পরিবারে ছায়াদানকারী বটগাছটির নাম বাবা
অনেকেই আছেন যারা শিশুর সাথে কথা বলার সময় প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন, তোমার বাবা বেশি ভালো নাকি মা? অথবা তুমি বাবাকে বেশি ভালবাসো, নাকি মাকে? অথচ তারা বুঝতেই পারেন না যে একজন শিশুর কাছে এরচাইতে অদ্ভুত ও বিব্রতকর প্রশ্ন আর হয় না। কারণ একজন শিশুর কাছে বাবা মা দুজনেই সমান প্রিয় ও সমান নির্ভরতার জায়গা। দু'জনেরই ভালবাসা ও আলিঙ্গন শিশু প্রত্যাশা করে সমানভাবে।
আর বাবা না মা, কে বেশি ভালো- এই প্রশ্নও সন্তানের কাছে অবান্তর। কারণ সন্তান তার বাবা-মা দুজনকেই সমান ভালবাসে। এরপর বড় হতে হতে, সামাজিক অবস্থার চাপে, সাংসারিক টানাপোড়েন ও অবদানের উপর ভিত্তি করে ভালবাসা বা পছন্দের জায়গায় কিছুটা একপেশে ভাব তৈরি হতেই পারে। কিন্তু সন্তানের জীবনে মা ও বাবার অবদান গুনে শেষ করা যাবে না।
একটি পরিবারে ছায়াদানকারী বটগাছটির নাম বাবা। আর তাই একজন সন্তান যখন তার বাবাকে হারায়, তখন সেই সন্তানের মাথার উপর থেকে ছায়া সরে যায়। সন্তান যে বয়সেই বাবাকে হারাক না কেন, তার পৃথিবীটা নিমিষেই অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে। বাবার মৃত্যুর পর একজন প্রতিষ্ঠিত ও বয়স্ক মানুষও উপলব্ধি করেন যে, তিনি তার সবচেয়ে বড় আশ্রয়টি হারিয়েছেন।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে এসেছি বাবাই সংসারের মূল হালটি চালনা করেন। তিনিই যেন সংসারের 'ক্যাপ্টেন, ও মাই ক্যাপ্টেন'। পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, আমোদ-আহ্লাদ, বিয়ে সবকিছুর দায়িত্ব সাধারণত বাবাকেই বহন করতে হয়। আমাদের যুগ পর্যন্ত পরিবারগুলো সম্পূর্ণই বাবার আয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল।
যে কারণে বাবার উপস্থিতির বিষয়টা ভালবাসার চেয়েও প্রয়োজনের তাগিদেই বেশি ছিল। সমাজ পুরুষের ঘাড়ে সংসার পরিচালনার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। বলেছে তাকেই যেকোন মূল্যে এই হাল চালিয়ে নিতে হবে। বাবারা এই চরিত্র চিত্রণই করে গেছেন বা যাচ্ছেন। এও সমাজের চাপিয়ে দেওয়া জেন্ডার রোল।
যেসব বাবা সংসারের দায়িত্ব সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান, স্ত্রীকে যুদ্ধের মাঠে একা ফেলে চলে যান, সংসারের কর্তা হিসেবে একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করেন, যারা দুর্নীতিপরায়ণ ও অসৎ পথে টাকা আয় করে সন্তানকে মাত্রাতিরিক্ত সুখে রাখার চেষ্টা করেন, যারা চরিত্রহীন, পরিবারের সদস্যদের প্রতি সহিংস আচরণ করেন, যারা সবক্ষেত্রেই যৌন কর্তৃত্ববাদী, সেইসব লোকগুলো আদতে কোনদিন বাবাই হতে পারেননি, পারবেনও না। তারা শুধু বাবার মতো চেহারা ধারণ করে আছেন। আজকের আলোচনায় সেই নামমাত্র বাবাদের নিয়ে কথা বলতে চাইছি না।
বাবা ছাড়া, বাবার ভালবাসা ও দৃষ্টি ছাড়া যেহেতু পারিবারিক কাঠামোই দুর্বল, তাই সেই যুগের বাবাদের আত্মঅহংকার ও তেজ একটু বেশিই ছিল। একেই আমরা বলি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। সেই মানসিকতারই প্রতিফলন দেখা যেতো অধিকাংশ বাবাদের মধ্যে। তাই বাবারা সন্তানের সাথে কথা বলতো কম, হাসতো কম, মেলামেশাও করতো কম। আর সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব করারতো প্রশ্নই আসে না। বাবার অনুমতি ছাড়া কোন কাজ হতো না। মায়েরা বাবার নির্দেশ ছাড়া সন্তানকে কোন অনুমতিও দিতো না।
আমাদের প্রজন্মের বা তার আগের প্রজন্মের সন্তানরা সাধারণত বাবাকে এড়িয়ে চলতো, মায়ের মারফতে কথা বলতো, দাবি-দাওয়া পেশ করতো। জীবনের সবক্ষেত্রে বাবার সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত কথা। সেইসময় অধিকাংশ বাবাদের ভূমিকা আবর্তিত হতো কেবলমাত্র দায়িত্বপালনকারী পুরুষ হিসেবে। সংসার কিভাবে চলবে, টাকা কোথা থেকে আসবে এইসব চিন্তাতেই বাবা নামের মানুষটিকে ব্যস্ত থাকতে হতো।
কাজেই সাংসারিক কোন আবেগ, ভালবাসা ও আয়োজন তাদের ম্পর্শ করতো না। আমাদের প্রজন্ম বা তার আগের প্রজন্মের অধিকাংশ বাবা দাদারা এমনই ছিলেন। তাদের কছে সন্তানের পড়াশোনাই ছিল মূখ্য। বাচ্চারা পড়াশোনা করবে, ভদ্র হবে, বড় হয়ে সিএসপি অফিসার বা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে, সংসারের দায়িত্ব নেবে এমনই ছিল তাদের স্বপ্ন। আর মেয়েরা ঘরকন্নার কাজ শিখে শ্বশুরবাড়ি যাবে। স্বপ্ন বলতে শুধু এটুকুই ছিল। বাবাও যে সন্তানের বন্ধু হতে পারেন, এর চাইতে অমূলক কোন ধারণা ছিল না তাদের কাছে।
এরমধ্যেও কারো কারো বাবা একেবারে 'অন্যরকম' ছিলেন। এই অন্যরকম বাবারাই আদতে মন ও মানসিকতায় একজন আধুনিক বাবা। সুখের মন্ত্র জানা একজন মানুষ যখন বাবা হয়, তখন সেই পরিবারে বয়ে যায় সুখের বন্যা। অভাব, অনটন, দুঃখ, অপ্রাপ্তি থাকলেও সেসব পরিবারে থাকে শান্তি, ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও হাসি-আনন্দ।
সেদিন 'মায়েরা আসলে কী খায়, কিভাবে বাঁচে' এর উপর একটা লেখা লিখেছিলাম বলে অনেকেই বলেছিলেন বাবাদের কথা লিখেন না কেন, বাবাদের দায়িত্ব কি কম কিছু? একদমই তা নয়; বরং সংসার পরিচালনায় বাবাদের দায়িত্ব ও উদ্যোগ বেশি ছিল, এখনো বেশিই আছে। বাবা এবং মা এমন দুই মানুষ, যাদের অস্তিত্ব ও অবদান কখনো ভাগ করা যায় না।
আমাদের পরিবার ছিল সম্পূর্ণ বাবার আয়ের উপর নির্ভরশীল। অথচ একজন আধুনিক মানুষ হিসেবে আব্বাকে দেখিনি কখনো তার কর্তৃত্ব আমাদের উপরে চাপিয়ে দিয়েছেন বা সিংহ পুরুষ হিসেবে আম্মার প্রতি অসদাচরণ করছেন। আব্বা একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও খুব বেশি কিছু চাইতে পারতেন না। কিন্তু আব্বা যা চাইতেন, তা এখন অনেকেই চান না বা চাইতে পারেন না। তিনি চাইতেন পরিবারের ও তার আশেপাশের সবাই যেন সুখে থাকে, আনন্দে থাকে, ভাল থাকে।
এই মানুষটিই আমাদের শিখিয়েছেন, 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান এই শিক্ষাটি আমরা মেনে চলার চেষ্টা করেছি। আব্বা ছিলেন আমাদের কাছে পরম পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। তাকে কখনো দেখিনি পরিবারকে অবজ্ঞা করতে, অসৎ পথে চলতে শেখাতে, দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে, অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে।
ত্রিশ বছর আগে আব্বা যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, সেদিনই আমরা অনুভব করেছিলাম মাথার উপর থেকে বটবৃক্ষের ছায়াটি সরে গেল। আমি জানি মানুষ যে বয়সেই পিতৃহারা হোক না কেন, সবারই এই একইরকম উপলব্ধি হয়। পরবর্তীতে সবাই অনুভব করেন বাবা মায়ের অশরীরি উপস্থিতি।
জীবনের অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সন্তানদের নিরাপদে দাঁড়িয়ে থাকা, পুরো পরিবারের বেঁচে থাকা, তা সম্ভব হয় একজন ভালো বাবার জন্যই। বাবারা সন্তানের জীবনের ছায়া শক্তি। বাবা যদি সৎ হন, মানুষের বন্ধু হন, পরিবারের প্রতি সহানুভ'তিশীল হন, তাহলে তিনি চলে গেলেও তার সন্তানেরা মানুষের ভালবাসা ও সহযোগিতা পাবেই।
একজন আধুনিক ও প্রগতিশীল বাবা তার সন্তানদের শেখাবেন মানুষকে ভালবাসার কথা। শেখাবেন ভালবাসা খুব মূল্যবান জিনিস, তা পেতে চাইলে আগে মানুষকে ভালবাসতে হবে। আর কীভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়, কীভাবে দুঃখ-কষ্টকে জয় করতে হয়, সৎ থেকে বাঁচা যায়, সেটাও বাবারাই সন্তানকে শেখান।
পরবর্তী জীবনে এসে আমরা পেয়েছি আরো আধুনিক বাবাদের। যারা সন্তানের ও স্ত্রীর বন্ধু হতে পেরেছেন বা চেষ্টা করেছেন। পরিবারের কাজ, সন্তানের দায়িত্ব ভাগ করে করতে পারেন। সংসারে যেহেতু এখন স্ত্রীরাও একা হাতে কাজ করেন ঘরে-বাইরে, সন্তান প্রতিপালন করেন, স্বামীর কাজে সহযোগিতা করেন, কাজেই পুরুষ হিসেবে বাবা ও স্বামীর দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে।
কাউন্সেলিং বিশেষজ্ঞ, সাইকোথেরাপিষ্ট ও কনসালটেন্ট হাওয়ার্ড টড কলিন্স মনে করেন, আধুনিক সমাজে প্রায় প্রতিটি পরিবারে পুরুষরাই প্যারেন্টিং বা শিশুর লালনপালনে এগিয়ে থাকবেন এবং অধিকতর প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন, যদি তারা সন্তানকে নিরাপত্তা ও নির্ভরতা দিতে পারেন, সন্তানকে মন্দ সংসর্গ থেকে বাঁচাতে পারেন এবং সন্তানের মাকে মর্যাদা দিতে পারেন। একজন ভালো বাবা শুধু নিজে ভালো হলেই চলবে না, তাকে অবশ্যই সন্তানের মায়ের প্রতি ভালবাসা ও মর্যাদা প্রদর্শন করতে হবে। মায়ের সব কথার সাথেই যে তাকে একমত হতে হবে, তা নয়, কিন্তু মূল্য দিতে হবে। সন্তান যেন দেখে ও শেখে যে বাবা মায়ের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
একটি আদর্শিক পরিবেশে বাবা সন্তানকে নিরাপত্তা দেবেন, সাহস দেবেন, আরাম দেবেন। বাবাই সন্তানের কাছে হিরো ও শিক্ষক এবং জ্ঞানী মানুষ। বর্তমানে পিতৃত্বের বা পিতার ভূমিকার বিষয়টা অনেকটাই বিবর্তিত হয়েছে। এর ফলে আজকের বাবাকে অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হচ্ছে, বিশেষ বিশেষ দক্ষতা ও মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে। এখন বাবা শুধু নামে থাকলেই হবে না, সন্তানের অস্তিত্বে থাকতে হবে। বাবাকে হতে হবে উদার, সহানুভূতিশীল, সমানুভূতিসম্পন্ন, মানবিক, সৎ, আনন্দদায়ক, মজার এবং কাজের মানুষ।
সন্তানকে সুন্দর করে বড় করতে হলে বাবা এবং অবশ্যই মায়েদের উচিৎ হবে নিজেদের ক্রমাগত পরিবর্তন করা। একজন আধুনিক ও সহনশীল বাবা নিজে যেমন সামনে আগাবেন, তেমনি তার সন্তানকেও আচারে, আচরণে, ব্যবহারে, মেলামেশায়, জ্ঞানে, তথ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন, শুধুমাত্র পুরুষ হিসেবে নয়, একজন যথার্থ বাবা হিসেবে।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন