যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি আর ট্রাম্পের রাস্তায় থাকবে না
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর ট্রাম্প সম্পর্কিত নাটকের যবনিকা হলো আজ রোববার (১৪ ফেব্রুয়ারি)। গত শনিবার সিনেটের এক ভোটাভুটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় সিনেট ইমপিচমেন্টে ৫৭ ভোট পড়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দোষী সাব্যস্ত করে, আর ৪৩ জন মার্কিন সিনেটর যারা সকলেই রিপাবলিকান দলের তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন; তাকে নির্দোষ দাবি করে। এই ভোটাভুটির রায় দেশটির নতুন মাত্রার বিভাজন দেখতে পাওয়া গেল।
এতদিন ধারণা করা হচ্ছিল; ট্রাম্পের এই সিনেট অভিশংসনে রিপাবলিকান দলের কেউই ডেমোক্রেটদের উত্থাপিত ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দিবেন না। কিন্তু সাতজন রিপাবলিকান সিনেটর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দেওয়াতে দলটির সামগ্রিক অবস্থা অনুমান করা যায়। দলটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে পড়ায় এক নতুন সংকটের মুখে- তা স্পষ্ট হলো এই ভোটাভুটির ফলে।
সিনেটের এই ভোটাভুটিতে যেসব সিনেটর তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বক্তব্য দিয়েছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন রিপাবলিকান দলের মাইনোরিটি লিডার। তিনি ভোট প্রদানের পর নিজ অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন সাধারণ নাগরিক। তাই তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট করার দরকার নেই। কিন্তু, তার কর্মকাণ্ডে চাইলে তার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ সংগঠিত করার অভিযোগ আনা যেতে পারে। কিন্তু, সিনেট ইমপিচমেন্টে তাকে নির্দোষ বলে আখ্যায়িত করায় এই সিনেটরের বিরুদ্ধে বিতর্কের ঝড় সৃষ্টি হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ নেওয়া সিনেটরদের যুক্তি ছিল এই যে, তারা মনে করেন মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনী হিসেবে মানুষের যে কথা বলার অধিকার সেই অধিকারীই ডোনাল্ড ট্রাম্প কার্যকর করেছেন। অর্থাৎ, ডোনাল্ড ট্রাম্প ৬ জানুয়ারি কী বলেছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ডেমোক্রেটিক দল বলছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের প্রেক্ষিতেই সেদিন সেই ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে।
এধরনের অবস্থান অন্য কোন সিনেটরদের বক্তৃতায় দেখা পাওয়া যায়নি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়োজিত আইনজীবীরা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর কথা উল্লেখ করেছেন। মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করা এবং কথা বলার অধিকারকে নিশ্চিত করা হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা বলার অধিকারকে সঠিক বলছেন তারা, একে তারা ব্যাখ্যা করছেন এভাবে: কেউ দেশের নাগরিক যা কিছু বলুক না কেন; সেই কথার প্রেক্ষিতে যদি কোনো কার্যক্রম সংঘটিত হয়- তাহলে সে কার্যক্রমের দায়ভার যে ঘটনা ঘটিয়েছে তার উপরেই বর্তাবে। আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থায় একটি প্রচলিত বাক্য আছে হুকুমের আসামি, অর্থাৎ কোনো একটি অপরাধ সংগঠিত করার জন্য যিনি নির্দেশ দিয়েছেন সেকারণে সেই ব্যক্তিও অপরাধী।
কিন্তু। গত দুই-তিন দিনের মার্কিন সিনেট ইমপিচমেন্টে এই বক্তব্য উঠেছে যে ব্যক্তির দ্বারা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেই অপরাধের জন্য এককভাবে ব্যক্তিই দায়ী। অন্য কারো কথায়, কিংবা নির্দেশে অপরাধ সংঘটিত হলেও; তার দায়ভার কেবলমাত্র অপরাধীর উপরই বর্তায় । এই ধরনের মত মার্কিন বিভাগ বিচার ব্যবস্থায় কখনো আলোচিত হতে দেখা যায়নি।
ডেমোক্রেট দলের সদস্যরা ট্রাম্পের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন, তারা সবাই মনে করছেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শেষ কয়দিনের; বিশেষ করে ৬ জানুয়ারির কার্যক্রম গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন একজন সাধারণ নাগরিক কারণে তার বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখার জন্য মামলা করা যেতে পারে। সুতরাং তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে কৌশলীরা ইমপিচমেন্টের বিপক্ষে আইনি লড়াই করছেন, তারা মূলত মার্কিন সিনেটের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর উল্লেখ করেছেন; যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ধর্ম সংক্রান্ত কোন আইন করতে পারবে না বলে উল্লেখ আছে। এর সঙ্গে উল্লেখ আছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা। মজার বিষয় হলো; সংবিধানের এই ধারাকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌশলীরা প্রকারান্তে অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করে নিচ্ছেন। ট্রাম্পের বক্তৃতা এই ঘটনা সংঘটিত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে, তারা একে নিন্দার জায়গা থেকেই দেখছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পও ঘটনাটিকে নিন্দা করেছেন এবং তার কৌশলীদের দাবি ট্রাম্প সবসময় সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে ছিলেন। ক্যাপিটল ভবন আক্রমণের ঘটনাটি একটি সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড কাজেই ট্রাম্প এই ঘটনাকে সমর্থন করেননি। তাই এতে তার কোন দায়বদ্ধতা নাই। রাজনীতির ইতিহাসে এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। রাজনীতিবিদরা তাদের প্রয়োজনে যেকোন স্থানে তাদের কর্মীদেরকে এইভাবে লেলিয়ে দেন। উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এধরনের ঘটনা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বের বহু দেশেই দেখা যায়। যে সব দেশ সামাজিকভাবে পিছিয়ে আছে, সেসব দেশে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে সিনেটে যে বিচারকার্য চলেছে, নিশ্চিত ভাবেই বোঝা যাচ্ছিল- তা কখনোই ডেমোক্র্যাটদের পক্ষে যাবে না। অর্থাৎ, সিনেটে ইমপিচমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় ৬৭ ভোট অর্জনে সমর্থ হবে না। তারপরও, এই ঘটনা রাজনীতিতে কি শক্তি জোগাবে তা এখনি বোঝা যাচ্ছে না। তবে যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো; জো বাইডেন নির্বাচনে বিজয়ের পরে যে ঐক্যবদ্ধতার ডাক দিয়েছিলেন- তা বাস্তবিক অর্থে রাজনৈতিক বক্তৃতায় রূপান্তরিত হল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ের সব ধরনের বিতর্কিত কার্যক্রমকে স্থগিত ঘোষণা করেছেন জো বাইডেন, এজন্য কোনো আলোচনার পথ অনুসরণ করেননি তিনি। এক মাসের কম সময়ের মধ্যে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোট ২৮টি নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে আগামীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে যা কিছু ঘটবে- তা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পিত পথে হবে না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক