যদি কোনো একদিন আমার গ্রাম, আমার শহর হয়ে যায়
গ্রামের বাড়ির প্রতি আমাদের অনেকেরই তীব্র একটা টান আছে। একে বলে শিঁকড়ের টান। এই টান আমরা নতুন করে উপলব্ধি করেছি করোনাকালে। ঈদের ছুটিতে এবং লকডাউন চলাকালে করোনার ভয়, যাতায়াতের কষ্ট, সরকারি বিধিনিষেধ সব উপেক্ষা করে মানুষ ছুটেছে গ্রামের পানে। আবার শহরে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
ঢাকায় যারা দিনমজুর, পোষাক শ্রমিক, কল-কারখানায় কাজ করেন, দোকানে কর্মরত শ্রমিক, গৃহকর্মী তাদের ঢাকায় থাকার মতো কোন আশ্রয় নেই। বছরের অনেকটা সময় এই মানুষগুলো শুধু জীবিকার জন্য ভালবাসাহীন এই শহরে অবাঞ্চিত অবস্থায় পড়ে থাকেন।
এরা কষ্ট করে আয় করেন, গ্রামে গিয়ে পরিবারের সাথে সময় কাটাবেন বলে। এদের জীবনের বড় আনন্দ পরিবার বা বাবা মায়ের সাথে উৎসব আয়োজনে মেতে ওঠা। আমরা যারা ঢাকাতে থাকি, চাকরি বা ব্যবসা করে কোনভাবে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলতে পেরেছি, তারা ঠিক এইভাবে জীবন বাজি রেখে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা না করলেও, বড় একটা অংশ গ্রামেই ফিরে যেতে চান।
শিশুকাল থেকে প্রতিবছর আমরা গ্রামের বাড়ি যেতাম। সত্তুর ও আশির দশকে নীলফামারী জেলার ঐ প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছুতে আমাদের প্রায় ১৬/১৭ ঘন্টা সময় লেগে যেতো। যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ৮/১০ টা ফেরি পার হতে হতো। কিন্তু এরপরও আমাদের, বিশেষ করে আব্বা-আম্মার উৎসাহের কোন অভাব ছিলনা। বিশাল আয়োজন করে, লটবহর নিয়ে বাড়ি যেতাম আমরা। বড় ট্য্রাংক, বেডিং, টিফিন ক্যারিয়ার এবং বদনা নিয়ে যাত্রা করতাম। এখনকার দিনে কেউ ভাবতেও পারবেনা বেডিং এর সাথে বদনা বেঁধে নিয়ে মানুষ কেমন করে যাত্রা করে।
শহরে জীবিকার প্রয়োজনে পড়ে থাকলেও গ্রামের বাড়িই অনেকের কাছে তীর্থভূমি। বাবাকে দেখেছি তার সর্বস্ব দিয়ে নিজ গ্রামের জন্য, সেখানকার মানুষের জন্য, কিছু করার চেষ্টা করতো। নিজে উদ্যোগী হয়ে বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার পর আব্বাকে বলতে শুনেছি, "এতদিনে আমি বিদ্যুতের আলো ব্যবহার করে শান্তি পাচ্ছি। কারণ আমার গ্রামে আজ বিদ্যুতের আলো জ্বলছে।"
সেই আশির দশকের শেষের দিকে আমাদের গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ গেছে। বিদ্যুৎকে কেন্দ্র করে সবধরণের আধুনিক সুবিধাদি এসেছে। গ্রামে নতুন প্রাথমিক স্কুল হয়েছে, মসজিদে যোগ হয়েছে অনেককিছু , পাকা ভবন উঠেছে বেশ কয়েকটি, ফার্ম আছে, পাকা রাস্তা, চাতাল, আড়ত, চিকিৎসাসেবা এসেছে কাছাকাছি, গ্রামেই কিন্ডারগার্টেন স্কুল হয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষ পড়াশোনা ও জীবিকার প্রয়োজনে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেও, অনেকেই সুবিধা পেয়ে গ্রামে এসে বিনিয়োগ করেছেন।
