির ভেতরে বাংলা কিন্তু পঞ্চম স্থান অধিকারী। যদিও টুকরো টুকরো হয়ে থাকা বাংলার প্রধান অংশ বাংলাদেশ নিজেই ক্রমবর্ধমান উন্নতির পথে থাকলেও আজো পৃথিবীর মহাশক্তিধর দেশগুলো থেকে বহু পিছিয়ে বলে, জনসংখ্যার সমানুপাতে আমাদের ভাষার উপযুক্ত মর্যাদা আমরা আজো বিশ্ব দরবারে আদায় করতে পারিনি।
পুরাণে বাবেল টাওয়ারের আখ্যানে পৃথিবীর সব মানুষ একটা সময় একটি মিনারে বাস করত এবং একই ভাষা ব্যবহার করত বলে জানা যায়। কিন্তু পরে ঈশ্বর তাদের ভাষা পৃথক করে দিলে, একেকটি গোষ্ঠি অন্য গোষ্ঠির ভাষা বুঝতে না পেরে আলাদা হয় এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে ইংরেজি ভাষা কিন্তু আফ্রিকা এবং বিশেষত ভারত উপমহাদেশে ১৯০ বছর টানা উপনিবেশ চালানোর সুবাদে যে বিপুল ইংরেজি শিক্ষিত জনগোষ্ঠির জন্ম দিতে পেরেছে, তারই সুবাদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ইংরেজি হয়ে উঠেছে বিশ্বায়ণের প্রধান হাতিয়ার এবং আশু ভবিষ্যতের বলতে গেলে একমাত্র ভাষা।
পৃথিবীর মানুষ আবার কখনো বাবেল মিনারের আদি অবস্থান অথবা একমাত্র ভাষার পৃথিবীতে ফিরে যাবে কি না, সেই শঙ্কাও নিও লিবারেল অর্থনীতি ও বিশ্বায়ণের বদৌলতে দেখা দিচ্ছে। মাত্র ২৬টি অক্ষরে আজকের ইংরেজি ভাষার রয়েছে ছয় লক্ষ অক্ষরের এক বিপুল সমাহৃতি।
মাতৃভাষার প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধাশীল?
সম্প্রতি পূর্ব ইউরোপের একটি দেশের (যে দেশ কি না একটা সময় ইউরেশিয়ার এক বিশাল অংশে মহা প্রতাপশালী রাষ্ট্র হিসেবে বিদ্যমান ছিল) বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পড়াশোনা ইংরেজিতেই করা যাবে দেখে কৌতূহলী হয়ে অন্তর্জালের সেই লিঙ্কে আবেদন করি ও প্রত্যাশাতীতভাবেই সাড়া পাই। প্রথম দফা জুম ইন্টারভিউয়ের পরেই তারা বলে শুধুমাত্র ইংরেজিতে সব শিক্ষাগত বা কর্ম-সংক্রান্ত সনদের প্রতিলিপি পাঠালে হবে না। তাদের মাতৃভাষায় প্রতিটি সনদ অনুবাদ করে পাঠাতে হবে এবং দেশটির ঢাকাস্থ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ও দূতাবাস এই অনুবাদ ও প্রত্যয়ণের কাজ করবে যাতে প্রতি সনদ পিছু বাংলাদেশি মুদ্রায় সব মিলিয়ে হাজার পাঁচেক টাকা খরচ হবে। এই আদেশে হতচকিত বোধ করলেও একটি বিষয়ে তাদের শ্রদ্ধা না করে পারা যাচ্ছে না। ইংরেজিকে এই দেশ আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে স্বীকার করলেও মাতৃভাষাকে তারা কোনোমতে ছোট করছে না। আমরা কবে এমনটা করতে পারব?
- লেখক: কথাসাহিত্যিক