শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি থেকে সতর্ক হতে হবে, দূর করতে হবে বিভাজন
ভারতীয় প্রধান বিচারপতি আবার সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তার এক বক্তব্যের মাধ্যমে। সপ্তাহান্তে ভারতের রাজস্থানে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ভারতীয় রাষ্ট্রটি একটি পুলিশী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধীদেরকে শত্রু ভাবা হচ্ছে, পরিণতিতে দেশ একটি পুলিশী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। তিনি দেশে কারাগার ও বিচারাধীন আসামীদের সংখ্যা উল্লেখ করে বলেন, 'দেশে বিচারহীনতার একটি উদাহরণ হচ্ছে এই সংখ্যা। দেশের মানুষকে যে কোনো অভিযোগেই গ্রেপ্তার করা এবং জামিন না দেওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে ভারতে, তা ভারতীয় সমাজকে বিভাজনের দিকে আরো বেশি দ্রুততার সঙ্গে ঠেলে দিচ্ছে।'
এ অনুষ্ঠানে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আরো অনেক বিচারপতি ও ভারতীয় আইনমন্ত্রী সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। ভারতের মতো একটি বিশাল জনগোষ্ঠী ও বিশাল অর্থনীতির দেশে প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। এ দিয়ে প্রমাণ হয় দেশটির সামগ্রিক অবস্থা। সেই বিবেচনায় আমরা ছোট একটি জনসংখ্যার ছোট দেশ, যা ভারতের প্রধান রাজ্য উত্তরপ্রদেশ থেকেও ছোট।
আমাদের দেশের সামাজিক বিভাজন কতটা মারাত্মক তা আমরা দেখতে পাই সরকারের দু'এক জন মন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য থেকে। প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দলকে নানান ভাবে আক্রমণ করেন তারা। সে আক্রমণ কখনও কখনও গণতান্ত্রিক ভাষা অতিক্রম করে যায়। এরসঙ্গে আবার ধর্মীয় বিভাজন তো আছেই। খুবই ছোট এবং নগণ্য ইস্যুতেই এই ধর্মীয় সহিংসতা দেখতে পাই আমরা।
সাংবিধানিক পদাধিকারী নির্বাচন কমিশনার 'তলোয়ারের বিরুদ্ধে রাইফেল' ব্যবহার করার উপদেশ প্রদান করে সমাজকে কী সংকেত প্রদান করছেন?
বিশ্ব অর্থনীতির সামগ্রিক সংকটময় পরিস্থিতিতে সামাজিক ঐক্যটা খুবই জরুরী। সামাজিক বিভাজন আজ শ্রীলঙ্কাকে এক করুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেখানকার বিক্ষোভকারীরা মনস্থির করতে পারছেন না তারা সরকারে হিসেবে কাকে দেখতে চান। যেকোনো প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করছেন। ইতোমধ্যে একাধিক রাষ্ট্রপতির নাম কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নাম উচ্চারিত হলেও বিক্ষোভকারীরা তা গ্রহণ করছেন না। এমন পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার পার্শ্ববর্তী ভারতীয় রাজ্য তামিলনাড়ু থেকে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপের দাবি তুলেছে সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলো। এই তামিল বংশোদ্ভুতদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে সরকারের তীব্র লড়াই চলেছে বহুকাল। অতিতেও তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধ চলার সময় তামিলনাড়ুতে ভারত সৈন্য প্রেরণ করেছে।
শ্রীলঙ্কার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে ভারতের হস্তক্ষেপের দাবি তুলেছেন দক্ষিণ ভারতের তামিললাড়ু রাজ্যের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি অপরাপর তামিল রাজনৈতিক দলগুলো।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পার্লামেন্টের সর্বদলীয় সভা ডেকেছে। সেখানে পর্দার অন্তরালে নানান প্রচেষ্টা জারি আছে, দেশ-বিদেশে নানান কূটনীতিক প্রচেষ্টা চলছে শ্রীলঙ্কাকে একটি স্থায়ী শাসনের আওতায় আনতে।
শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী আপাত দৃষ্টিতে নিরপেক্ষ থাকলেও, দীর্ঘকাল ক্ষমতাসীনদের অধীনে কাজ করার ফলে তারাও ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টাই করছে। তাদের প্রস্তাবগুলো তাই প্রমাণ করে। শ্রীলঙ্কার এই সামাজিক বিভাজনের ইতিহাস দীর্ঘকালের ইতিহাস। বহু শতাব্দীর পুরনো ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যায়, শ্রীলঙ্কান সমাজ নানান ভাবে বিভাজিত ছিল।
শ্রীলঙ্কায় প্রায় সব সময় এক ধরনের গৃহযুদ্ধ বিরাজমান ছিল। কখনো কখনো দু-এক দশক রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকলেও পরবর্তীতে আবার সেই সামাজিক বিভাজনের কারণে তাদের গৃহযুদ্ধ ফিরে এসেছে। সর্বশেষ গৃহযুদ্ধ ছিল তামিলদের সঙ্গে ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। যে গৃহযুদ্ধের মূল কারণ ছিল তামিল জাতীয়তাবাদ; এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ধর্ম। তামিল জাতীয়তাবাদীরা মূলত হিন্দু সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী আর তার বিপক্ষে সিংহলিরা প্রধানত বুদ্ধধর্মে বিশ্বাসী। কিছু খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারীও আছে। সেই গৃহযুদ্ধে যার নেতৃত্বে বিজয় অর্জন হয়েছিল তিনি হচ্ছেন পলাতক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে, তার ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ও অন্যজন হচ্ছেন বর্তমানের প্রস্তাবিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে যার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে তিনি, ইতোমধ্যে বিদ্রোহীরা যার নাম প্রত্যাখ্যান করেছে।
মোট তামিল জনসংখ্যা আনুমানিক ২০ লক্ষের মত, গৃহযুদ্ধে প্রায় বিশ/ত্রিশ হাজার তামিল নিহত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তামিল নেতা প্রভকরনও নিহত হয়েছেন যুদ্ধে।
শ্রীলঙ্কান সমাজ এমনভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে যে দেশটিতে ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে প্রায় কুড়িটি রাজনৈতিক দল প্রতিনিধিত্ব করছে। এরকমভাবে বিভক্ত রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা চরম সংকটে পড়েছে সামাজিকভাবেও। সে কারণে সামাজিক বিভাজন নিরসন করাই এখন প্রধান দায়িত্ব দেশটির নেতাদের।
দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা অনেকটা শ্রীলঙ্কার মতোই বিভাজনের পথ অনুসরণ করছি। যদিও আমাদের বিভাজন এখনো দেশে কোনো গৃহযুদ্ধের সৃষ্টি করেনি কিংবা সে আশঙ্কা অমূলক। তবুও বিভাজনকে প্রতিরোধ করাই সমাজের প্রধান দায়িত্ব।
শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার ঘটনা অতিতে বহু দেশে ঘটেছে এবং তারা সেই অবস্থা আবার কাটিয়েও উঠেছে।
পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনী দেশগুলো দরিদ্র অথবা ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশগুলোকে নানা উন্নয়ন কার্যক্রমে ঋণ প্রদান করে থাকে। উন্নয়নের জন্য যে ঋণ প্রদান করে থাকে সেই ঋণ তাদের শর্ত অনুসারে পরিশোধ না হলেই দেউলিয়া হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এই দেউলিয়া হওয়া তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, কারণ এই ধনী দেশগুলো তাদের নিজের স্বার্থেই এই ঋণের নামে বিনিয়োগ করে থাকে। এই বিনিয়োগের উপর টিকে থেকে তাদের অর্থনীতি।