রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায় ন্যায়বিচার পরিপন্থী!
একের পর এক রায় ঘোষণার তারিখ পরিবর্তনের পর অবশেষে গত ১১ নভেম্বর ঘোষিত হলো ২০১৭ সালে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মামলার রায়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই নারী শিক্ষার্থী ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ রাতে বনানী হোটেলে এক মিথ্যা জন্মদিনের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ জানিয়ে ধর্ষণ করা হয় বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়। তরুণীদের অভিযোগ, হোটেলেই ঘটে ধর্ষণের ঘটনা। বাদি মামলায় অভিযোগ করেন, ওই হোটেলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাত ৯টা থেকে পরদিন সকাল ১০টা পর্যন্ত আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়।
গণমাধ্যমে এই ধর্ষণের অভিযোগের কথা প্রকাশ হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আসামীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন করে বিভিন্ন সংগঠন। ঢাকার বাইরেও বিক্ষোভ ও মানবন্ধন হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও মূলধারার মিডিয়াতে খবরের শিরোনাম ছিল বেশ কয়েকদিন।
এই ঘটনার প্রতিবাদ-বিক্ষোভগুলোতে এই মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিয়ে সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ করা হয়। সন্দেহের কারণ, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তারা অত্যন্ত সম্পদশালী ও ধনী মানুষ। মানুষের সাধারণ ধারণা, টাকা দিয়ে 'দিনকে রাত বানিয়ে' দেওয়া সম্ভব।
চার বছর ধরে চলা মামলার রায়ে অভিযক্ত পাঁচ আসামির সবাই খালাস পেয়েছেন। রায়ে বিচারক বলেন, রেইনট্রি হোটেল ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি বলে আসামিদের খালাস দেয়া হলো। মামলাটি যথাযথ হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন বিচারক। এ কারণে আদালতের ৯৪ কর্মদিবস নষ্ট হয়েছে উল্লেখ করে পুলিশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতেও বলেছেন। পুলিশকে ভৎসর্না করে এবং ভবিষ্যতের জন্য সতর্কবার্তা দিয়ে পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ঘটনার ৩৮ দিন পরে এসে কেউ বললো 'আমি রেপড হয়েছি' আর পুলিশ সেটা আমলে নিল, তা হতে পারে না। তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের সময় নষ্ট করেছেন। ৭২ ঘণ্টা পরে ধর্ষণের মামলা পুলিশকে না নেওয়ার পরামর্শ দেন বিচারক।
১১ নভেম্বর ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার বহুল আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণাকালে বেশ কিছু মন্তব্য, পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। বিচারক বলেছেন, নারী পুরুষের সম্মতিতে যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যাবে না। এই মামলার বাদি সম্পর্কে বলেছেন, এই নারী আগে থেকেই অভিযুক্তের সাথে 'শারীরিক সম্পর্কে' অভ্যস্ত। বিচারক পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন, ৭২ ঘণ্টা পার হয়ে গেলে 'ধর্ষণের' মামলা না নিতে। এই সময় পার হয়ে গেলে ধর্ষণের আলামত থাকে না ফলে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীর দায়িত্ব ঘটনা ঘটার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশের কাছে আসা।
১১ নভেম্বর রায় ঘোষণার পর হতে মানুষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা ও ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। ঘোষিত রায়ের সঠিকতা বা বেঠিকতা নির্ণয় করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তার জন্য এই মামলার দুই পক্ষের সংশ্লিষ্টরা রয়েছেন। আমরা মনোযোগ দিতে চাই বিচারকের করা মন্তব্য ও নিদের্শনার দিকে।
ধর্ষণের সংজ্ঞাও নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজকের সভ্য সমাজের উপযোগী জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন কোনো বিবাহিত নারী তার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারেন। স্ত্রীর 'ইচ্ছা' নেই বা শরীর ভালো নেই জানানোর পরও স্বামী জোর করে যৌনসম্ভোগ করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারেন। এমন কি কোনো যৌনকর্মী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করা হলে ঐ যৌনকর্মী তার মক্কেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
এরকম বাস্তবতায় বিচারক যখন বলেন, "অভিযুক্তের সাথে বাদির আগে থেকেই শারীরিক সম্পর্কের অভ্যস্ততা রয়েছে, সে কারণে ধর্ষণের অভিযোগ ভিত্তিহীন," তখন সত্যিই আমরা হতাশ হই। রায় ঘোষণার পর ভুক্তভোগী দুই নারী আদালতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সকল নারী অধিকার কর্মী ও মানবাধিকার কর্মীরা ক্ষুব্ধতা জানিয়েছে, ৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণের অভিযোগ থানায় না নেওয়ার জন্য বিচারকের নির্দেশনায়।
ধর্ষণের শিকার কোনো নারী ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম কিছুদিন একটা ট্রমার মধ্যে থাকেন। পরিবার 'জানাজানির' ভয়ে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তারপর যখন থানায় অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন অনেক দেরি (!) হয়ে যায়। বিচারক এই পরিস্থিতি ভেবে দেখেছেন কি? ধর্ষণের শিকার নারীর শারীরিক, মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই কেবল তার 'দায়িত্ব' নিয়ে কথা বলা যেতে পারে।
বিচারক রায় ঘোষণার প্রাক্কালে আদালতে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন, "আপনারা এই মামলাটিকে কেউ 'আলোচিত' কেউ 'চাঞ্চল্যকর' ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন কিন্তু আদালতের দৃষ্টিতে সকল মামলা সমান।" ফলে এটাও আর দশটার মামলার মতই একটা মামলা। কোনো মামলাকে আলোচিত বা চাঞ্চল্যকর হিসেবে বর্ণনা করলে আদালতের নিরপেক্ষতা নষ্ট হতে পারে। আদালত 'অনুরাগ' বা 'বিরাগের' বশবর্তী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তারপরও এই রায়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্য বক্তৃতায় এই রায়কে "অর্থের কাছে আত্মসমর্পণ" বলে অভিহিত করছেন।
আমাদের দণ্ডবিধিতে ধর্ষণের সংজ্ঞা ও শাস্তি নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সম্মতি ব্যতীত অথবা ভয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করে অথবা অন্যায়ভাবে বুঝিয়ে তার সম্মতি নিয়ে যৌন সহবাস করলে সেটা নারী ধর্ষণ নামে বিবেচিত হবে। এখানে নারীর 'ইচ্ছা' ও 'সম্মতি' গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলতে প্রত্যক্ষ আগ্রহের অভাবকে বোঝায়। ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় কোনো নারীর সাথে মিলিত হলে সে মিলনকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলন বোঝায়। জড়বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো নারীকে তার বুদ্ধির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যৌনসঙ্গম করাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলন বোঝাবে। মৃত্যুর ভয়ে বা আঘাতের ভয়ে সম্মতি দেয়াকে সম্মতি বলা চলে না। নারীর 'সম্মতির' জন্য ভয়, আঘাত বা 'অন্যায়ভাবে বুঝিয়ে' সম্মতি নেওয়াকে 'সম্মত' বলে গন্য হবে না। এই একই ধারাতে ১৩ বছরের কমবয়সি স্ত্রীর সাথে যৌন সহবাস করলে সেটা ধর্ষণ বলে বিবেচিত হবে।
বর্তমানে ধর্ষণের সকল মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় করা হয়ে থাকে। দণ্ডবিধির আওতায় এখন আর ধর্ষণের মামলা করা হয় না। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ ধারার ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে যৌন সঙ্গম করাকে নারী ধর্ষণ বলে।
এখানে আরো বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ যদি বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করে, তাহলে সেটা নারী ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে। এখানে প্রতারণামূলকভাবে নারীর সম্মতি আদায় প্রসঙ্গটি গুরুত্বপূর্ণ। এই আইনে স্পষ্ট যে ১৬ বছরের নীচে হলে নারীর সম্মতি থাকলেও তা ধর্ষণ। কারণ নারী প্রাপ্তবয়স্ক নয়। তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই।
কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়েও কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। একটা অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়, "বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ"। ধর্ষণে যে জোরপূর্বক বা বলপ্রয়োগের বিষয় থাকে তা এখানে অনুপস্থিত। প্রেমের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যখন শারীরিক সম্পর্ক হয় তখন সেটা নিশ্চয়ই ধর্ষণ না। কিন্তু পরে যখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না তখন ধর্ষণ মামলা করা হয়। এটা কি ধর্ষণ নাকি প্রতারণা? এ প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া দরকার। বিষয়টি আজকের প্রসঙ্গের সাথে যাবে না। আগামীতে লেখার ইচ্ছা রইল।
রেইনট্রি হোটেলের ঘটনায় অপরাধ সংগঠিত হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। আইনের ভাষায়, যেহেতু 'বলপ্রয়োগ' করা হয়নি, সে কারণে ধর্ষণ নয়। তাহলে, প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা। বিচারক এটা উপেক্ষা করেছেন। অভিযোগকারী নারীকে শারীরিক সম্পর্কে অভ্যস্ত বলে এড়িয়ে গিয়েছেন, এটা ন্যায়বিচার পরিপন্থী।