সরকারি খরচে গ্রন্থ প্রণয়ন ও পাঠ প্রসঙ্গে
সন্দেহ নেই বই পড়ার উপকারিতা অপরিসীম। তাও আবার সরকারি খরচে সরকারি চাকুরেদের জন্য। তবে সেই বই রচনা, তার গুণগত মান ও জাত বিচার এবং সে বইয়ের বিপণন বিতরণ বাবদ ব্যয়কে একই পাল্লায় পর্যালোচনার উপায়-উদ্যোগ থাকা দরকার। কেননা কোনো কাজে উদ্দেশ্য ও বিধেয়র মধ্যে ফারাক থাকা বা ভুল বোঝাবুঝি বিব্রতকর কর তো বটেই।
একদিকে সকল প্রকার ব্যয়ে সাশ্রয়ী ও কৃচ্ছতা সাধনের মহড়া যখন চলছে, সে সময় কোটি কোটি টাকা ( ৯ কোটির বেশি ব্যয় নিশ্চয়ই সামান্য নয়) এমন এক 'উদ্দেশ্য' পূরণের জন্য ব্যয়ের উদ্যোগ। যেখানে সেখানে সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পর্যালোচনার অবকাশ থেকে যায়।
মোটা দাগে তিনটি বিষয় এখানে বিচার বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। এক, কাদেরকে এবং কেন বই পড়াবার জন্য এই বিশাল বপুর বিনিয়োগ, কারা কোন ধরনের বা বিষয়ে সেই বই রচনা করছেন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির দৈব দুর্বিপাক-দুর্দিনের কালে সুদিন ফেরানোর ক্রান্তিকালে এই জাতীয় ব্যয় সময়োপযোগী কিনা।
জনগণের সেবককে (পাবলিক সার্ভেন্ট) কর্মে অধিক উদ্যোগী এবং তাদের সেবার মনোভাব ভঙ্গীকে উদ্বুদ্ধ বা পরিশীলিত করতে বই পড়ানোর উপায় ও উপলক্ষ নির্মাণ ও নির্ধারনকে নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা দরকার । কেননা এই অতিশয় ব্যতি ব্যস্ততার কালে, ডিজিটাল-ভার্চুয়াল কর্ম পরিবেশে, হার্ড কপি বই পড়ার ফুরসত কতটা ও ফলাফল কতটুকু মিলবে সে বিষয়ে সংসয় সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
বড় ছোট সকল অফিসে বুক কর্নার বানিয়ে বই দর্শনযোগ্য করলেই বই পাঠ, অনুধাবন ও উপলদ্ধির স্তরকে বিন্যাস-বিন্যস্তকরন বাস্তবতার আলোকেই অপাংক্তেয় মনে হয়। এটা তো সংশ্লিষ্টদের অধিত বিদ্যা বুদ্ধি বিবেচনা, জ্ঞান কান্ডজ্ঞান ও দায়িত্ববোধের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের সামিল।
সরকারি অর্থ ব্যয় করে 'বয়স্ক ও পাকাপোক্ত' সুশীল সেবককে (সিভিল সার্ভেন্ট) ছবক বা মগজ ধোলাইয়ের কাজটি যার যার তার তার হাতে ছেড়ে দিতে হলে সরকারি অর্থের (ভর্তুকি) অপচয় হবেই। নিজের টাকায় বই কিনে পড়লে সে বই পাঠে মন থাকে ও দায়িত্ববোধ বাড়ে।
দ্বিতীয় প্রসঙ্গ- এসব বই যারা লিখছেন তাদের সৃজনশীলতা ও যোগ্যতা যদি যেনতেন প্রকারের হয় তাহলে সেই বই পাঠকের কোন উপকারে আসবে না। এ ব্যাপারে 'বিষয়' ও লেখক নির্বাচনে/নির্ধারণে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠলে পুরো কর্মসূচিটির জাত কূল মান সবই যাবে। অতএব লেখক ও বিষয় নির্বাচনের যাচাইয়ের আবশ্যকতা থেকেই যাবে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আনতে ও ধরে রাখতে তাদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদানের কালেও তিনটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য থেকে যায়-
(১) ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে সরকারি টাকা বা ভর্তুকি দিয়ে বিনামূল্যে বই দেয়ার যৌক্তিকতা। বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেয়ার অর্থ ব্যায় কি গাদা গাদা গাইড বই ও কোচিং এর মাধ্যমে ব্যক্তি বা পরিবারের শিক্ষা ব্যয় বাড়ানোর সাথে সমন্বয়যোগ্য হবে? দেশে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে, ধনীরা আরো ধনি হচ্ছে এরকম একটা পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে 'সকল'কে বিনামূল্যে (শিক্ষাখাতের বাজেটের টাকা ভর্তুকি হিসেবে) ব্যয়ের যথার্থতা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে
(২) কেন্দ্রিয়ভাবে সিন্ডিকেটেড লেখক/সম্পাদকদের দিয়ে 'পাঠ্যপুস্তক' প্রণয়ন ও বিতরণের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চায় মুক্ত ও বিদ্যা চর্চার পথকে সীমিত করা হচ্ছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। এ অবসরে ইতিহাস বিকৃতির সুযোগ (এমনকি বাক্য ও বানান বিকৃতি) কে অবারিত করে মুক্তবুদ্ধি বিকাশের অন্তরায় সৃষ্টির উপায় হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে কিনা দেখা দরকার।
(৩) দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রবাহমান সময়ের সাথে সংগতিপূর্ণ, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। হাকিম নড়বে তো হুকুম নড়বেনা এই স্বতঃসিদ্ধের আলোকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা , ইতিহাস নির্মাণ ও তা পঠন পাঠককে সীমিত শাসনকালের সীমা পরিসীমার শিকলে বাঁধা সমীচিন নয়। শিক্ষা হবে সর্বজনীন ও কালউত্তীর্ণ ।
মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সরকারি চাকুরেদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে উপরোক্ত তিনটি বিষয় সরকারি ব্যয়ে সরকারি চাকুরেকে অধিকতর জ্ঞ্যান দানের উদ্যোগে অর্থনৈতিক টানাপোড়নের এই সময়ে বড্ড বাহুল্য ও বেমানান মনে হবে।
মোগল ও ব্রিটিশ আমলেও সিভিল সার্ভেন্টরা বই লিখতেন; তবে তারা যা লিখতেন, তার সেগুলিই কালোত্তীর্ণ হতে পেরেছে যেগুলোর মধ্যে সারবস্তু, পান্ডিত্য ও অভিজ্ঞতার বিশ্বস্ত বয়ান থাকত। আইন-ই-আকবরি, বাহাবাস্তান গায়বির মত বই, উইলিয়াম হান্টার, বিভারিজ, ওয়েস্টল্যান্ড এমনকি আমাদের বঙ্কিমবাবুর মত বিজ্ঞ সিভিল সার্ভেন্টদের বই এখনও ক্লাসিক।
তাদের পরে বা এখনো যে সিভিল সার্ভেন্টদের পান্ডিত্বপূর্ন বই রচিত হয়নি বা হচ্ছেনা তা বলা হচ্ছে না , তবে দেখতে হচ্ছে , এখন শুধু বিশেষ উপলক্ষকে কেন্দ্র করে, শুধু সুদৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, এনাম, পদক ও পোদ্দারীলাভের সস্তা উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত বইয়ের মধ্যে সারবত্তা খুজে পেতে কষ্ট হয়।
বিশেষ পদাধিকারী কর্মকর্তা সংকলন প্রকৃতির বই লিখে তার অধিনস্তদের দিয়ে পুশ সেল করে সে বিশাল আয় তা তো স্রেফে দুর্নীতি। (সরকারি কাজে ফাঁকি দিয়ে সময় ব্যয় এবং তা কিনতে কাউকে বাধ্য করা )। ইদানীং সিভিল সার্ভেন্টদের রচনায় বই বন্যা এবং গুনাগুণ বিচার ব্যতিরেকে তা সকল দপ্তরকে তা কিনতে বাধ্য করার মধ্যে সরকারি অর্থের অপচয়, এবং লেখক নির্বাচন/নির্ধারণে প্রীতি ভাজনদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে।
সরকারি অর্থ বা পাবলিক মানি এভাবে ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। এটি কাম্য নয়। ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়া বা কৃচ্ছতা সাধন সমর্থনের পিচ্ছিল প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকুরেদের জন্য সরকারি খরচে গ্রন্থ প্রণয়ন ও পড়াবার এ উদ্যোগ ও প্রক্রিয়া স্বয়ং সরকারি অর্থ ব্যয়ের উদ্দেশ্য ও বিধেয়কে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দেবে।