এরকমই একটি গল্প আমরা পড়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যোসাল চেঞ্জ বিষয়টি বুঝাতে গিয়ে। কেরালার দুটি গ্রামীণ এলাকা কথেরো ও পাথেরোতে ষাটের দশকে উন্নয়নে অংশ হিসেবে রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হয়। সেই রাস্তা তৈরির পর সেখানে একে একে গড়ে ওঠে যাতায়াত ভাল হয়, বিদ্যুৎ আসে, বাণিজ্যকেন্দ্র, স্কুল, সিনেমা হল এবং আরও অনেককিছু। ক্রমেই গ্রামীণ নারী ও পুরুষদের আচার আচরণ ও স্টাইলে পরিবর্তন আসে এবং গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন কমে আসে।
গ্রামের প্রতি মানুষের টান দেখে প্রায়ই মনেহয় গ্রামে যদি আমরা শহরের সুবিধাদি দিয়ে উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে হয়তো এত মানুষ শহরে এসে ভীড় করতো না। দেখলাম সরকার "আমার গ্রাম আমার শহর প্রকল্প" হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় আসবে সড়ক যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগ, ইন্টারনেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুবিধা, স্যানিটেশন, ব্যাংকিং, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। প্রাথমিক খরচ ধরা হয়েছে ১.৫ ট্রিলিয়ন টাকা।
মনে করা হচ্ছে যদি গ্রামে নাগরিক সুবিধাগুলো পৌঁছে দেওয়া যায়, যদি গ্রামের তরুণদের এবং কৃষি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে চাকরির বা কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অগণিত মানুষ শহরে এসে ভীড় করবে না। কৃষি জমি রক্ষা করা সহজ হবে গ্রামীণ হাউজিং বা কম্পেক্ট হাউজিং নির্মাণের মাধ্যমে। প্রথমে ১৫ টি মডেল গ্রাম হবে, ৮ বিভাগে হবে ৮টি এবং বাকিগুলো হবে হাওর, বাওড়, বিল, চর, উপক'লীয় এলাকা, পাহাড় এবং ইকোনমিক জোনের পাশে। গ্রামীণ অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক দিকগুলোও গুরুত্ব পাবে।
ছায়া সুনিবিড় গ্রাম ছেড়ে যে মানুষগুলো একদিন শুধুমাত্র জীবন জীবিকার প্রয়োজনে এই কংক্রীটের শহরে এসেছিল, তারা প্রায় সবাই যুদ্ধ করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিল। তবে সেই মানুষগুলোই বিপদে পড়লে পরাজিত সৈনিকের মতো গ্রামে ফিরে যায়। মনে প্রশ্ন জাগে এরা অথবা এদের সন্তানরা কি গ্রামে ফিরে গিয়ে টিকে থাকতে পারেন? যে জীবন একদিন তারা পেছনে ফেলে চলে এসেছিলেন, সেই জীবন কি তাদের ফিরিয়ে নেবে? শহর থেকে কপর্দকহীন হয়ে গ্রামে গেলে কি আশ্রয় জুটবে?
অথচ আমরা যদি গ্রামেই মানুষকে কাজের সুযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারি, তাহলে শহরের উপর যেমন চাপ কমবে, তেমনি গ্রামও নবরূপে জেগে উঠবে। মানুষকে তার নিজের ভিটা ছেড়ে নগরে বস্তিতে আশ্রয় নিতে হবেনা। ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ কীট, নেইকো ভালবাসা, নেইকো স্নেহ --- অবশ্য এই ইটের শহরে কীট হয়ে পড়ে থাকারও একটা নেশা আছে। সেই নেশাটা হচ্ছে আয়ের নেশা, চকচকে জীবনের নেশা, উন্নত পড়াশোনা, স্বাস্থ্য সুবিধার নেশা। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত মানুষগুলো নগরের কীট হিসেবেই বেঁচে থাকার জীবনকে বেছে নিয়েছিল।
আমার বাবাকে দেখেছি অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ঢাকা শহরে আবাসন গড়েছিল সেই ষাটের দশকে। জীবনে বহুবার বহু দুর্যোগে ভেবেছে, এই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাবে। কিন্তু সন্তানকে মানুষ করার ব্রত তাকে যেতে দেয়নি। দায়িত্ব পালন করতে করতেই শেষসময় হাজির হয়ে গেল। এইভাবেই কোন না কোন নেশা মানুষকে টেনে রাখে নাগরিক জীবনে। মানুষ গ্রাম থেকে এই শহরে এসে ভীড় করে পড়াশোনা, জীবিকা উন্নত জীবন ও নাগরিক সুবিধাদি পাওয়ার জন্য।
বাংলাদেশ গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক দেশ বলে পরিচিত হলেও গত কয়েকবছরে খুব দ্রুত নগরায়ন ঘটেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৯১ সালে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা ছিলো ৬৮ লাখ। এরপর ২০১৮ সালে জনসংখ্যা বেড়ে ১ কোটি ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে (জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেকটাস)। দেশের জনসংখ্যা ২০৪১ সাল নাগাদ হবে ২২ কোটি।
এ থেকেই নগরবিদরা ধারণা করেছিলেন যে শহরের জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে ২০৪৭ সালের দিকে দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ ভাগ শহরেই বাস করবে। সেইসাথে তারা এও আশংকা করেছিলেন অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলাফল হতে পারে খুব ভয়াবহ এবং চ্যালেঞ্জিং। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য নগরায়ন দরকার। কিন্তু যখন এটা খুব দ্রুত ও পরিকল্পনা ছাড়াই ঘটে তখনই সেটা চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়।
গ্রামীণ জীবনকে পেছনে ফেলে মানুষ কি শুধু শহরের চাকচিক্যের আকর্ষণে শহরে ছুটে এসেছিল? জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রামীণ মানুষের ভূমিহীন অবস্থা, বেকারত্ব, একটার পর একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, যথাযথ শিক্ষা-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভাবে লোক দলে দলে ঢাকায় এবং অন্যান্য শহরে এসে ভীড় করেছে। রাজধানী ঢাকাতে নগরায়ন ও কাজকর্মের ব্যবস্থাপনাটা অপরিকল্পিত হওয়ায়, এখানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বস্তিতে বা পথেঘাটে এবং দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করছে।
অনেকদিন ধরে শহরে থাকলেও অর্থনীতিতে এবং সামাজিক ব্যবস্থায় এই শ্রমজীবী মানুষের প্রবেশাধিকার খুব সামান্য। আর সেইকারণেই আমাদের অর্থনীতিতে যে ধাক্কা লেগেছে, এর ভার বহন করতে হচ্ছে শহরে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এইসব পরিবারকে। চাকরি, ব্যবসা সব হারিয়ে শহরে আসা মানুষগুলো আবার ফিরতে শুরু করেছে গ্রামে। আর তাই গ্রাম থেকে ঢাকায় রিকশা চালাতে আসা রবিউল বলে, "ঢাকা আমার শহর নয়, আমার শহর ছিল না এবং হবেও না কোনোদিন।"
আমরা যদি ঢাকার সাথে পাশের জেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ও দ্রুত করতে পারি, তাহলে অনেক মানুষ সেইসব জেলা শহরে বা গ্রামে বা শহরতলীতে বাস করেও শহরে এসে কাজ করতে পারবেন। আবার নিজের জায়গায় ফিরেও যেতে পারবেন। এখানে কষ্ট করে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুজতে হবেনা। "আর তাই আমার গ্রাম, আমার শহর প্রকল্পে"র সাফল্য কামনা করি। আর চাই দুর্নীতিবিহীনভাবে তা বাস্তবায়িত হোক।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন