ইডেনের ছাত্রীদের কেন হেয় করা হচ্ছে? অপ-ছাত্ররাজনীতির দায় কি তাদের?
এসএসসি পাশ করার পর যখন হলিক্রস আর ইডেন কলেজে এইচএসসি পড়ার জন্য নির্বাচিত হলাম, তখন আব্বা ইডেনে ভর্তি হতে বললেন। আমার ইচ্ছা ছিল হলিক্রস কলেজে পড়ার। আব্বা বললেন, ইডেন একটা ঐতিহ্যবাহী সরকারি কলেজ। এই কলেজে পড়ার মর্যাদাই অন্যরকম। অনেক বড় মানুষ এই কলেজে পড়েছেন এবং এটিই প্রথম মহিলা কলেজ। অগত্যা আব্বার উৎসাহে ইডেনেই ভর্তি হলাম।
সেই প্রিয় কলেজের ইমেজ নিয়ে যখন টানাহেঁচড়া শুরু হয়েছে, তখন সেখানকার পুরোনো ছাত্রী হিসেবে লজ্জিত ও দুঃখ বোধ করছি। বিশেষ করে ইডেনে পড়ুয়া ৪০ হাজার মেয়ের জন্য। যে ছাত্রীরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য এই কলেজে ভর্তি হয়েছে, তাদের ইমেজ নিয়ে বাজে কথা বলা ও মন্তব্য করা গর্হিত অপরাধ।
ইডেন কলেজে কী ঘটেছে? কে বা কারা কতটা দায়ী? এদের আদৌ বিচার হবে কি হবে না, এসবের চাইতেও এখন বড় ব্যাপার হচ্ছে ইডেনের সাধারণ ছাত্রীদের অসহায় অবস্থা। কলেজের গোলযোগ, মারামারি, হোস্টেলে সিট বরাদ্দের জন্য ছাত্রীদের উপর যৌন হয়রানি সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সবচাইতে বিপদে পড়েছেন অসংখ্য সাধারণ ছাত্রী। তাদেরকে নানাভাবে কটুক্তি ও হেয় করা হচ্ছে বলে ছাত্রীরা মানববন্ধন করেছেন।
তারা মানববন্ধন করে বলেছেন, 'ছাত্রলীগ নেত্রীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পরস্পরবিরোধী যে নোংরা অভিযোগ করেছেন, তাতে বিপদে পড়েছি আমরা। সত্য মিথ্যা যাচাই না করেই সবাই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। বলা হচ্ছে আমরা হলে সিট পাওয়ার জন্য দেহব্যবসা করি। আমাদের যৌনকর্মীদের সাথে তুলনা করা হচ্ছে'। তারা অভিযোগ করেছে তাদের যেসব আত্মীয় আগে খোঁজখবরও নিতেন না, এখন তারাই ফোন করে টিটকারি মারছেন।
মেয়েদের অভিযোগ যে কতটা সত্য তা দেখতে পেলাম ঐ নিউজের নিচের মন্তব্য পড়ে। সত্যিই সাধারণ ছাত্রীদের প্রতি খুব বাজে ধরনের মন্তব্য করা হচ্ছে। হাসাহাসি করা ছাড়াও কুৎসিত ধারণা পোষণ করা হচ্ছে। এই কলেজে যে মেয়েরা পড়ছে, তারা কিন্তু সবাই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। যারা জড়িত তারাও সবাই পেশীশক্তির প্রভাব খাটায় না। এই কলেজে পড়ুয়া ছাত্রীরা সবাই আমাদেরই সন্তান, বোন, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু। কাজেই এদের সম্পর্কে মানুষ এতো জঘন্য অভিযোগ করতে পারছে কিভাবে?
আগেও বলেছি ইডেন মহিলা কলেজ প্রাচীন কলেজগুলোর একটি। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৭৩ সালে। এটি তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বা বাংলা প্রদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য প্রথম মহিলা কলেজ। ১৯৬৩ সালে ইডেন কলেজ হিসেবে বর্তমান ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয়। এই কলেজে অনেক মহীয়সী নারী পড়াশোনা করেছেন। এরমধ্যে আছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইডেন কলেজে ছাত্র রাজনীতি বরাবরই ছিল, ছিল হোস্টেলে সিট পাওয়া নিয়ে গোলযোগ, বড়দের একাধিপত্য, দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন, সংগ্রামও ছিল। এছাড়া ইডেনের ছাত্রীরা স্বাধীনচেতা, বাগ্মী, ক্লাস বাদ দিয়ে ঘুরতে বের হয় -- এইসব অভিযোগ অনেক পুরানো।
আমরা যারা সেই ৮২/৮৪ সালে এই কলেজে একাদশ/দ্বাদশ ক্লাসে পড়াশোনা করেছি, তারা জানি কলেজের দিনগুলোতে আমরা কতটা স্বাধীনতা ভোগ করেছি, কতটা আনন্দ করেছি। স্কুলের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলেজে ঢোকার পর অপার স্বাধীনতা ভোগ করেছি এই কলেজে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে এইসব অত্যাচার ও হয়রানি সাধারণ ছাত্রীদের ভোগ করতে হয়নি কখনো।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি যখন গোলযোগপূর্ণ রূপ নিতে শুরু করলো, ইডেনের ছাত্রী সংগঠনও একটি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হিসেবে তার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়লো। শুধু এইবারই নয়, আমরা এর আগেও ইডেনের ছাত্রীদের দলীয় কোন্দল, মারামারি, ভাগ-বাটোয়ারার সংবাদ দেখতে পেয়েছি। তবে গত কয়েক দিনে কলেজ ক্যাম্পাস ও ছাত্রীনিবাসে যে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা ভয়াবহ। যদিও এই ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে; কিন্তু এরমধ্যে সাধরণ ছাত্রীদের অবস্থা দুর্বিসহ হয়ে উঠছে।
ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের নেত্রীদের বিরুদ্ধে অশোভন কাজে সাধারণ ছাত্রীদের যুক্ত হতে বাধ্য করানোর অভিযোগ উঠেছে। গত আগস্টেও নির্যাতনের সময় ২ শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ভাইরাল করার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সভানেত্রীর বিরুদ্ধে। 'এক পায়ে পাড়া দিমু, আরেক পা টাইনা ছিঁড়ে ফেলবো' এই কথার অডিও রেকর্ড ফাঁস করার অভিযোগ তুলে ইডেন কলেজের ২ শিক্ষার্থীকে সাড়ে ৬ ঘণ্টা রুমে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। রাজিয়া বেগম ছাত্রী নিবাসের একটি কক্ষে তাদেরকে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়। পরে হলের প্রাধ্যক্ষ তাদের উদ্ধার করেন।
এই ভয়াবহ অপরাধগুলো কলেজ কর্তৃপক্ষ ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কি জানতেন না? যখন জেনেছেন, তখন কতোটা কঠোরভাবে দমণ করতে পারছেন? অথবা পারবেন? এ দায় তো তারা এড়াতে পারেন না। ইডেন কলেজের শিক্ষকদের ভূমিকাটা কী? তারা কি ছাত্র সংগঠনের হাতে বন্দী? অথচ তাদেরইতো অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করার কথা, তারাইতো হলে মেয়েদের নিরাপদে রাখবেন। হলের সাধারণ মেয়েরা যখন মানুষের কাছে নিগৃহীত হচ্ছে, কই তখন তো শিক্ষকদের দেখছি না ঢাল হয়ে সাধারণ ছাত্রীদের পাশে দাঁড়াতে।
এদিকে সিট-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, চাপ দিয়ে অনৈতিক কাজ করানোর মতো ভয়াবহ কাজকে 'মেয়েদের ভুল' এবং 'কাউন্সেলিংয়ে' সমাধান হবে বলে মনে করছেন ইডেনের অধ্যক্ষ সুপ্রিয়া ভট্টাচার্য। এক সাক্ষাৎকারে উনি বলেছেন, 'আমরা সবাই কিন্তু সব কাজ ঠিক করি না। আমাদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা আছে।' অধ্যক্ষ কি মনে করেন এইসব অপরাধ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ঠিক হবে? নাকি হওয়া সম্ভব? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কলেজটির প্রশাসন এতটাই দুর্বল যে, বহুদিন ধরে চলে আসা কলেজে এই ভয়াবহ অপরাধকে তারা নিতান্ত 'হালকা বেঠিক কাজ' বলে মনে করছেন। তাদের এই মনে হওয়ার দায় বহন করছে কলেজের ৪০ হাজার ছাত্রী।
সাধারণ ছাত্রীদের মূল কষ্টটা এই 'অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে বাধ্য করানোর' অভিযোগকে কেন্দ্র করে। কারণ এখন সবাই মনে করছেন ইডেনের মেয়েদের সবাইকে বুঝি এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করানো হয়েছে। আমার পরিচিত একটি মেয়ে ইডেনে অনার্স করছে, সে বললো, তার মা নাকি ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছেন যে কেউ কি তাকেও এই কাজে জোর করেছে কিনা? মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বললো 'আপা, আম্মাকে আমি কীভাবে বুঝাই যে এই ঘটনা আমার সাথে বা আমাদের কারো সাথেই ঘটেনি। আমরা জানিও না কার সাথে ঘটেছে'।
আমাদের দেশে এমনিতেই নারীর বিরুদ্ধে কটুক্তি, মন্তব্য ও আচরণ করা হয়, যা খুবই নিম্নমানের। কোনো কারণ ছাড়াই নারীকে হেয় করা হয়। সেখানে ইডেন কলেছের রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা ও ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে পরস্পরবিরোধী নোংরা অভিযোগ ইডেনের সাধারণ মেয়েদের বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
এর আগে আমরা দেখেছি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন চলার সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি শাবিপ্রবির উপাচার্য যে 'কটুক্তি' করেছেন, তা ছিল অরুচিকর ও মানহানিকর। ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক হয়ে তিনি যখন এ ধরনের মানহানিকর কথা বলতে পারেন, তখন সাধারণ মানুষ ছাত্রীদের বিরুদ্ধে কতটা বাজে অভিযোগ করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
উপাচার্য যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা শুধু জাবির নয়, সকল নারীর মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। এমন কথাও বলেছিলেন এই আচরণের জন্য জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। এরপর যে ইডেনের মেয়েদের নিয়ে এধরনের বিরুপ মন্তব্য হবে না, তাই বা বলি কেমন করে?
