মৃত্যুর হাত ছুঁয়ে আসা
আমি কি মৃত্যুর হাত ছুঁয়ে এসেছি ? আসলেই জানিনা ঠিক কোথা থেকে আমি ফিরে এসেছি? ২০১৪ এর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আমার জ্ঞান পুরোপুরি ফিরে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের যে ভালবাসা আমি পেয়েছি, তাদের চোখে যে বিস্ময় আমি দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, অজানা এক জগতে চলে গিয়েছিলাম আমি। জীবিত মানুষ হুটহাট করে মারা যাচ্ছে, এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মৃত মানুষ যখন ফিরে আসে, তখন তাকেই বলে মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনা।
২০১৪ এর জুলাইয়ের ১৫ তারিখে অফিস থেকে বান্দরবানে গিয়েছিলাম সাংবাদিকদের একটি টিম নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল আদিবাসী দিবস উপলক্ষে সাংবাদিকরা নিজেদের মতো করে স্টোরি করবেন। খুব আনন্দ করতে করতেই আমরা বান্দরবান পৌঁছলাম। কাজ শেষ করে আমরা যাবো রাঙামাটি। হঠাৎ করে সেখানে খুব অসুস্থবোধ করায় আমি একাই ফ্লাইটে ঢাকা চলে আসি ১৭ তারিখে। ঢাকায় ফিরে সরাসরি একজন নামকরা নিউরো সার্জনের কাছে গেলাম এবং আমার সমস্যার কথা বললাম। বিশেষ করে দু'বার প্রচন্ড বমি করার পর টানা মাথাব্যাথা।
ডাক্তারের কাছে গেলেও আমার রোগনির্ণয় ঠিকমতো না হওয়ায় সেই রাতেই আমি ভয়াবহ অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার ডানদিক পুরো অবশ হয়ে যায়। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিউরোলজি হাসপাতালে। সেখানে তাৎক্ষণিক পরীক্ষার পর দেখা যায় আমার ২/৩ টি স্ট্রোক হয়ে গেছে।
এরপরে আমার শারিরীক অবস্থার ঠিক কতটা অবনতি ঘটেছিল, কতবার আমার খিচুঁনি হয়েছিল, মস্তিকের কত ভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, চিকিৎকরা কী বলেছিলেন, পরদিন নিউরোলজী হাসপাতাল থেকে কীভাবে আমাকে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়েছিল -- আমি এর কিছুই জানিনা। সুস্থ হয়ে ফিরে আসার পর সব জানতে পারি।
এরপরের চিত্র ছিল আরো ভয়াবহ। স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে যমে মানুষে টানাটানি চলছে। আমার বন্ধুরা ও পরিবার রিপোর্ট নিয়ে বড় বড় ডাক্তারের কাছে ছুটছে। এখানকার চিকিৎকরা সবাই যখন আমার বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন সিভিয়ার স্ট্রোকে আক্রান্ত এই রোগী বেঁচে থাকলেও জড় পদার্থের মতো বেঁচে থাকবে। সেইসময়ে তারা কোন আশাও দেননি আমার স্বজনদের। বিশ্বের আর কোথাও 'এক্সটেনসিভ সেলিব্রাল ভেনাস সাইনাস থ্রোমবোসিস' নামের ভয়াবহ এই রোগের চিকিৎসা আছে কিনা, তাও নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা এরকম একজন কোমা'য় থাকা রোগীকে অন্য দেশে চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরের ব্যাপারেও তাদের আপত্তি ছিল।
