দুই পাড়ে অপরিকল্পিত শিল্পায়নে পদ্মার দশা বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী বা তুরাগের মতো হবে নাতো!
বছরের পর বছর ধরে আমাদের উন্নয়ন ভাবনায় যেহেতু নদী, পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতির বিপরীতে স্ট্রাকচার বা অবকাঠামোর দৃশ্যমানতাই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে, ফলে ঘরপোড়া গরুর মতো এখন প্রমত্তা পদ্মার বুকে দেশের দীর্ঘতম সেতুর জেল্লা দেখে যারা উন্নয়নমুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ নিয়ে ভাবেন, তাদের মনে এই শঙ্কাই প্রবল হচ্ছে যে, পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও নগরায়নের নামে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এই নদীটির দশাও বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী বা তুরাগের মতো হবে কি না?
রাজধানী ঢাকা গড়ে উঠেছে যে নদীকে কেন্দ্র করে, সেই বুড়িগঙ্গাকে বিপন্ন করা হয়েছে উন্নয়নের দোহাই দিয়েই। একই অজুহাতে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত করা হয়েছে ঢাকার পার্শ্ববর্তী আরেক গুরুত্বপূর্ণ নদী তুরাগকে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর জন্য সাভারের হেমায়েতপুরে ট্যানারি পল্লী সরিয়ে নিয়ে সেখানে বিপন্ন করা হয়েছে ওই এলাকার মানুষের লাইফলাইন ধলেশ্বরী নদীকে। ওখানকার পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে, গত বছরের আগস্টে হেমায়েতপুরে গড়ে তোলা ট্যানারি পল্লী বন্ধের সুপারিশ করেছে জাতীয় সংসদের পরিবেশ বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। কারণ ওই ট্যানারির বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। এতে নদীর পানি শুধু দূষিত নয়, বিষাক্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ বারবার আমাদের নদীগুলোকে ধর্ষণ করা হয়েছে কথিত উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির অজুহাতে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের আগে থেকেই বলা হচ্ছিলো যে, এর দুই পাড়ে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। স্যাটেলাইট টাউন গড়ে উঠবে। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়বে ইত্যাদি। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি বাড়াতে গিয়ে পদ্মা নদীর কী দশা করা হবে—তা নিয়ে এখনই ভাবা দরকার। সুনির্দিষ্টভাবে এখনই প্রতিটি পরিকল্পনায় নদী ও প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা এবং নদীরক্ষায় শূন্য সহনশীল নীতি বাস্তবায়ন করা না গেলে পদ্মা সেতুর সুবিধা নিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার মানুষ ফুঁস করে রাজধানীতে আসা-যাওয়া করবে ঠিকই; এই সেতুর দুই পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানাগুলো দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখবে ঠিকই—বিনিময়ে আমাদের বিপন্ন নদীর তালিকায় যুক্ত হবে দেশের অন্যতম প্রধান নদীটিও।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমানের ভাষায়, শুধু দ্রুততর যোগাযোগ, বিতরণ ও বিপণনের সুবিধার কারণে নয়, পদ্মা সেতু করিডরের উভয় পাশে ব্যক্তি খাতের উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের যে সুযোগ সৃষ্টি হবে, তার সুবাদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়বে বহুমাত্রিক প্রভাব। ইতিমধ্যে সেতুকে ঘিরে অ্যাপ্রোচ রোডের দু'ধারে বিভিন্ন শিল্প ও সেবা স্থাপনার সাইনবোর্ড দৃশ্যমান হচ্ছে। সেতুকে কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের ১৩ জেলায় ১৭টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার ও একাধিক শিল্পপার্ক স্থাপনের পরিকল্পনা আছে। শুধু স্থানীয় বাজারমুখী নয়, রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপও অনেক উদ্যোক্তা ইতিমধ্যে গ্রহণ করছেন। এতে মানুষের কর্মসংস্থান হবে, জীবনযাত্রার মান উন্নতি হবে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে। (প্রথম আলো, ২৫ জুন ২০২২)।
তবে এটি হচ্ছে মুদ্রার একপিঠ। সকল উন্নয়নেরই অন্যপিঠও আছে। সে কারণে পদ্মার দুই তীরে যেকোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তথা কলকারখানা ও অন্যান্য অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। সেতুর দুইপাড়ের জমির দাম এখন অনেক বেড়ে গেছে। অনেকেই স্বপ্ন দেখছেন জমি বিক্রি করে কোটিপতি হবেন। অনেক আবাসন কোম্পানি একরের পর একর জমি কিনে সেখানে প্লট ও ফ্ল্যাট বিক্রি করবে। একসঙ্গে স্থল, নৌ ও রেল যোগাযোগের সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে অনেক বড় বড় কোম্পানি সেখানে কলকারখানা গড়ে তুলতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার, সেখানে নদী, পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতি যে বিবেচনার বাইরে চলে যায় এবং রাষ্ট্রও অনেক সময় পয়সাওয়ালাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, তার উদাহরণ ভুরিভুরি। ফলে পদ্মার দুই তীরে কোন ধরনের শিল্প-কারখানা ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে, সে বিষয়ে এখনই একটি পরিষ্কার নীতিমালা করতে হবে।
বলা হচ্ছে, আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) মোটরযান চুক্তির বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এই সেতুর ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, সেতুর দুই ধারে রেল সংযোগ, ট্রান্সএশিয়ান হাইওয়ে ও রেল সংযোগ—এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে পদ্মা সেতু। এসব পরিপ্রেক্ষিতেই সেতুর দুই পাড়ে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গড়ে তোলার প্রবণতা ও প্রক্রিয়া শুরু হবে। নির্মম বাস্তবতা হলো, নদী তীরের যেকোনো অবকাঠামো বা স্থাপনাই নদীর জন্য বিপজ্জনক। সুতরাং, পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে কোন ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা যাবে যা নদীর জন্য বিপদ তৈরি করবে না—সেই গবেষণাটি এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
জমি হলো সোনা। সোনার দাম যেমন দিন দিন বাড়ে, জমিও তেমন ফেলে রাখলেও প্রতিদিনই এর দাম বাড়ে। বিশ বছর আগে পদ্মা সেতু এলাকায় যিনি জমি কিনে রেখেছেন, তার সেই জমির দাম এখন কয়েকশো গুণ বেড়েছে। সুতরাং শুধু আবাসন কোম্পানি কিংবা শিল্পকারখানার মালিকরাই নন, পদ্মা সেতুর দুই পাড়ের জমির মালিকরাই একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক হওয়ার লোভে নানাজনের কাছে জমি বিক্রি করতে চাইবেন। আর কোটি টাকা দিয়ে জমি কিনে নিশ্চয়ই কেউ সেখানে ধান চাষ করবেন না। বরং ওই টাকার কয়েকগুণ তুলতে চাইবেন। সুতরাং যেখানে টাকার খেলা, সেখানে নজরদারিও প্রয়োজন হয় অনেক বেশি।
যেকোনো শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগে এবং নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন করে দেখার কথা যে সেখানে পরিবেশবিরোধী কোনো কাজ হচ্ছে কি না। কিন্তু কোন তরিকায় ছাড়পত্র মেলে এবং কারখানা পরিদর্শনের নামে আসলে কী হয় কিংবা আদৌ কোনো পরিদর্শন হয় কি না, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কারণ টাকার কাছে সকলেই অসহায়। আছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার দাপট। ফলে অনেক সময় প্রশাসনের সৎ অফিসাররাও হার মানেন। নদী ও পরিবেশ প্রকৃতির প্রতি তাদের দরদ থাকলেও নানাবিধ চাপের কাছে তারা হয় নীরব থাকেন কিংবা কর্মস্থল বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু পদ্মার বুকে নিজস্ব অর্থায়নে বিরাট একটি সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশ যে স্পর্ধা ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে, সেটি ম্লান হয়ে যাবে যদি পয়সাওয়ালারা শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের বিনিময়ে পদ্মা নদীকেও বুড়িগঙ্গা-তুরাগ-শীতলক্ষ্যা বা ধলেশ্বরীতে পরিণত করেন।
