ইরান: ‘নাতারশিন, নাতারশিন আমার প্রতিবাদের ভাষা’
ধর্মীয় পরিচয়ে জন্মসূত্রেই মুসলিম হলেও নৃ-ভাষিক পরিচয়ে 'কূর্দি' মাহসা আমিনীর মাতৃভাষায় রাখা নামটি ছিল 'জিনা' আমিনী। ফার্সি ভাষাধিপত্যের ইরানে কূর্দিদের 'আনুষ্ঠানিক' নাম রাখতে হয় 'ফার্সি' ভাষায়।
ইরানের কুর্দিস্থানে প্রদেশের সাকেজ শহর থেকে তেহরানে আত্মীয় বাড়ি বেড়াতে এসে ছোট ভাইয়ের সাথে রাজধানী শহর ঘুরতে বের হওয়া বছর বাইশের মেয়েটিকে কালো বোরখা এবং কালো হিজাব পরা সত্ত্বেও তেহরানের শহীদ হাঘানি এক্সপ্রেসওয়েতে ঢোকার মুখে 'হিজাব' ঠিকঠাক মত পরা হয়নি এবং কপালের দিকে কিছু চুল দেখার অভিযোগে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়।
সে সময় ইরানের 'নৈতিক পুলিশ' বোধ করি ভাবতেও পারেনি যে কি থেকে কি হতে যাচ্ছে! তার ছোট ভাই কিয়ারেশ (আশকান) আমিনীকে বলা হয় যে ডিটেনশন সেন্টারে এক ঘণ্টার একটি ক্লাসে পোশাক ও নৈতিকতা সম্পর্কে উপদেশ দেবার পর মাহসাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। থানায় দু'ঘন্টা অপেক্ষা করার পর কিয়ারেশ জানতে পায় যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় তার বোনকে এ্যাম্বুলেন্সে করে কাসরা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
মাহসার সাথে একই প্রিজন ভ্যানে বন্দী একাধিক তরুণী মৃত মেয়েটির তুতো ভাই ইরফান মোর্তাজেয়িকে জানায় যে ভ্যানে গালাগালি ও অপমানের প্রতিবাদ করায় মাহসাকে প্রচন্ড ভাবে পেটানোর প্রেক্ষিতে থানায় নিতে না নিতেই সে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়, এ্যাম্বুলেন্স আসতে আধা ঘন্টা লাগে এবং কাসরা হাসপাতালে নিয়ে যেতে আরো দেড় ঘন্টা লাগে।
কাসরা হাসপাতালে দু'দিন কোমায় থাকার পর ১৬ সেপ্টেম্বর ঐ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগে তাঁর মৃত্যু হয়। সেরিব্রাল হেমারেজে মাহসার মৃত্যুর পরপরই নারী-পুরুষ, কুর্দি-পারসিক নির্বিশেষে শত শত বিক্ষোভকারী হাসপাতালের সামনে এসে 'স্বৈরশাহীর পতন হোক' শ্লোগান দিতে শুরু করে। 'জান, জিন্দেগি, আজাদি' বা 'নারী,জীবন, স্বাধীনতা!' শ্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ইরানের নারী সমাজ।
কারসা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ইনস্টাগ্রামে মেয়েটিকে ব্রেইন-ডেড অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল বলা হলেও পরবর্তীতে সরকারী আদেশে সেই ইনস্টাগ্রাম মেসেজ মুছে ফেলা হয়। জলকামান বা পিপার স্প্রে ছুঁড়ে বিক্ষোভকারীদের তছনছ করার চেষ্টা করলেও গোটা ইরানের সব শহরে বিক্ষোভের দাবানল ক্রমাগত ছড়িয়ে যেতে থাকে এবং এখনও সেই আগুন স্তিমিত হয়নি।
কুর্দি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি মতে মাহসার পরিবারকে ইরানী সরকার শেষকৃত্যের যথাযথ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তাঁদের কন্যাকে সমাধিস্থ করতে বাধ্য করে। মাহাশার ভাই কিয়ারেশ বোনের মাথা ও পায়ে আঘাতের দাগ দেখতে পান ও মেয়েটির মাথার খুলি ভেঙ্গে যাওয়াসহ কান থেকে রক্তপাত ও চোখের নিচে গভীর ক্ষতের চিহ্ন দেখা যায়।
ইরানী সরকার মেয়েটি হৃদযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছিল দাবি করলেও তেহরান, রাশত, ইস্পাহান, কারাজ, মাশহাদ, সানান্দাজ, সাকেজ, ইলাম, সারি, কোম, কেরমান, হামেদান ও কিশ সহ রাষ্ট্রটির সব শহরে ছড়িয়ে পড়ছে বিক্ষোভ। ২৩শে সেপ্টেম্বর নাগাদ কোন পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যম নয়, খোদ 'আল-এ্যারাবিয়া' সংবাদ মাধ্যমের সূত্রেই জানা যাচ্ছে যে অন্তত: ৫০ জন ইরানী নর-নারী সারা দেশে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে নিহত হয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার রাতেই ইরানের উত্তর গিলানের রেজভানশহর এবং বাবোল ও আমল শহরে ছয় জন নিহত হয়। এবং রোববার রাতেই ইরান জুড়ে আরো পাঁচ জন তরুণ ও পাঁচ তরুণীর মৃত্যু হয়। এদের ভেতর জাতীয় পুরুষ ভলিবল দলের খেলোয়াড় থেকে শিশু সন্তানের মা-ও আছেন। এই লেখা সময় ইরানে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৬ জন। তবে ইরানী জনগণের অভিযোগ যে মৃত্যুর সংখ্যা ২০০ ছুঁয়েছে।
ইতোমধ্যে ইরান সরকার হোয়াটসএ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটার সহ যাবতীয় সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দিলেও মার্কিনী উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক তাঁর 'স্টার লিঙ্কস'-এর মাধ্যমে ইরানের মানুষকে সামাজিক মাধ্যমের সুযোগ পাইয়ে দেবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারও ইলনকে সেই কাজে সহায়তা দেবার লক্ষ্যে ইরানে এতদিন ধরে অন্তর্জালের অবাধ ব্যবহারে যে কঠোরতা জারি রেখেছিল তা' সহজ করে দিচ্ছে। তবে, আল-জাজিরায় প্রকাশিত মানজিয়ার মোতামেদির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে ইরানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের লৌহ মুষ্টি শাসনে ইরানের সাধারণ মানুষ 'ভিপিএন' নেটওয়ার্কের সুবিধাও নিতে পারছেন না।
'নাতারশিন, নাতারশিন': আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন...
ইরানে যদি দ্রুতই গোটা অন্তর্জাল ব্যবস্থা বিলুপ্তও হয়ে যায়, তবু ইতোমধ্যেই সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ মাহশা আমিনীর কবরের সামনে তাঁর মায়ের হৃদয় বিদারক কান্না, বিক্ষুব্ধ ইরানী নারীদের মাথার স্কার্ফ খুলে খোদ তেহরানের রাস্তায়
বিক্ষাভ মিছিল করা, পুলিশের দিকে তেড়ে যাওয়া, কুর্দি ভাষায় প্রতিবাদ সঙ্গীত গীত হওয়া, অসংখ্য ইরানী নারীর মাথার হিজাব পোড়ানোসহ চুল কেটে ফেলা বা এমনকি মাহশার কবরে গোলাপের পাাশাপাশি মেয়েদের কর্তিত কেশগুচ্ছ নিবেদন, বিক্ষোভকারীদের প্রতি রাষ্ট্রীয় পুলিশের জলকামানের ব্যবহার সহ অসংখ্য মিছিলের ছবি দেখে ফেলেছেন।
'নাতারশিন, নাতারশিন! মা হামেহ বাহাম হাসতিম (ভয় পেও না, ভয় পেও না! আমরা সবাই একসাথে!) অথবা 'মিকোশাম, মিকোশাম, হর আঙ্কেহ খাহারাম কোশত (আমার বোনকে মেরেছে যে, আমি মারব তাকে!)' জাতীয় শ্লোগানে মুখরিত আজ ইরানের রাজপথ ('দ্য ফিউটিলিটি অফ অপ্রেসন ইন ইরান, নূরা শামসী বাহার, দ্য ডেইলি স্টার, ২৩/০৯/২০২২- অনুবাদ, নিবন্ধ লেখক)।
সামান্য চুলের জন্য এই একুশ শতকেও এত দমন-পীড়ন, এক মাহশা থেকে ন্যূনতম ৭৬ জনের মৃত্যুতে শোক-সন্তপ্ত ইরানী মেয়েরা এখন কেটে ফেলছেন খোদ সেই চুলকেই। 'আভা' নামের অনেকটাই যেন বাংলা বা সংস্কৃতায়িত নামের এক ইরানী তরুণী বলছেন (সংস্কৃত ও ফার্সি যে একই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-গোষ্ঠির দুই সহোদররা ভাষা তা' মনে পড়ে যাচ্ছে বিক্ষোভকারীদের ভেতর 'আভা' বা 'বিভা' নামের মেয়েদের দেখে): 'মুজগানকে গ্রেপ্তার করার পর ওর পক্ষে ফেরেশতা কথা বলেছে। এরপর ফিরশতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ফিরশতাকে গ্রেপ্তারের পর আমি ওর পক্ষে কথা বলছি। আমাকে গ্রেপ্তার করা হলে আমার সমর্থনে অন্য কেউ কথা বলবে।'
'নিউইয়র্ক টাইমস'-এ প্রকাশিত ভিভিয়ান ই ও ফারনাজ ফাসিহি-র একটি যৌথ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে মাহসার বিষয়টি ইরানী মেয়েদের এত বেশি ক্রুদ্ধ করে তুলেছে একারণে যে সবারই মনে হচ্ছে যে 'এমন ত' আমার সাথেও ঘটতে পারতো!' ইয়াসী নামের কুড়ি বছরের এক তরুণী জানান যে কিভাবে এই ঘটনা শোনার পর তিনি প্রতিবাদ সমাবেশে ছুটে গিয়ে নিজের মাথায় জড়ানো পাতলা শাল প্রথমবারের মত খুলে ফেলেন, 'এমনটা আমার বান্ধবী বা তুতো বোনদের সাথেও হতে পারতে।
'ইয়াসির মা মিনু বলেন, 'আমি ধার্মিক তবে যেভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাধররা সাধারণ মানুষের সাথে আবর্জনার মত ব্যবহার করে, সেই ভন্ডামি দেখে আমি অতিষ্ঠ।'নাহিদ নামের এক ৬৫ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত নারী ব্যঙ্ক কর্মকর্তা প্রতি রাতে এই বিক্ষোভকারীদের জন্য স্যান্ডউইচ বানান, ফার্স্ট-এইড ব্যাগ সরবরাহ করেন। অনেক বয়সী নারীই তরুণীদের রাতে ঘুমানোর জন্য বাসায় আশ্রয় এবং খাবার-পানীয় দিচ্ছেন।
আগুনে স্কার্ফ ছুঁড়ে ফেলে, মাথা ন্যাড়া করে কাঁদতে কাঁদতে এই তরুণীরা মূর্ত করছেন এক দুঃসাধ্য বিপ্লব। নীলুফার হামিদি নামের যে নারী সাংবাদিক প্রথম ফারসি দৈনিক 'শারঘ'-এ এই খবরটি প্রকাশ করেন তিনি গত সপ্তাহে ইরানের কুখ্যাত জেল ইভিনে নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দী হয়েছেন। 'আজ ইরানের প্রতিটি তরুণী ক্ষুব্ধ' বলে জানান ইস্পাহান শহরের ২৮ বছর বয়সী নারী গুলশান।
মাহসার মৃত্যুর পর প্রথম রাতে গুলশান এবং আরো ৫০ জন নারী শহরের একটি মূল সড়ক অবরোধ করেন এবং পুরুষদেরও তাদের মিছিলে যোগ দিতে ডাক দেন। একজন পুরুষ একটি বড় অগ্নিকুন্ড জ¦ালিয়ে দিলে মেয়েরা সেখানে তাঁদের 'হিজাব' ছুঁড়ে মারেন। মরিয়ম নামের উত্তরের মাঞ্জাদারান প্রদেশের এক নারী চিত্রশিল্পী ও তাঁর বান্ধবীরা প্রতিবাদে নেড়া হয়েছেন। তবে এর মূল্যও কম নয়।
ইরানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হাসান রৌহানীর সময়ে অবশ্য তরুণ ইরানীরা কিছু স্বাধীণতা পাচ্ছিলেন। ঢিলে স্কার্ফের নিচে মেয়েদের কেশ কুন্ডলী দেখা যেত। উজ্জ্বলতর মেকআপ ও পোশাকের ঝুল তুলনামূলক হ্রস্ব হচ্ছিল। কালো রঙের প্রাধান্য ছেড়ে মেয়েদের পোশাকে গাঢ় গোলাপী রঙ, সূতো বা এ্যাপ্লিকের কাজ দেখা যাচ্ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মেয়েরা রেস্তোরাঁয় খাবার সময় এবং গাড়িতে চড়ার সময়েও মাথার স্কার্ফ খোলা শুরু করেছিলেন।
'ইরানী মেয়েরা কখনোই রাষ্ট্র আরোপিত হিজাব নীতির সাথে পুরোপুরি একমত হয়নি' বলে জানান বর্তমানে নির্বাসিত ইরাণী নারী অধিকার কর্মী সুসান তাহমাসেবি। তবে হাসান রৌহানির বিদায়ের পর ইব্রাহিম রাইসি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইরানে মেয়েদের প্রতি এবং এমনকি ছেলেদের প্রতিও পোশাক সহ নানা বিষয়ে কঠোর নীতিমালা আরোপিত হতে শুরু করে। গেল জুলাইয়ে রাষ্ট্রপতি হিজাব ঠিক ভাবে না পরলে 'দূর্নীতি বাড়বে' বলে হুঁশিয়ারি দেন। মেয়েরা ঠিকঠাক হিজাব না পরলে তাদের সামাজিক ও সরকারী নানা সেবা সুবিধাও দেয়া হবে না বলে সরকার থেকে সতর্ক করা হয়।
এদিকে ইরানী মেয়েদের সমর্থনে জার্মান এক নারীর টপলেস বিক্ষোভ প্রদর্শন বিশ^ জুড়ে অনেক দর্শককেই অবাক করে দিয়েছে। এছাড়াও আরো কতিপয় নারীর এ ধরনের ছবিতে বিষ্মিত হচ্ছে অনেক মানুষ। এটা কি প্রবাসী ইরানী নারীরা করছেন না ইরানী নারীদের সমর্থনে পশ্চিমা নারীরা এমনটা করছেন?
বাংলাদেশে অন্তর্জালে এই নিয়ে মতভেদ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক নর-নারীও ইরান সরকারের নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদে একাত্মতা জানাচ্ছেন। চূড়ান্ত নিষ্পেষণে পিষ্ট ও অবদমিত নারী সত্ত্বার প্রতিবাদ হিসেবেই দেখা হচ্ছে সবরকম প্রতিবাদকে। আসলে পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মের বয়স যদি পাঁচ হাজার বছরও হয়, মানব সমাজের উত্থান ও বিকাশের ইতিহাস তার চেয়েও বহু পুরনো। আজকের আমাদের পোশাক বিধি, বিয়ে ও পরিবার ব্যবস্থা সহ নানা কিছুই হাজার হাজার বছর আগে অনেক ভিন্ন রকম ছিল, হাজার বছরের বাঁকে সেসব অনেক বদলেছে এবং সামনেও আরো বদলাবে। মানব ইতিহাসে অচল-অলঙ্ঘ্য-ধ্রুব বলে কিছু নেই এবং সবকিছুই আসলে নানা ধরণের 'সাংস্কৃতিক নির্মাণ'।
চুল নিয়েই কেন এত কিছু?
ভারত উপমহাদেশে আমরা, মেয়েরা, কৈশোর থেকেই পোশাকবিধি বা শালীনতা সম্পর্কে পরিবার ও সমাজ থেকে নানা উপদেশ পেলেও সত্যি বলতে এক দশক আগেও 'হিজাব' ততটা প্রচলিত ছিল না। সব সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত মায়েরাই শাড়ির আঁচলে বা ঘোমটায় মাথা ঢাকলেও অপেক্ষাকৃত তরুণী মেয়েদের জন্য খোলা চুল খুব নিন্দার্হ কিছু ছিল না। বরং দীর্ঘ চুল বাঙ্গালীর সৌন্দর্য ভাবনায় বরাবরই প্রশংসিত। '
'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার দিশা' পংক্তিটি পড়ে বড় হয়নি এমন বাঙ্গালী খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। বাংলার শ্রেষ্ঠতম সঙ্গীতকার শারদ বা দেশ বন্দনায় লেখেন 'তোমার মুক্ত কেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনী!' 'কপাল কুন্ডলা'-য় বঙ্কিমের কলমে নায়িকার কেশ স্তব বা ইংরেজি কবিতা 'দ্য স্যান্ডস অফ ডী'-র মেরি নামের যে সদ্য তরুণী প্রবল ঝড়ের ভেতর নদী তীর থেকে গবাদি পশু আনতে গিয়ে বন্যায় ভেসে যায় আর মৃত মেয়েটির সোনালী চুলকে চকচকে স্যামন মাছ ভেবে জেলেরা জাল ফেলতে গিয়ে মেরিকে খুঁজে পায়, সেই বেদনা বিধূর কবিতাও ঔপনিবেশিক শিক্ষার সুবাদে আমরা অনেকেই পড়েছি। চুল কিন্তÍ নারীর শরীরের কোন সরাসরি অংশ নয়। বৈজ্ঞানীক দৃষ্টিতে দেখলে 'চুল' নিছকই শরীরের মৃত কোষ।
তবু নারীর উন্মুক্ত চুল তার সৌন্দর্য বর্দ্ধন করে বলেই কি পৃথিবীর কোন কোন ধর্ম বা সভ্যতায় মেয়েদের চুল নিয়ে বেশ কড়াকড়ি? ব্রিটিশের জেলে বসে কন্যা ইন্দিরাকে চিঠির আকারে লেখা পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরুর 'দ্য গ্লিম্পসেস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি' থেকে প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে আজকের এই যে কালো বোরখা এটা দীর্ঘ আরব-পারস্য যুদ্ধের সময় আরব সৈনিকেরা পারস্যে গিয়ে সেখানকার ধনাঢ্য রাজকীয় বা সামন্ত পরিবারের নারীদের ভেতর ব্যবহার করতে দেখেন এবং স্বদেশে বহন করে নিয়ে আসেন।
ইতিহাসের একটা মুশকিল হচ্ছে হাজার বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কোন বইকেই বলা যায় না একশ ভাগ সঠিক। তবে মূলত: রাশিদুন খিলাফতের সময়ে (৬৩৩-৬৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) আরব-ইরানের যুদ্ধে ইতোপূর্বে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ও গ্রিকদের সাথে দশকের পর দশক নানা যুদ্ধে রণক্লান্ত পারস্য পরাজিত ও ধর্মান্তরিত হলেও বিজয়ী তবে দৈনিন্দন জীবনে কৃচ্ছতায় অভ্যস্ত আরবেরা পারস্যের খাদ্য-পোশাক-নৃত্য-গীত-শিল্পকলা সহ নানা কিছুতে অভিভূত হয়েছিল।
ভারত উপমহাদেশে চুলই যেমন নারীর সবচেয়ে প্রশংসাযোগ্য দিক এবং অনার্য কালী থেকে আর্য দুর্গা পর্যন্ত ভারতের দেবীরা সবাই মুক্তকেশী- 'সেমিটিক' ভূমে কিন্তু নারীর চুলই যেন সবচেয়ে বেশি আবৃত রাখার জিনিস। এমনকি আজো ক্রিশ্চিয়ান নানদেরও মাথা ঢেকে রাখতে হয়। রুশ ধ্রুপদী সাহিত্যের অলঙ্করণে উনিশ শতক বা বিশ শতকের শুরু অব্দি মেয়েদের মাথায় স্কার্ফ দেখা যায়।
ইরানে 'হিজাব' ও পোশাকবিধি প্রশ্নে নারী বনাম রাষ্ট্র: ইসলামী বিপ্লবের আগে ও পরে
১৮৪৮ সালের জুন থেকে জুলাই মাসের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে ইরানের সেমনান প্রদেশে 'বাবি' ('বাহাই' ধর্ম-সম্প্রদায়ের পূর্বসূরীগণ) সম্প্রদায়ভুক্ত এক নারী কবি ও বিপ্লবী ফাতিমিহ বারঘানি তাহিরি সর্বপ্রথম আশি জন পুরুষের সামনে চুল না ঢেকেই একটি আলোচনা সভায় যোগ দেন। ইরানে তখন 'কাজার' রাজবংশের শাসন যারা নারীকে নিরক্ষর, অশিক্ষিত এবং জনদৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে চাইতেন। তাহিরির পিতা ছিলেন ইসলামী শাস্ত্রে সুপন্ডিত এবং মেয়েকে ব্যক্তিগত পাঠাগারের বই দিয়েই তিনি সুশিক্ষিত করে তোলেন। খোলা চুলে বের হবার অপরাধে তাহিরিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হলেও তিনি বলেছিলেন, 'তোমরা আমাকে হত্যা করতে পারো, তবে কখনোই নারীর মুক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। '(দ্য ফিউটিলিটি অফ অপ্রেশন ইন ইরান, নূরা শামসি বাহার- দ্য ডেইলি স্টার, ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০২২)। তাহিরির হত্যার ১৭৪ বছর পরে সেই একই দেশে আর একটি মেয়েকে একই হিজাব প্রশ্নে নিহত হতে হলো।
আন্তর্জাতিক জার্নাল 'সেজ'-এ 'ফ্রিডম এ্যান্ড দ্য ইরানীয়ান ওমেন্স ম্যুভমেন্ট' প্রবন্ধে (জুলাই ২৯, ২০১৯)-এ হোদা মাহমুদী জানাচ্ছেন যে পারস্যে প্রাচীন যুগ থেকেই পর্দা প্রথা ছিল। তবে, ১৫০০ সাল নাগাদ দেশটিতে শরীয়া আইন পাকা-পোক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে পর্দা প্রথা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে ও নারীকে জন পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন করার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
১৯০০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মুসলিম নারীকে ঘরে-বাইরে সর্বত্র পর্দা করতে হলেও অ-মুসলিম সংখ্যালঘু জন-গোষ্ঠি যেমন খ্রিস্টান, ইহুদি, অগ্নি-উপাসক ও বাহাই নারীদের জন্য পর্দা বাধ্যতামূলক ছিল না। হাতের কব্জি থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি নারীর দেহ পুরো আবৃত থাকবে এটাই পর্দার নিয়ম। ১৯৩৬ সালে দেশটির নতুন প্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র নারীদের পর্দা প্রথা বাতিলের জন্য নতুন আদেশ দেন। তবে, পাঁচ বছর পর পুনরায় পর্দা কোন নারী ইচ্ছা হলে করবেন এবং ইচ্ছা না হলে করবেন না এমন বিধি আরোপিত হয়।
এই 'পর্দা করার' বিষয়টি একজন নারীর পিতা, বর অথবা পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরেও নির্ভরশীল ছিল। ইসলামী বিপ্লবের পরই ইরানী নারীদের জীবনে প্রচুর আইনী ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ২০১৫ সালে 'বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম'-এর প্রতিবেদনে জেন্ডার সমতা সূচকে পৃথিবীর নিম্নতম তালিকায় অবস্থানকারী দেশগুলোর ভেতর ইরানের জায়গা হয় এবং ১৪৫টি রাষ্ট্রের ভেতর ইরানের অবস্থান হয় ১৪১ তম।
১৯৯০-এর দশক থেকেই ইরানী নারীর জন্য গ্রহণযোগ্য পোশাক হলো হেডস্কার্ফ এবং দীর্ঘ কোট। এই পোশাকবিধি লঙ্ঘন করলে পুলিশ যে কোন নারীকে গ্রেপ্তার করার অধিকার রাখে। গতানুগতিক শাস্তি সাধারণত: দু'মাসের কয়েদ খাটা এবং পঁচিশ মার্কিনী ডলার জরিমানা। তবে, ঘরের ভেতরে এবং আত্মীয় পুরুষদের সামনে মেয়েরা চুল খোলা রাখতে পারে।
১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে মেয়েদের বিয়ের আইনগত বয়স যেখানে ছিল ১৮, সেটি বিপ্লবের পর প্রথমে ৯ করা হয়। ২০১৩ সালে অবশ্য আইনের খানিকটা সংশোধন করে বিয়ের বয়স ১৩ করা হয়। ১৯৯৭-২০০৫ সাল নাগাদ ইরানের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ১৩ জন নারীর এক সংসদীয় কমিটির প্রচেষ্টায় এই সংশোধন সম্ভব হয়। এই নারীরা ইরানের মোট সাংসদদের মাত্র ৫ শতাংশ। তবে, এত প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও ইরানী মেয়েরা শিক্ষায় অধিকতর আগ্রহী হতে থাকে এবং শিক্ষার মাধ্যমে তাদের জীবন পাল্টানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে।
ইরানে নারীশিক্ষার হার বাড়তে থাকার সাথে সাথে বর্তমানে মেয়েদের প্রথম বিয়ের বয়স সাধারণত: কুড়ির কোঠায় হয়ে থাকে। ২০০৩-০৪ সাল নাগাদ মেয়েরা ইরানের মোট সম্মান ডিগ্রির ৫০ শতাংশ অর্জন করে, স্নাতকোত্তর ডিগ্রির ২৭ শতাংশ অর্জন করে এবং পিএইচডি ডিগ্রির ২৪ শতাংশ অর্জন করে।
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পরে আদালতে মেয়েদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ বাতিল করা হয় এবং বিপ্লবের আগে নিযুক্ত নারী বিচারকদেরও চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। মেয়েরা প্রকাশ্য খেলাধুলায় অংশ নিতে পারেনা। কর্মক্ষেত্রে কর্মদাতার জেন্ডার বৈষম্য প্রশ্নে মেয়েদের কোন আইনী নিরাপত্তা নেই। পুরুষ অভিভাবকের লিখিত অনুমতি ছাড়া কোন নারী ভ্রমণ করতে বা এমনকি একটি পাসপোর্ট অর্জনেও সক্ষম নন। শ্রমবাজার বা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণে নারীর শতাংশ হার ২০০৬ সালে ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ১৭ শতাংশ। ২০১১ সালে তাদের বেকারত্বের হার ছিল ২৮ শতাংশ যা ছেলেদের বেকারত্ব হারের চেয়ে দ্বিগুণ।
উপরোক্ত পরিসংখ্যানসূচক সংখ্যাগুলো ছাড়াও কঠোর পর্দাপ্রথা নারীর জীবনে গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। নারীকে জনপরিসরে অদৃশ্য, তুচ্ছ ও অনুপস্থিত করে তোলে। কোন নারী এই আইন ভাঙতে গেলেই তাঁর জীবন বিপদের মুখে পড়ে যেমনটা পড়েছিলেন মধ্য-উনিশ শতকের নারী কবি তাহিরি বা কুররাতুল-আইনের ক্ষেত্রে (১৮১৭-১৮৫২)।
ইসলামী শাস্ত্রে পন্ডিত বাবার কাছে ফার্সি ও আরবি সাহিত্য, আইন ও ধর্মতত্ত্ব পড়া তাহিরি ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে জনপরিসরেও তাঁর প্রজ্ঞাকে প্রতিষ্ঠা করা ও নারী হয়েও চিন্তা করা ও লিখতে পারার যোগ্যতা সমাজের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন।
গত ৪০ বছর ধরে ইরানের মেয়েরা তাঁদের কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সাথে লড়াই করছে। প্রয়াত আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদী দীর্ঘ লড়াই করেছেন। ২০০৬ সালের ১২ই জুন তেহরাণের প্রধান গণ চত্বরে প্রচুর ইরানী নর-নারী 'কেন আমরা বিদ্যমান আইনগুলোকে ন্যায়পর মনে করিন'' শিরোনামের লিফলেট বিলি করার সময় হেলমেট পরা পুরুষ ও মহিলা পুলিশেরা এই প্রতিবাদীদের উপর চড়াও হয়। এর পরপরই নামী নারী সাংবাদিক নৌশিন আহমেদ খোরাসানী ও পারভিন আর্দালান শিরিন এবাদীর সাথে দেখা করেন এবং নারীর প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আইনের প্রতিবাদে 'দশ লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ' অভিযান শুরু করেন।
এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল বিয়ে, উত্তরাধিকার, অপরাধ আইন ও বিয়ে বিচ্ছেদে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা। ধার্মিক ও ধর্মনিরপেক্ষ, তরুণ ও বৃদ্ধ, গ্রামীণ ও শহুরে, ধনী ও দরিদ্র নির্বিশেষে সমাজের সব স্তরের নারী পাঁচ বছর ধরে এই আন্দোলনে থাকেন। আন্দোলনের দুই মূল নেত্রী আর্দালান ও খোরাসানী তিন বছরের কারাদন্ড ভোগ করেন।
তবে, এই আন্দোলনের ফলে মেয়েরা তাঁদের স্বামীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হবার অধিকার অর্জন করেন এবং সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীরা পুরুষদের মতই সমান অঙ্কের 'রক্ত অর্থ' আদায়ের অধিকারও পান। ইরানী সংসদ এই দাবিগুলো অনুমোদন করে। ইরানী সংসদ বাধ্য হয় 'পারিবারিক নিরাপত্তা আইন' পাশ করতে। আগের আইনের আওতায় মেয়েদেরকে বিয়ের দেনমোহরের অর্থ থেকে কর প্রদান করতে হতো এবং প্রথম স্ত্রীর অনুমোদন ছাড়াই কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করতে পারতেন।
২০১৭ সালের ১৭ই ডিসেম্বর আর এক সাহসী ইরানি নারী বিভা মোভাহেদ তেহরানের ব্যস্ততম সড়কগুলোর অন্যতম 'ইনকিলাব (বিপ্লব) সড়কের মাথায় তাঁর মাথার সাদা হিজাব খুলে বাতাসে উড়িয়ে দেন। সেই থেকে 'গার্লস অফ রেভল্যুশন স্ট্রিট' নামে একটি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ইরানী বংশোদ্ভুত মার্কিনী নারী সাংবাদিক মাসিহ আলিয়েনেজাদের ফেসবুক পেজ 'মাই স্টিলদি ফ্রিডম'-এ বহু ইরানী নারীই তাঁদের অবগুণ্ঠন মুক্ত কেশদামের ছবি পোস্ট করে থাকেন।
২০১১ সালে ইরানী পুলিশ নাসরীন সোতৌদেহ নামে এক নারী আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করে ছ'বছর কারাদন্ড দেয়। বাধ্যতামূলক হিজাবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০১৯ সাল অবধি ৩৫ জন নারী আক্রান্ত হন। নার্গিস হোসেইনী নামের আর এক নারী দু'বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হন। মাহবাশ সাবেত সহ আরো ছয় জন ইরানী নারী তেহরানে 'দ্য মিনিস্ট্রি অফ ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড ন্যাশনাল সিক্যুরিটি' কর্তৃক গ্রেপ্তার হন।
সাবেত বাহাই ধর্মানুসারী হওয়াতে এক যুগ ১৩ গুণীতক ষাট ফুটের এক কারা সেলে বন্দী থাকতে হয়। ইরানে বাহাইদের এমনকি খ্রিস্টান, ইহুদি বা অগ্নি-উপাসকদের যেটুকু অধিকার আছে তা-ও নেই। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরানের সুপ্রীম রেভল্যুশনারী কাউন্সিলের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনীর স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বাহাইদের উপর অব্যাহত নির্যাতনের রাষ্ট্রীয় নীতি অক্ষুন্ন থাকবে বলে বলা হয়। বাহাইরা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয় এমনকি স্কুলেও ভর্তি হতে পারবে না বা চাকরি পাবে না বলে বলা হয়। এটা অনেকটা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রতি গৃহীত নীতির অনুরূপ।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইরাণে মোট ৪০,০০০ অন্তর্জাল ব্যবহারকারীর উপর পরিচালিত এক সমীক্ষার ভিত্তিতে 'দ্য কনভার্সেশন' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ইসলামী বিপ্লবের পূর্বে শাহের ইরানে নারী ও সংখ্যালঘুদের অনেক বেশি নিরাপত্তা ও অর্জনের পরও দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রের কারণে ক্ষুব্ধ ও হতাশ মানুষ যেমন প্রবল ভাবে ধার্মিক হয়ে উঠেছিল, সেই একই ইরানের মানুষেরা গত ৪২ বছর ধরে একটি মাত্র ধর্মতান্ত্রিক একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় থেকে ফিরে যেন 'ধর্মনিরপেক্ষ' হয়ে উঠছে।
'দ্য কনভার্সেশন' পত্রিকার সমীক্ষা কতটুকু নির্ভরযোগ্য সে নিয়ে কারো মনে প্রশ্ন থাকলেও পত্রিকাটির প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ভাবে জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম বলা হলেও শিয়াজন-গোষ্ঠি অধ্যূষিত এই দেশে মাত্র ৩২ ভাগ মানুষ নিজেকে শিয়া, ৫ শতাংশ নিজেকে সুন্নী এবং ৩ শতাংশ নিজেকে সুফী মুসলিম দাবি করেন। প্রায় ৯ শতাংশ মানুষ নিজেকে নাস্তিক, ১ শতাংশ মানুষ নিজেকে খ্রিষ্টান ও ৭ শতাংশ মানুষ নিজেকে 'আধ্যাত্মিক' ও ৮ শতাংশ মানুষ নিজেকে অগ্নি-উপাসক দাবি করেন যা আসলে পারসিক জাতীয়তাবাদের সুপ্ত বহিঃপ্রকাশ।
আল-জাজিরায় প্রকাশিত এক সংবাদ অনুযায়ী যদিও গত শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর ইরান সরকার স্ব-পক্ষের সমর্থকদের বিশাল সমাবেশ আয়োজন করেছে তবু খোদ রাষ্ট্র প্রধান ইব্রাহিম রাইসিকে মাহসার বাবার কাছে ফোন করে দু:খ প্রকাশ করতে হয়েছে। তবু ইরানের বিশেষত উত্তরাঞ্চলের কূর্দি অধ্যূষিত এলাকাগুলোয় বিক্ষোভ সহজে কমছে না।
তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান ও ইরাকে ছড়িয়ে থাকা কূর্দিরা মুসলিম হলেও এই চারটি দেশেই ভাষাগত সংখ্যালঘুত্বের কারণে গত কয়েক শতাব্দী ধরে নির্যাতিত। ইরানের সরকার কুর্দিদের স্বাধীনতাকামী বামপন্থী কোমালা দলকে 'সন্ত্রাসবাদী' দল হিসেবে বিবেচনা করে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম গত কয়েকদিনে কোমালা এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ ইরানীয়ান কুর্দিস্থানের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে বলে দাবি করে।
ইরানি অভিনেতা ওমিদ জালিলি চলমান এই আন্দোলনকে 'জর্জ ফ্লয়েড আন্দোলনে'র সাথে তুলনা করেছেন, বিশ্বখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্রকার আসগর ফারহাদী ইরানের সাহসী মেয়েদের জানিয়েছেন সাধুবাদ।