ভালো থেকো তেল সোনালি ডিজেল এবং মূল্য সমন্বয়!
সবকিছু আসলে পেট্রোলিয়াম পণ্য থেকে উৎপন্ন হয়। তাই তেলের দাম বাড়লে সবকিছুর দাম বাড়ে!
... রাশিয়ান প্রবাদ
সাত বছর পর প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা এয়ারপোর্টে। প্রেমিকা ফিরেছে বিদেশ থেকে, এবার প্রেমিককে নিয়ে যাবে সেখানে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল তারা। বেশ কিছুক্ষণ পর প্রেমিক বললো, 'ছাড়ো। মানুষ আমাদেরকে দেখছে!' প্রেমিকা বলল, 'তোমার গায়ের ঘ্রাণ আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে! কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম দিয়েছ, ডার্লিং?' প্রেমিক আলতো করে বলল, 'অকটেন! আমাদের দেশের বাইপ্রডাক্ট! প্রেট্রোলের ফ্লেভারটাও দারুণ!'
তেলের ঘ্রাণ এখন আমাদের মাতাল করে দিচ্ছে! পৃথিবী চলে তেলে। বাংলা ছবির গানে আছে—'তেল গেলে ফুরাইয়া, বাত্তি যায় নিভিয়া/ কী হইবো আর কান্দিয়া?'
বাত্তি নেভার একালের শব্দ হচ্ছে লোডশেডিং যা দেশে নতুন করে ফিরে এসেছে! লোডশেডিংয়ের সাথে ফিরেছে ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি। স্বাধীনতার পরে জ্বালানি তেলের দাম এত বেশি কখনো বাড়েনি (আগস্ট ২০২২)। কিন্তু এটা নাকি মূল্যবৃদ্ধি নয়, মূল্য সমন্বয়! এ কারণে কবিতা বেরিয়েছে এমন—'ভালোবাসি বলতেও ভয় করে আজকাল/আমার কাছে অমৃত যা তোমার কাছে বিষের ঝাল!/ভালোবাসি বলার পরেও কার যে সমন হয়!/ কোনো কিছুর দাম বাড়ে না, মূল্য সমন্বয়!'
মূল্য সমন্বয় আপনি অনেকভাবে করতে পারেন। সম্পর্ক জোড়া লাগাতে অনেক মূল্য দিয়েছেন? এবার তাহলে সমন্বয় করুন! রেল কিংবা যেকোনো ধরনের পাবলিক পরিবহন চলে তেলে। এতদিন রেল, বাস, লঞ্চের ভাড়া কম দিয়েছেন? তাহলে প্লিজ এবার বেশি বেশি দিয়ে মূল্য সমন্বয় করুন! খাবারের স্বাদ থাকে তেলে। এতদিন বাসা, হোটেল বা রেস্তোরাঁয় অপেক্ষাকৃত কম দামে খেয়েছেন? এবার তাহলে প্লিজ একটু বেশি দিয়ে মূল্য সমন্বয় করুন। বাজার থেকে এতদিন অপেক্ষাকৃত কম দামে শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম কিনেছেন? তাহলে এখন বেশি দামে কিনে মূল্য সমন্বয় করুন। চাকরি ক্ষেত্রে অসুখী আপনি? অফিসের বসকে তেল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন? প্লিজ বসের জন্য রাখা তেলকে বেশি বেশি করে সমন্বয় করুন। চাকরি না থাকলে চলবে?
ঠিক তেমনি তেল ছাড়া চলবে? চলবে না। গ্যাস আর তেলের মূল্যবৃদ্ধি বা সমন্বয় করার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। গ্যাসের ক্ষেত্রে একটা জবাবদিহিতামূলক আলোচনা হয়। কেন দাম বাড়ানো হচ্ছে, দাম বাড়ানো হলে কোন কোন ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে এটা নিয়ে সরকার ও গ্যাস কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এবার জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে মধ্যরাতে একটা প্রায় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ কী? কারণ দুই ধরনের। সরকারি ও পাবলিকের বিশ্লেষণ।
এক. সরকারি বিশ্লেষণ—বাংলাদেশ প্রেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ক্ষতি কমানোর জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কিন্তু পাবলিক বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন বা সমীক্ষা ঘেঁটে বলছে যে গত কয়েক বছরে বিপিসি কিন্তু চল্লিশ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছিল! তাহলে ভর্তুকি দেয়া যেত কিংবা চব্বিশ মাস সময় নিয়ে ধাপে ধাপে দাম বাড়িয়ে একটা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে এই অবস্থার উত্তরণ ঘটানো যেত। কিন্তু তা না করে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার জন্য তাদের শর্ত মেনে নেয়া হয়েছে। আসলে মুক্ত ভালোবাসা বলে কিছু নেই, সবই শর্তের লীলাখেলা!
দুই. সরকারি বিশ্লেষণ—'ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জ্বালানি তেল ও দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানো হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। বাংলাদেশেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা ছাড়া উপায় ছিল না!'
পাবলিকের বিশ্লেষন—বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমেছে এটা চন্দ্র সূর্যের মতো সত্যি! তাহলে? পাবলিক নেট ঘেটে বের করেছে যে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলংকার চেয়েও বাংলাদেশে এখন জ্বালানি তেলের দাম বেশি! বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ১৩০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল, পরে নব্বই ডলারে নেমে আসে। দাম কমে আশি ডলারও হতে পারে। কিন্ত বিশ্ববাজারে তেলের দাম যখন কমেছে তখন রাতের আঁধারে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। করোনাকালে যখন সারা বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কম ছিল তখনও বাংলাদেশে জ্বালানির দাম কমানো হয়নি!
তিন. জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কেমন? সরকারি বিশ্লেষণ—'সরকার জনবান্ধব। জনগণের ভোগান্তি যাতে না হয় সেদিকে সরকারের দৃষ্টি আছে।'
পাবলিকের বিশ্লেষণ—তরি-তরকারি, মাছ-মাংস, ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। বাস, লঞ্চ, ট্রেন, বিমানের ভাড়া বেড়েছে। পড়ালেখা, অফিসযাত্রাসহ জীবনের সবকিছুতে বাড়তি দামের প্রভাব ফেলেছে। শুধু বেতন বাড়েনি। সম্ভবত এটাই জনবান্ধব সরকারের নমুনা।
চার. সরকার কিছু না জানালেও সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগবে চাষাবাদ ও পরিবহনে। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে বীজ, আবাদ, সবজি উৎপাদনে বেশি খরচ পড়বে। উৎপাদনস্থল থেকে সেসব দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে যেতে পরিবহন খরচ বাড়বে। শেষমেষ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব পড়বে। দুবেলা খাবারের জন্য যে কেনাকাটা করতে না পারার দীর্ঘশ্বাস, তা দূর করার জন্য কেউ কেউ নেমে আসবে রাস্তায়। রাস্তায় শুধু মিছিল-বিক্ষোভই হয় না; ডাকাতি, ছিনতাই কিংবা ভিক্ষাবৃত্তিও হয়!
পাঁচ. এতদিন যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে গর্ব করা হয়েছিল সেই রিজার্ভে টান পড়েছে! টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে কয়েক দফায়। মধ্যবিত্তের চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা বিদেশ ভ্রমণের জন্য সামান্য কিছু ডলার পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা খবর চাউর হয়েছে—'গত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ছয় লক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়েছে'! বাংলাদেশে হাতেগোনা কজন মানুষের কাছে খেলাপি ঋণ কত হাজার কোটি?
এই টাকা ফেরত আনার দাবি সম্ভবত অলীক কল্পনা! বাস্তবতা হচ্ছে কবিতা—'মুদ্রাস্ফীতির মেদ জমে, বাড়ে মানচিত্রের ঋণ/ তোমার ঠোঁটের তিলে জমে আছে নাবিকের নিকোটিন'!
আগেই বলেছি রাস্তায় শুধু ভিক্ষাবৃত্তি না, অন্য কিছুও চোখে পড়ে!
ছয়. বাংলাদেশ থেকে লোডশেডিং নাকি জাদুঘরে চলে গিয়েছিল। সেটা আবার ফিরেছে। কিন্তু ১৮টি 'কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন' কেন্দ্রের খবর কী? বলা হচ্ছে ১০টি থেকে বিদ্যুৎ কিনলে টাকা, না কেনা হলে টাকা দিতে হয় না। কিন্তু ওই দশ কেন্দ্রের জায়গা-জমি, স্থাপনা কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য আর কোনো খরচ নেই? বাকি যে আটটায় বিদ্যুৎ উৎপন্ন হোক আর না হোক, কড়ায়-গণ্ডায় ডলারে টাকা শোধ করতে হয়, তাদের ক্ষেত্রে? কুইক রেন্টালের কুইক কুফলের দায়ভাগ কীভাবে শোধ করবে সরকার? নাকি আমজনতারই সেটা কাঁধে তুলে নিতে হবে?
লেখাটা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। আসলে মানুষের তেল ছাড়া একদণ্ড চলে না। চাকরি ভালো থাকে তেলে। মানুষ সচল রাখার উপায় নাকি তেল। সম্পর্কও ভালো থাকে তেলে। শিশুকে হাসিখুশি রাখার উপায় তেল মাখানো, অতঃপর গোসল। মানুষ তেলের খনি পেলে নিজেকে বড়লোক মনে করে। এত সব তেলের বিপরীতে সয়াবিন সহজলভ্য হোক। সুলভে যেন কিনতে পারে মানুষ, যদিও আবারও বেড়েছে সয়াবিনের দাম। শেষমেষ ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কিছু প্রশ্ন আর এই গল্পটা বলার জন্য।
প্রশ্ন: ইরাকে যেদিন তেল থাকবে না সেদিন কী হবে?
উত্তর: ইরাক ক্রমশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে!
সম্পূরক প্রশ্ন: উত্তর কোরিয়ায় গণতন্ত্র নেই কেন?
উত্তর: তেলের খনি নেই বলে!
প্রশ্ন: ইরানে বড় তেল খনি আবিষ্কৃত হলে কার রাগ বাড়বে?
উত্তর: অ্যামেরিকার।
প্রশ্ন: রাশিয়ায় তেলের দাম বেড়েছে। কীভাবে কমানো সম্ভব?
উত্তর: পেট্রোল পানের অভ্যাস করান আর ভদকা দিয়ে গাড়ি চালান!
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।