যেকোনো নদীর তীরে স্থাপনা তৈরির জন্য প্রথমেই দরকার হয় কোনো না কোনো কায়দায় নদীর জমি ভরাট করা। প্রথমে ময়লা ফেলে, তারপর বাঁশ বা কাঠের অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করে এবং কখনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে (যাতে কেউ উচ্ছেদ করার সাহস না পায়) ধীরে ধীরে নদীর জায়গা সংকুচিত করা হয়। অর্থাৎ একজন মানুষকে যেমন কোনো একটি জায়গায় আটকে রেখে তাকে দিনের পর দিন প্রয়োজনীয় খাদ্য, আলো, বাতাস না দিয়ে দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়, নদীর ক্ষেত্রেও সেই একই পদ্ধতি অবলম্বন করে তাকে ধীরে ধীরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়—যার পেছনে প্রধানত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই যুক্ত থাকেন। সুতরাং পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে ব্যক্তিগত জমি বাড়ানোর নামে কেউ যাতে এরকম কায়দা-কানুন করতে না পারে, সে বিষয়ে সরকারকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের দায়িত্ব অনেক বেশি। গণমাধ্যমের দায়িত্ব আরও বেশি।
এই শতাব্দীর শুরুতেও দেশের মানুষের কাছে পদ্মা নদীর উপরে সেতুর বিষয়টি স্বপ্নের মতো মনে হলেও এখন এটি বাস্তব সত্য। সেই স্বপ্ন সত্যিই ডানা মেলেছে। কিন্তু স্বপ্নের এই ডানা মেলার মধ্য দিয়ে যেসব প্রশ্নেরও সুরাহা করতে হবে তার অন্যতম হচ্ছে নদীর দুই তীরে কী ধরনের শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হবে? সেইসব কারখানায় উৎপাদিত বর্জ্যের গন্তব্য যদি হয় এই নদী, তাহলে সেই উন্নয়ন আমরা চাই না। এখনই ভাবতে হবে, পদ্মা যেহেতু নদীমাতৃক বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান লাইফলাইন, অতএব উন্নয়নের নামে এর দুই তীরে এমন কোনো স্থাপনা গড়ে তোলা যাবে না, এমন কোনো কলকারখানা গড়ে তোলা যাবে না, যার ফলে নদীর পানি বিপন্ন হয়। নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা নদী ভরাট করে একে ছোট করে ফেলা হয়।
বড় বড় শিল্প-কারখানার মালিকরা এতই প্রভাবশালী যে, তারা নদীতীরে কারখানা গড়ে তোলার অনুমতি পেলে নদীও খেয়ে ফেলে। কারখানার বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে নদীকে নিয়ে যায় এবং অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সেই নদীর জমি তারা নিজেদের নামে লিখেও নেয়। সুতরাং ভূমিদস্যু হিসেবে কুখ্যাতি আছে এবং নদী ও জলাধার দখল করে সেখানে স্থাপনা গড়ে তোলার অভিযোগ আছে, এমন কোনো প্রতিষ্ঠান যাতে পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে কোনো কলকারখানা গড়ে তোলার অনুমতি না পায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ তারা অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে পদ্মাও গিলে খাবে।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে বাঙালির মাথা যেমন উঁচু হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ়তা যেভাবে প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এই সেতুর দুই পাড়ে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার নামে যাতে নদীকে বিপন্ন করা না হয়, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। যেসব কারখানা গড়ে তোলা হবে সেখানে সর্বাধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে—যাতে কোনো বর্জ্য নদীতে না পড়ে। মনে রাখতে হবে, এই পদ্মা হচ্ছে জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজননকেন্দ্র। এর পানি দূষিত হলে ইলিশের মতো বিরাট সম্পদ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাবে—যা শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে অনেক বেশি দামি।
কলকারখানার বর্জ্য কত ভয়াবহ হতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী। সুতরাং পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এর দুই পাড়ে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, সেই অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যাতে কোনোভাবেই নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত, নদীর জমি দখল কিংবা নদীর পানি দূষণের কারণ না হয়—সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বরং নদীর তীরে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে তোলার অনুমতি না দিলেই সবচেয়ে ভালো। তাতে নদীটা নিরাপদ থাকবে। নদী বিপন্ন হলে মানুষও বিপন্ন হবে। নদীমাতৃক দেশ থেকে যদি নদীই হারিয়ে যায়, সেই দেশে মানুষ থাকবে কী করে!
- আমীন আল রশীদ: নেক্সাস টেলিভিশনের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর