ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত কতটা পোড়াচ্ছে বাকি বিশ্বকে?
'রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়'- বাংলা প্রবাদটি বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
ইউক্রেনের পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদানের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে যেই সামরিক আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া, তার ফল শুধু ইউরোপ নয়, ভোগ করছে পুরো বিশ্ব। ইউক্রেনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাবিশ্ব পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। সেইসঙ্গে, ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রচুর সামরিক সহায়তাও দিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে মস্কো। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় যুদ্ধ বা সংঘাত অথবা অবরোধের প্রভাব শুধু দুই দেশ, পক্ষ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রভাবিত হয় সমগ্র বিশ্বের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা।
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা যখন এমনিতেই নাজুক, তখন পশ্চিমা অবরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের অন্যতম জ্বালানি সরবরাহক রাশিয়া গ্যাস-তেলের সাপ্লাই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে ইউরোপে। সস্তায় কিছুদিন ভারত-চীনকে জ্বালানি দিয়েছে দেশটি। আর ইউরোপীয় দেশগুলো এখন জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় ছুটছে চড়া দামের এলপিজি'র পিছনে। এতে বিশ্ব জ্বালানি বাজার হয়ে পড়েছে অস্থিতিশীল।
দুই দেশের সংঘাতের কারণে শরনার্থী হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। খাদ্য, সার, জ্বালানিসহ নানান সংকট দানা বেধে উঠেছে বিশ্বজুড়ে। কোনো কোনো দেশে মুদ্রাস্ফীতি একলাফে হয়েছে দ্বিগুণ। আর এসব সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো তৃতীয় বিশ্বের নিরীহ সাধারণ জনগণ।
রাশিয়া ও ইউক্রেনে উৎপাদিত গমে বিশ্ব চাহিদার ৩০ শতাংশ পূর্ণ হয়। দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর অবরোধ করে রাখেছে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো ইউক্রেনের গমের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এ অঞ্চলের, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। জাতিসংঘের শনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, তারা বাস্তুচ্যুতদের খাবারের বাজেট কমিয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। যদি এ অবস্থার দ্রুতই উন্নতি না হয়, তবে এই বাজেট আরও কমাতে বাধ্য হবে সংস্থাটি।
খাদ্য সংকটের প্রভাবে আফ্রিকায় শুরু হয়েছে 'রুটি আন্দোলন'। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কেবল ইউক্রেনের বন্দরে ১৫ কোটি টন গম আটকে আছে, যা বিশ্বের মোট গম বাণিজ্যের কমপক্ষে ১০ শতাংশ। এ অবস্থায় ভারতের মত ২৩ টি দেশ নিজেদের চাহিদার কথা চিন্তা করে বিদেশে গম রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) গত জুনের তথ্য মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আফ্রিকার প্রায় দুই কোটি মানুষ খাদ্যাভাবে রয়েছে। এই যুদ্ধ সারা বিশ্বের খাদ্য সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। ইউক্রেনে উৎপাদিত ভোজ্যতেল, সার ও অন্যান্য কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ গেছে। সারের মত কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে।
রাশিয়া বিশ্বে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান যোগানদাতা। দেশটি বিশ্বে তেল রপ্তানিতে ২য় এবং কয়লা রপ্তানিতে ৩য় অবস্থানে। তবে পশ্চিমা অবরোধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস আমদানি করতে পারছে না। এর ধাক্কা লেগেছে বিশ্ব তেল বাজারেও। জ্বালানি মূল্যের হঠাৎ বৃদ্ধি, কোভিড পরবর্তী সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর যেনো 'মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্র জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের মত দেশগুলো জ্বালানির জন্য অতিমাত্রায় রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইউরোপের মোট গ্যাস চাহিদার ৪০ শতাংশ রাশিয়া সরবরাহ করতো। যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহ কখনো কমিয়ে দিয়েছে অথবা নানান অজুহাতে বন্ধ রেখেছে। ফলে শীত সামনে ইউরোপের ধনী দেশগুলো পড়েছে তীব্র জ্বালানি সংকটে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি দ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ খরচ সবই বাড়িয়ে দিয়েছে।
জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চাবুকের আঘাত হয়ে এসেছে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রায়। উন্নত কী, উন্নয়নশীল, ইউরোপ থেকে আফ্রিকা সবদেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ইউরোপের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের বেশি। আর নিম্ন মাথা পিছু আয়ের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি দুই অংকের বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির বোঝা স্বল্প আয়ের মানুষের ঘাড়েই বেশি চেপেছে। তাদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে ঠিকই, কিন্ত আয়ের পরিমাণ বাড়েনি; বরং অনেকের ক্ষেত্রে কমেছে।
বিশ্ব যখন শরনার্থী সমস্যায় ইতোমধ্যেই নাকাল, তখন ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত তৈরি করেছে অতিরিক্ত ৭.৩ মিলিয়ন শরনার্থী। এতে ইতোমধ্যে শরনার্থী সমস্যায় জর্জরিত ইউরোপ পড়েছে আরও সংকটে। চলমান এই সংকট ইউরোপের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যায় তা এক বড় প্রশ্ন! আর ইউরোপের রাজনীতি ও অর্থনীতির পট বদলে গেলে তার প্রভাব শুধু ওই অঞ্চলেই সীমিত থাকবে না, এখনকার মতোই ছড়িয়ে পড়বে পুরো বিশ্বে। ইউরোপের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও শরনার্থী সমস্যা মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে বর্তমানে, যা পুরো বিশ্বের জন্যই অশনি সংকেত।
বিভিন্ন দেশকে নিজেদের নিরাপত্তার ভাবনাগুলো নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের সামরিক খাতের ব্যয় বাড়িয়েছে। ফিনল্যান্ডের ও সুইডেনের মতো শান্তিপ্রিয় দেশদুটোও এখন ন্যাটোতে যোগ দিতে আবেদন করেছে।
একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের এ যুগে যেকোনো সংকট দুটো দেশ বা অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কারণ আধুনিক বিশ্ব ব্যাবস্থায় প্রতিটি দেশটিই অন্যান্য দেশের ওপর কোনো না কোনো দিক দিয়ে নির্ভরশীল। তাই বিশ্বের কোনো এক অঞ্চল আক্রান্ত হলে পুরো বিশ্বই যে তার প্রভাব ভোগ করবে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর এই প্রভাব সারাবিশ্বের ধনী-গরিবের ব্যবধানকে যেনো আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন। সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।