সৌদিতে তিন যুবরাজ গ্রেপ্তারের নেপথ্যে
সৌদি রাজপরিবারের সদস্য ও কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের সাম্প্রতিক ঘটনাকে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে ক্রাউন প্রিন্সের একটি প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে, সেটি এখনই কেন ঘটল?
সৌদি রাজপরিবারের এসব ঘটনাকে আল জাজিরায় বিশ্লেষণ করেছেন ল্যাঞ্চেস্টার ইউনিভার্সিটির জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিমন ম্যাবন। তিনি লিখেছেন-
শনিবার ভোরে মুখোশধারী পুলিশ বাড়ি ঢুকে একে একে তিন গুরুত্বপূর্ণ যুবরাজকে তুলে নিয়ে যায়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করছেন, এই ঘটনা মূলত বাদশাহ হওয়ার পথে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরাতে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের চূড়ান্ত পদক্ষেপ।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন- বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের ভাই যুবরাজ আহমেদ বিন আবদুল আজিজ, সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফ এবং যুবরাজ নাওয়াফ বিন নায়েফ। তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক সভা করার গুজব ছড়িয়ে আছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই গুজব যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই ঘটল গ্রেপ্তারের ঘটনা।
পেছনের গল্প
এর পেছনে দুটি বিষয় কাজ করেছে বলে ধারণা করা হয়। প্রথমত সামনে থাকা সব বাধা সমূলে উৎপাটন করে বাদশাহ হওয়ার পথটি প্রিন্স ক্রাউন সুগম করে নিচ্ছেন। গ্রেপ্তারের এই ঘটনার মাধ্যমে মূলত দেশের ভেতরকার সমালোচকদের প্রতি কঠিন বার্তা ছুড়ে দেওয়া, ক্ষমতাকে সুসংহত করা এবং 'ভবিষ্যৎ বাদশাহ'র পেছনে ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের সবাইকে জড়ো হওয়ার ডাক দেওয়া হয়েছে।
তিন প্রভাবশালী যুবরাজকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ক্রাউন প্রিন্সের ক্ষমতা দেখানোর একটি প্রতীক। বিশেষ করে সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে যুবরাজ সালমান স্পষ্টই বার্তা দিয়েছেন, বিরোধীদের কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না।
প্রিন্স আহমেদ সম্প্রতিই লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছিলেন। দেশে ফেরার আগে তাকে নিরাপত্তা দেওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও করা হলো গ্রেপ্তার। লন্ডনে থাকাকালে তিনি রাজপরিবারের কিছু সমালোচনার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। বিশেষ করে, ইয়েমেনে সৌদি আরবের সামরিক আগ্রাসনের বিষয়ে তিনি রাজপরিবার নয়, বরং বাদশাহ ও প্রিন্স ক্রাউনকে প্রচ্ছন্নভাবে দায়ী করেছিলেন।
অন্যদিকে, মোহাম্মদ বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকেই মোহাম্মদ বিন নায়েফ কাটাচ্ছিলেন গৃহবন্দির জীবন। ফলে তার পক্ষে অভ্যুত্থানের কোনো প্রচেষ্টা চালানো আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব না বলে মনে হলেও, যুবরাজ হিসেবে সুপরিচিতি ও বাদশাহ হওয়ার সম্ভাবনাই তাকে যুবরাজ সালমানের চক্ষুশূল করেছে বলে ধারণা করা হয়।
বলে রাখা ভালো, ২০১৫ সালে বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় বসার পর ভবিষ্যৎ বাদশাহ বা ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালে আচমকাই তাকে সরিয়ে নিজ পুত্র সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স বানান তিনি। এ সিদ্ধান্তকে রাজপরিবারের অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। সেই থেকেই অভ্যুত্থানের গুঞ্জনে ভেতরে ভেতরে কাঁপছে রাজপরিবার ও রাজশাসন।
দ্বিতীয় কারণ
গ্রেপ্তারের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে ভাবা হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রচণ্ড চাপের কথা। যুবরাজ সালমানের ভবিষ্যতে বাদশাহ হওয়াকে অনেকেই সোদি আরবের জন্য ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন। তরুণদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করা যুবরাজ সালমান নিজ দেশকে তেলের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা থেকে সরিয়ে নিতে এবং ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতা কমাতে প্রিন্স ক্রাউন হওয়ার পরপরই সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের বেশ কিছু ব্যাপক-বিস্তারী উদ্যোগ নিয়েছেন।
তার অনেক সিদ্ধান্তই রক্ষণশীলদের খেপিয়ে তুলেছে। এই সুযোগে কেউ যেন অভ্যুত্থান ঘটাতে না পারে, নিজের যেন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যুবরাজ সালমান।