সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর অপব্যবহার রোধে দরিদ্র মানুষের নির্ভুল তালিকা দরকার
আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীগুলোতে সমস্যা দীর্ঘদিনের। এখানে 'এক্সক্লুশান এরর' যেমন আছে তেমনি 'ইনক্লুশান এরর'ও আছে। এক্সক্লুশান এরর হলো যারা সুবিধা পাওয়ার কথা অর্থাৎ দরিদ্ররা সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা পাচ্ছে না। আর ইনক্লুশান এরর হলো যারা না পাওয়ার কথা তারা পেয়ে যাচ্ছে। এ কারণে দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ সামাজিক নিরাপত্তার অর্থের বড় একটা অংশ সম্পদশালীদের দখলে চলে যাচ্ছে।
আমাদের সানেমের গবেষণায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসিবে চিহ্নিত করা হয়েছে এই দুই ধরনের ভুলকে। আবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী মূল্যায়নে সরকারের পক্ষ থেকে করা প্রায় সবগুলো প্রতিবেদনেও এই দুই সমস্যার কথা বলা হয়েছে।
এখন আলোচনার বিষয়টা হলো কেন এই ধরনের সমস্যা হয়?
সুবিধাভোগীর তালিকা করতে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেয়া হয়ে থাকে।
তবে বাস্তবতা হলো এ বিষয়ে কোন জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া নেই। এ ধরনের ভুলগুলো যাচাই করা বা সংশোধন করার কোন প্রক্রিয়াও নেই। তা ছাড়া ভুল ও অনিয়মের মাধ্যমে ভাতা পাওয়ার যোগ্যদের বাইরে অন্য কারো নাম ঢুকিয়ে দেয়া হলে শাস্তিরও ব্যবস্থা নেই।
এ কারণে স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন ত্রাণ ও সহায়তার তালিকায় নিজেদের পছন্দের লোকজনের নাম ঢুকিয়ে দেয়। সেটা আর পরবর্তীতে যাচাই করা হয় না।
মাঝে মাঝে হয়ত এ খাতে বড় ধরনের অনিয়ম ধরা পরলে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হয়, তবে এর সংখ্যাটা খুবই কম।
মোট কথা পুরো ব্যবস্থাটায় বড় ধরনের গলদ রয়েছে। ফলে দরিদ্র মানুষদের বড় একটা অংশ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বা ত্রাণ কার্যক্রমের সুবিধার বাইরে থাকেন।
এর বড় কারণ হলো দরিদ্র মানুষদের একটা নির্ভুল তালিকা করতে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এক দশক আগে প্রকল্প নিয়েছিল। সরকারের সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এত দিনেও বিবিএস কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন করেনি।
এ কারণে যখনই সরকার কোন দুর্যোগে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী নিয়ে দরিদ্র মানুষের কাছে পৌছাতে চায়, তখনই বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে যখনই দুর্যোগ দেখা দেয় তখনই নতুন করে তালিকার প্রয়োজন হয়।
এ বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সমন্বয়ে কেন এই তালিকা করা হচ্ছে না সে বিষয়টি অনেকটাই দুর্বোধ্য।
এই করোনার সময়ে নতুন দরিদ্রের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাড়িয়েছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসলেও তাদের কোন তালিকা নেই। তাদের কাছে প্রচলিত ব্যবস্থায় সহায়তা পৌঁছানো অনেকটাই কঠিন।
সরকারের অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী রয়েছে। আমার সুপারিশ হলো এ সব কর্মসূচীর মধ্যে একটা সমন্বয় দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীকে একটা প্ল্যাটফর্মের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
এ জন্য সঠিক তথ্য দরকার। জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা দরকার। আর দরকার তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার। সর্বোপরি দুর্নীতিতে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে না পারলে এ কর্মসূচীর সুফল দরিদ্র মানুষ পাবে না।
এ লক্ষ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে সরকারের প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এনজিও ও নাগরিক সমাজকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
[সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড.সেলিম রায়হান, টিবিএসের প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলামকে ফোনে এ সাক্ষাৎকারটি প্রদান করেছেন।]