ঠিক এরকম এক হতাশাজনক অবস্থায় প্রায় জোর করেই আমার বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নেয় আমাকে দিল্লী অথবা সিঙ্গাপুরে নেবে। অনেক টাকার দরকার ছিল। আমার পরিবারের এত টাকা নেই। আর এরকম মৃতপ্রায় একজন মানুষের জন্য কত টাকাইবা খরচ করতে পারে মানুষ। তবে এগিয়ে এসেছিলেন অনেকে। শেষপর্যন্ত সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও ভালবাসায় আমাকে এয়ার এম্বুলেন্সে করে নেয়া হল দিল্লির সাকেত সিটি হসপিটালে। সেখানকার 'ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি এন্ড স্ট্রোক প্রোগ্রাম' এর পরিচালক ডা, সাকির হুসাইন সব কাগজপত্র ই-মেইলে দেখে আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং আমাকে দিল্লী নিয়ে যেতে বলেছিলেন। সবাই বুঝতে পারছিল আমার বাঁচার সম্ভাবনা একদম নেই বললেই চলে এবং সেভাবেই আমাকে বিদায় দিয়েছিল আমার বন্ধু, সহকর্মী ও স্বজনরা। শুধু মনের কোণায় মিটমিট করে জ্বলছিল একটি আশা -- মৃত এই মানুষটি যেন আবার ফিরে আসে তাদের মাঝে।
রোজার মাস ছিল বলে রাস্তায় তীব্র যানজট ছিল। ভারতের ভিসা একদিনের মধ্যে যোগাড় করতে হয়েছে অনেক উঁচু পর্যায় থেকে অনুরোধ করে। দিল্লীতে প্রস্তুত হয়েছিল সাকেত হাসপাতাল ও সেখানকার বাঙালি সাংবাদিকরা। লক্ষ্য একটাই এই রোগীকে বাঁচাতে হবে। আমার বন্ধুরা ছিল সদা জাগ্রত। আমাকে বহণকারী এম্বুলেন্সটি বিকেল বেলার সেই ভীড় কাটিয়ে দ্রুততম সময়ে যেন বিমানবন্দরে পৌঁছুতে পারে, এজন্য আমার পুলিশ বন্ধুরা সাহায্য করেছে। এ যেন ছিল একজন খুব সাধারণ মানুষের অসাধারণ ভাগ্য।
অনেক বাধা বিঘ্ন পার করে ২৩ জুলাই আমাকে ভর্তি করা হয় সাকেত সিটি হাসপাতালে। সেখানে তখন ডা: সাকিরের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন আমাদের নিউরোলজি হাসপাতালের দু'জন ডাক্তার - ডা: শরীফ উদ্দীন খান এবং ডা: মহিবুর। সেই রাতে হাসপাতালে অন্যান্যদের সাথে আমাকে রিসিভ করেছিলেন এই দুজনও। ২৪ জুলাই করা হয় এনজিওগ্রাম। পায়ের ভেতর দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে অপসারণ করা হয় মস্তিকের ডান দিক থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত বহুদিন ধরে জমে থাকা জমাট রক্ত। এতো বড়ধরণের এনজিওগ্রাম করার যন্ত্র ও জটিল এই কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাদের দেশে সম্ভবত তখন কোন হাসপাতালের ছিলনা। পরে জেনেছি ছোট আকারে এই অপারেশন বাংলাদেশেও হয়। ডা: সাকিরের কয়েকজন ছাত্র এই কাজ এখন অনায়াসেই করছেন।
পরদিন আমার জ্ঞান ফিরে আসার পর ডাক্তার নিশ্চিত হয়েছিলেন তার এনজিওগ্রাম সফল হয়েছে। কিন্তু এরপরও তিনি নিশ্চিত হতে পারছিলেননা তার রোগী ঠিক কী অবস্থায় বেঁচে থাকবে? অর্থাৎ রোগীর শরীরের অন্যান্য অর্গানগুলো ঠিকমত কাজ করবে কিনা? কারণ ইতোমধ্যে আমার ব্রেনের অনেকটাই ক্ষতি হয়েছে বলে চিকিৎসকরা আশংকা প্রকাশ করেছেন।
এসব তথ্য আমি জ্ঞান ফিরে আসার পর ধীরে ধীরে জানতে পারি। অসুস্থ হওয়ার প্রায় ৭ দিন পর আমি চোখ খুলে তাকাই এবং চিনতে পারি আমার সাথে থাকা মানুষগুলোকে। ডা: সাকির আমার শাহানা নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পরও আমি উত্তর দেইনি দেখে উনি আমার পরিবারের লোকদের বলেন, আমাকে ডাক নাম ধরে ডাকতে এবং কোন প্রশ্ন করতে। সেইসময় আমার একমাত্র মেয়ে স্কালারশিপ নিয়ে আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার কথা। ওকে আমিই নিয়ে যেতাম বলে টিকেট, ভিসা সব রেডি ছিল। তখন আমার মেমোরি পরীক্ষা করার জন্য জিজ্ঞেস করা হলো, আমার মেয়েকে কি একা আমেরিকায় পড়তে পাঠানো হবে? আমি যদি হ্যাঁ বলি তাহলে ও একাই চলে যাবে। আর না বললে এবার যাবেনা। আমার মনে আছে আমি হাত তুলে হ্যাঁ বলেছিলাম। গলায়, মুখে অনেকগুলো নল লাগানো ছিল বলে কথা বলতে পারিনি বেশ কিছুদিন।
এরপর একটু একটু করে আমি সেরে উঠতে থাকি আল্লাহর অশেষ রহমতে, চিকিৎকদের প্রচেষ্টায় এবং সেখানকার সিস্টার, ব্রাদারদের যত্ন ও ভালবাসায়। এখানে একটি কথা স্বীকার করতেই হবে ডা, সাকির এবং তার টিমের কাছ থেকে যে চিকিৎসা, ভালবাসা আর যত্ন আমি পেয়েছি, সেটা তাদের দায়িত্বের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। আমার মত সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী একজন রোগীর পক্ষেই কেবল তা অনুভব করা সম্ভব। ওরা সবাই ছিল আমার বন্ধু ও আপনজন। আমার ছোট ভাই ও ওর বউ পুরোটা সময় আমার সাথে ছিল।
আমার অবস্থা যে কতটা খারাপ ছিল পরে ডা: সাকির নিজেই বলেছেন, "আল্লাহই তোমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন শাহানা। আমি শুধু উপলক্ষ মাত্র। সবসময় পজিটিভ চিন্তা করবে। যে রোগী যত পজিটিভ চিন্তা করে, সে ততো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে।"
ক্রমেই আমি দেখলাম ঐ হাসপাতালের অন্যান্য ডাক্তার, নার্স, আইসিউতে থাকা অন্য রোগীদের এটেনডেন্সরাও আমাকে দেখতে আসছেন। তখন তাদের সবার চোখে যে বিস্ময় আমি লক্ষ্য করেছিলাম, তা আমি আমি কখনো ভুলবোনা।
ডা. সাকিরের সহযোগী নিউরোলজী বিভাগের ডা. গৌতম পরে বলেছেন, "আমরা প্রথমদিন তোমাকে দেখে ভেবেছিলাম স্যার (ডা: সাকির) কেন এত দূর থেকে তোমাকে নিয়ে এসেছেন? স্যার কি তোমাকে বাঁচাতে পারবেন ? আমি কখনও এরকম একজন রোগীকে বেঁচে যেতে দেখিনি।"
'রাখে আল্লাহ মারে কে' কথাটি আমার বেলায় প্রযোজ্য হয়েছে। আমি ২২ দিন আইসিইউ'তে কাটিয়ে ফিরে আসতে পেরেছি আমার প্রিয় স্বদেশে, প্রিয় মানুষদের কাছে ২০১৪ এর ১২ আগষ্ট। আমিই সেই ভাগ্যবান মানুষ যে একবার চলে গিয়ে আবার ফিরে এসে বুঝতে পারছি মানুষের ভালবাসার মত অসম্ভব মূল্যবান একটি জিনিষ পাওয়ার আনন্দ কতটা। তাদের এই ভালবাসার দাবিতেই আল্লাহ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ডা: সাকির নিজের উদ্যোগেই বছরে একবার/দু'বার বাংলাদেশে আসতেন এবং সরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা দিতেন। এখন সুইজারল্যান্ডে পড়াচ্ছেন বলে আর আসতে পারছেন না।
আমি শুধু চাই কঠিন কঠিন রোগের চিকিৎসা যেন এদেশেই সম্ভব হয়। কোন মানুষকে যেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে না হয়। আর সবার পক্ষে যাওয়া সম্ভবও না। আমরা এদেশের মানুষ, এদেশেই চিকিৎসা ও সেবা পেয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আমার বেঁচে থাকাটা প্রমাণ করে এখনো মিরাকল ঘটে। আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে শুধু নতুন জীবনই দান করেননি, আমাকে কাজ করার পুরো শক্তিও দিয়েছেন। লেখাটা শেষ করতে চাই রজনীকান্তের সেই গান দিয়ে "আমি অকৃতি অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি। যা দিয়েছ তারি অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি।"
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন