প্রাকৃতিক সবুজ আচ্ছাদনে সুরক্ষা হোক শহুরে পাখিদের
বর্তমান পৃথিবীতে শহুরে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে নগরে প্রাকৃতিক সবুজ আচ্ছাদন তৈরি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই স্থানগুলো বন্যপ্রাণী বিশেষ করে পাখি সংরক্ষণে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যায় ক্রমেই কমছে এই সবুজ আচ্ছাদন।
মানুষ ক্রমাগত গ্রাম থেকে শহরমুখী হচ্ছে। জীবন, জীবিকার তাগিদ, উন্নত জীবন যাপনের জন্য ক্রমান্বয়ে বাড়ছে শহরের জনসংখ্যা। বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ শহরে বসবাস করছে; এই হার ২০৫০ সালের মধ্যে ৬৮ শতাংশে পৌঁছবে। ফলাফলস্বরূপ বাড়ছে নগরের আয়তন আর প্রকৃতি-পরিবেশ পরিবর্তিত হচ্ছে নগরে। স্থানীয় জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল, হারিয়ে ফেলছে তাদের জৌলুস আর সৌন্দর্য।
পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায়, জীববৈচিত্র্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাখিরা রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এছাড়া, কৃষি উন্নয়ন, পরাগায়নে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শহরে আবর্জনাভুক পাখিরা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ সুরক্ষিত রাখে। এছাড়া অনেক পাখি অসুস্থ প্রাণীদের খেয়ে মহামারি থেকে রক্ষা করে। এরা পরিবেশের নির্দেশক। তাছাড়া আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতির সঙ্গেও এরা জড়িত। কিন্তু বর্তমানে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে নগরায়নের ফলে হুমকির মুখে এই পাখিরা।
অনেকসময় জানতে ইচ্ছে করে, কাক, চিল, শালিক, চড়ুই ছাড়া কি নগরে আর কি কোনো পাখি বসবাস করে? অবশ্যই হ্যাঁ, বাংলাদেশের মোট পাখি প্রজাতির বড় একটি অংশ বসবাস করছে বাংলাদেশের শহর এলাকায়। উদাহরণস্বরূপ ঢাকা মহানগরের কথাই ভাবা যাক।
জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার জনসংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে দুই কোটি ৭৪ লাখে। বর্তমানের ১১তম জনবহুল স্থান থেকে তখন তা পৌঁছে যাবে ষষ্ঠ জনবহুল নগরীতে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় ম্যানিলাকে ধরা হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। সেই তালিকায় ঢাকা আছে তৃতীয় স্থানে। অধিক জনসংখ্যা থেকে উৎপন্ন হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ, যার ফলে ঢাকা আজ দূষিত নগরী আর দূষণের দিক থেকে পৃথিবীতে যার অবস্থান বরাবরই শীর্ষে। আর এত মানুষের চাহিদা পূরণে সবসময় ধ্বংসের শিকার হচ্ছে ঢাকা শহরের প্রকৃতি, প্রাকৃতিক পরিবেশ আর বন্যপ্রাণীরা।
মানুষই যখন ঠিকমতো এই শহরে সুস্থ অবস্থায় থাকার মতো একটু আশ্রয় পায় না, তখন অন্য প্রাণীদের কী অবস্থা? স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে মনে, কাক, চিল চড়ুই ছাড়া কি অন্য বন্যপ্রানীরা টিকে আছে এই ব্যস্ত নগরী ঢাকায়?
মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে—অতীতের ঢাকা কেমন ছিল? আর কেমন ছিল আমাদের এই তিলোত্তমা নগরীর বুনো পরিবেশ?
তৎকালীন সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ বুড়িগঙ্গার তীরে ১৭ শতকের দিকে গোড়াপত্তন হয় এই নগরীর। তখন বুড়িগঙ্গার তীরে কিছু বসতি ছাড়া উত্তর দিকের মিরপুর, পল্টন, তেজগাঁও, কুর্মিটোলা ছিল বিশাল জঙ্গল আর দক্ষিণের কামরাঙ্গীরচর ছিলো বিশাল বাদাবন। এবং এই এলাকাগুলোতে বাঘ, বিশাল অজগর, বুনো শূকর, বন্য বিড়াল, মেছো বিড়াল, সোনালী বিড়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর আনাগোনাও ছিলো।
৫০ বছর আগেও ঢাকা ছিল জলা, বনজঙ্গল, তৃণভূমির সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, তখন ঢাকার বর্তমান ব্যস্ত এলাকাগুলোতেও আনাগোনা ছিলো বন্যপ্রাণীদের। ছিল তাদের অবাধ বিচরণ। কাঁটাবন থেকেও পাওয়া যেত শিয়ালের ডাক।
একসময় দেশি ময়ূর, লাল বনমোরগ, মেটে তিতির, কালো তিতিরদের বিচরণের এলাকাগুলো পরিণত হয়েছে ইটকাঠ আর জঞ্জালের স্তূপে। আর তারা হয়েছে ঢাকা থেকে বিলুপ্ত। বুনোহাঁস, সারসদের জলাশয়গুলো প্রাণ হারিয়ে পচা ডোবা আর নানা সংক্রামক ব্যাধির মূল উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ নিজেই তৈরি করেছে তার মৃত্যু কফিন। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য।
এতকিছুর পরেও কত প্রজাতির পাখি টিকে আছে জানলে কিছুটা অবাক হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক ড মোহাম্মদ ফিরোজ জামানের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরে বন্যপ্রাণীর ওপর বিস্তারিত গবেষণা হচ্ছে। সেখান থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরে ১৬২ প্রজাতির পাখি টিকে আছে এখন।
ঢাকা শহরেই বিভিন্ন তৃণভূমিতে দেখা মেলে ৬ প্রজাতির মুনিয়ার, যার মধ্যে লাল মুনিয়া অন্যতম। এছাড়াও ৪ প্রজাতির টিয়া যার মধ্যে হিরামন টিয়া বা Plum-headed Parakeet, মদনা টিয়া, চন্দনা টিয়া বিশেষ ভাবে উল্ল্যেখযোগ্য। গোলাপি সাহেলী, সুইনহোস সাহেলী, কেশরী ফিঙ্গে, ছোট ভীমরাজের দেখা মেলে ঢাকার উদ্ভিদ উদ্যানেই।
বছরে ৪০ প্রজাতির বেশি অতিথি পাখি আসে এই ঢাকা শহরে, যার মধ্যে মাছমুরাল, বিভিন্ন প্রজাতির খঞ্জন, জিরিয়া, বাটান, চ্যাগা, ছোট কান পেঁচা, আঁশটে দামা, ব্লু থ্রোট, রুবিথ্রোট, লাল গির্দিসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুটকি ও চুটকি-জাতীয় পাখি অন্যতম। আমুর ফ্যালকন, কয়েক প্রজাতির ঈগল, বাজার্ড, চিল, পেঁচাসহ দেখা মেলে বিভিন্ন শিকারি পাখিরও।
কিন্তু এদের সংখ্যা প্রতিবছর ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কারণ এই পাখিরা হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল, ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে তাদের প্রকৃতিক পরিবেশ।
ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে পাখিদের অবস্থা কেমন? বিগত ৫ বছরে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান ও মো. মাহাবুব আলমের তত্ত্বাবধানে কাজ করার সুযোগ হয়েছে (ফরিদপুর, জামালপুর, মাগুরা, বরিশাল, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন শহরে) গবেষণার সুযোগ হয়েছে। নিজ চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশের সামগ্রিক চিত্র।
ঢাকার বাইরেও শহরগুলোতে নগরায়ন হচ্ছে, কিন্তু দ্রুততা ঢাকার তুলনায় কম। এখনও ওইসব শহরে টিকে আছে অসংখ্য পাখি যা আমাদের বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এমনকি আইইউসিএন-এর তালিকায় ঝুঁকিতে থাকা অনেক পাখি আছে এসব এলাকায়। বিভিন্ন পরিযায়ী পাখির দেখাও মেলে এখানে। কারণ এসব জেলার শহরাঞ্চলে এখনও প্রাকৃতিক পরিবেশ টিকে আছে।
নগরায়নের ফলে কিছু প্রজাতির পাখি, যেমন ময়না, শালিক, চিলসহ আবর্জনাভুক কিছু পাখি জীবনধারণের সুযোগ-সুবিধা, খাদ্যের উৎসের প্রাচুর্য, কিংবা নানা ধরনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকে, যার ফলে তাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেড়ে যায়।
তুলনামূলক অবস্থান বা Relative abundance খেয়াল করলে দেখা যায়, ঢাকা শহরে পাখির প্রজাতির মধ্যে অসম বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়—অর্থাৎ কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখির সংখ্যা এখানে খুবই বেশি। অন্যদিকে ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোতে খুব বেশি অসম বিন্যাস পরিলক্ষিত হয় না পাখিদের মধ্য। কারণ সেখানে এখনও টিকে আছে সবুজ এলাকা, আছে দেশজ বুনো গাছপালার প্রাচুর্য ও বাসস্থানের নিরাপত্তা। কিন্তু এসব এলাকাইয় ঢাকার তুলনায় অবৈধ শিকারের হার বেশি। কারণ, অনেক মানুষ এখনও পাখি শিকার বন্ধে সচেতন নয়।
এখন আমরা যে পাখি সংরক্ষন করব, এটা কি শুধু পাখির জন্যই? না। শহরের পাখিদের সংরক্ষণ করতে হবে শুধু পাখিদের স্বার্থে নয়, মানুষের স্বার্থেই। নগর পরিকল্পনায় রাখতে হবে তাদের জন্যও স্থান। ইট-কাঠের নগরীতে তাদের বেঁচে থাকার জন্য তারাও যেন পায় একটু প্রাকৃতিক আবাসস্থল।
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের মতো করে শহরে প্রয়োজন কিছু পার্ক, যেখানে থাকবে প্রাকৃতিক পরিবেশ, থাকবে দেশি বুনো গাছপালার সমাহার, যেখানে বন্যপ্রানীরা থাকবে নিরাপদে। শুধু গাছপালা নয়, দেশি লতা-গুল্মসমৃদ্ধ ঝোপঝাড়ের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। কারণ শুধু শহর নয়, গ্রামেও জঙ্গল সাফের নামে এই গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলকে ক্রমান্বয়ে নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। যার পুরো প্রভাব গিয়ে পড়ছে খাদ্যশৃঙ্খলে, আর আমরা হারাচ্ছি আমাদের পাখিদের।
এছাড়া আবাসিক এলাকা, অফিস চত্বর পাখি সংরক্ষণে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো পরিপূর্ণ করতে হবে প্রকৃতিক সবুজ আচ্ছাদনে। প্রাকৃতিক পরিবেশ যেন সুস্থভাবে বজায় থাকে, সেদিকে দিতে হবে নজর।
ইট-কাঠের নগরীগুলোকে হয়তো আর তার পূর্বের পরিপূর্ণ সবুজ রূপে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। তবে এখন আমাদের যতটুকু অবশিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে, পাখিদের জন্য সর্বোপরি আমাদের নিজেদের জন্য হলেও রক্ষা করতে হবে। অন্যান্য শহরগুলোর অবস্থা যেন ঢাকার মতো না হয় সেইদিকে নজর রাখতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে নগরের পাখিদের। সব প্রাণীই এই ধরিত্রী মায়ের সন্তান, আর সবার অধিকার আছে তার মায়ের কোলে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার।
-
আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিস, সিইজিআইএস, বাংলাদেশ