আমরা যদি এখন আমাদের সমাজের দিকে চোখ রাখি, দেখবো সেখানে নারীবিদ্বেষী মনোভাব দানা বেঁধেছে। দেশের নানাধরনের সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে একটি গোষ্ঠী শুধু নারী, নারীর চলাফরা ও নারীর পোশাককে দায়ী করে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলো বা তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোর বা ছাত্র সংগঠনগুলোর পুরুষ শাখায় এধরনের মারামারি, হাতাহাতি, হামলা, মামলা, খুনখারাবি চলতেই থাকে। কই তখনতো সাধারণ ছাত্রদের চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে না? বরং সাধারণ ছাত্ররা বেশ পজিটিভ রেসপন্সই পান মানুষের কাছ থেকে। তাহলে সাধারণ ছাত্রীদের প্রতি এই অন্যায় আচরণ কেন? কেন আজেবাজে মন্তব্য শুনতে হচ্ছে?
যেহেতু আমাদের সমাজের শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মনে করে যেসব মেয়েরা রাজনীতি করে, মিছিল করে, প্রকাশ্যে দাবী-দাওয়া তুলে ধরে তারা ভালো মেয়ে নয়। নারীর এই 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ সমাজে অনাকাঙ্খিত, কারণ সেটা অন্য ছেলে-মেয়েদের নষ্ট করে ফেলবে। তাই 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ যারা করে, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখার জন্য, সেইসব মেয়েদের হেয় করা, মারধর করা, মন্দ বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা 'সমাজের জন্য উপকারী'। এইসব ভ্রান্ত ধারণা থেকেই অসংখ্য নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ইডেনের সাধারণ মেয়েদের অপমান করাটাও সেই নির্যাতনেরই অংশ।
যাক আবার ছাত্র আন্দোলন প্রশ্নে ফিরে আসি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে আমরা দেখেছি ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র আন্দোলন কতটা শক্তিশালী ও সক্রিয় ছিল। কিন্তু এরপরেও পরিবেশটা সহনীয় ছিল শুধু এইজন্য যে, ছাত্র আন্দোলনগুলো তখন লক্ষ্যচ্যুত ছিল না। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য, টাকা-পয়সা ভাগ বাটোয়ারার বা টেন্ডার পাওয়া উদ্দেশ্য ছিল না। খামোখা বিভিন্ন দলের ছাত্র সংগঠনের মধ্যে কোন হানাহানি ছিল না। আর তাই সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা সবাই এই আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষেই ছিল।
এখন যদি প্রশ্ন করি ছাত্র রাজনীতি করে গত ২৫/৩০ বছরে এদেশের ছাত্রছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের কী এমন লাভ হয়েছে? হানাহানি, মারামারি, হেলমেট পার্টি তৈরি করা, চাঁদাবাজি করা, টেন্ডার ব্যবসা, সেশন জট তৈরি করা ছাড়া কোন সুস্থ ছাত্র রাজনীতিতো দেখছি না। এই একই কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাত্র রাজনীতি চালু হওয়া নিয়ে ভয় পাচ্ছে।
সত্যি কথা বলতে ছাত্র রাজনীতির সুস্থ চর্চা কিন্তু হারিয়ে গেছে, যেটা আছে, সেটা হলো ক্ষমতা প্রদর্শন। ছাত্ররাজনীতি মানে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের মঙ্গলের জন্য কাজ করার রাজনীতি। শিক্ষায় বরাদ্দ, শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কোনো কথা হয় না, কোন দাবী দাওয়া নেই। সেগুলো নিয়ে ছাত্রনেতাদের কোনো মাথাব্যথাও নেই। সেই একই ধারাবাহিকতায় ইডেন কলেজে যা হচ্ছে, তা ছাত্র রাজনীতি নয়, সেটা অপরাধ ও অন্যায়। দয়া করে এই অপরাধের দায় ইডেনের সাধারণ ছাত্রীদের উপর চাপাবেন না।
- লেখক: সিনিয়র প্রশিক্ষক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন