যে অর্জন আমাদের ছোট করে
গত সপ্তাহে দেখলাম শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ময়লা সংগ্রহ করে একটা জায়গায় জমা করা হচ্ছে। ঠিক সেখানেই খাবার খুঁজছে ৪/৫ টি কুকুর ও দু'টি মানব শিশু। দৃশ্যটি খুবই দুঃখজনক। ভাবছিলাম এই পথশিশুদের জন্য আমরা কিছু করতে পারি না কেন? উন্নয়নের এই যুগে দাঁড়িয়েও কেন মানবশিশুকে ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজতে হবে? এই কষ্ট দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছিল বলে মাথা নিচু করে সটকে পড়লাম, মানে পালালাম। বাস্তব পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য মনে হয় পালিয়ে বাঁচলাম।
এর ঠিক দু'দিন পরে পত্রিকায় আরেকটি ছবি দেখে আবার সেই একই অনুভূতি হলো। একজন মানুষ প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে শীত নিবারণের জন্য একটি প্লাস্টিকের বস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন। ভাবলাম দেশে প্রচুর ধনী মানুষ আছেন, যারা সবাই মিলে একটু হাত বাড়ালেই তো এই মানুষগুলো একটি কম্বল পেতে পারেন, আর ঐ পথ শিশু দুটি দু'মুঠো খাবার পেতে পারে।
এই আবেগে তাড়িত হতে হতেই খবরে দেখলাম সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাড়ি কেনায় বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশিরা। কানাডার বেগম পাড়ার পর এবার সংযুক্ত আরব আমিরাত বিনিয়োগ। বুঝলাম দেশে দরিদ্র মানুষকে কম্বল দেওয়ার বদলে দুবাইতে টাকা বিনিয়োগ করা অধিক উত্তম। কারণ তাতে গোল্ডেন ভিসা পাওয়া যাচ্ছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালে জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশিরা দুবাইয়ে ২৮৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে জমি-বাড়ি কিনেছেন। দুবাইয়ে যেসব দেশের মানুষ জমি-বাড়ি কিনছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা সবার আগে। এই অর্থ বৈধপথে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে তা অবৈধপথেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। (প্রথম আলো)
ভাবতে অবাক লাগে, এখনো যেই দেশের রাজধানীতে মানুষ আর কুকুর একসাথে খাবার খোঁজে, যে দেশে এখনো শীতে কাবু হয় অসংখ্য মানুষ, যে দেশের অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে পারছেন না বা হিমশিম খাচ্ছেন, যে দেশে শিশুরা দু'মুঠো ভাতের জন্য হয় কাজ করে অথবা ভিক্ষা করে। যেদেশে প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক মানুষের জন্য সু-বন্দোবস্ত নেই, যেখানে মানুষ একটু কম দামে চাল কিনবেন বলে ২/৩ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, সর্বোপরি দেশের সবচেয়ে বড় শ্রেণীর মধ্যবিত্তরা ক্রমশ নিম্নবিত্ততে পরিণত হচ্ছেন এবং নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন- সেই দেশ থেকেই বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। কী বৈপরীত্য!
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিএডিএস) তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে সম্পত্তি কিনেছেন ৪৫৯ জন বাংলাদেশি। যারা দেশের মানুষকে ঠকিয়ে এসব সম্পদ কিনেছেন তাদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, রাজনীতিক ও আমলা। একসময় বিটিভিতে আমজাদ হোসেনের নাটক দেখতাম "দুবাই যামু, টাকা চাই"। সেই দুবাই এখন বাংলাদেশিরা কিনে ফেলছে। গত ৩০/৩৫ বছরে এ গোত্রের ধনীদের লাগামহীন উত্থান ঘটেছে।
অথচ একদিন যারা দেশের অর্থনীতি ও নিজের পরিবারকে সবল করতে দুবাই বা অন্যান্য আরব দেশে গিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে, তারা কিন্তু দেশকে বঞ্চিত করেননি। তারা নিজেদের পয়সা খরচ করে কাজ করতে গেছেন মরুশহরগুলোতে। সেখানে রোদে-ঘামে ভিজে, নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়ে কাজ করে দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। আজ তাদের পাঠানো অর্থেই দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়েও পড়চ্ছেনা। এত চুরি-বাটপারি, টাকা পাচার, জৌলুস, ভোগবাদিতা সত্ত্বেও দেশটা চলছে।
গত এক দশকে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৪.৩ শতাংশ হারে ধনীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা। এক্ষেত্রে বিশ্ব তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। সংস্থাটি বলেছে যাদের সম্পদের পরিমাণ ৫০ লাখ ডলারের বেশি, তাদের নামই এখানে এসেছে। (ডয়েচে ভেলে)
কেমন করে বাংলাদেশের মতো ঋণনির্ভর একটি দেশের কিছু মানুষ বিশ্বের ধনী তালিকার শীর্ষে থাকে, এই কথা বোঝার জন্য অর্থনীতিবেত্তা হওয়ার দরকার নাই। এদের অধিকাংশই যে জনগণের গর্দান কেটে কালো টাকার মালিক হয়েছে, তা বুঝতে কারো কোন অসুবিধা হয়না।
আবার খবরে দেখলাম বিশ্লেষকেরা মনে করেন, কোভিডের মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে। এর অর্থ হলো, সেই দুঃসময়েও কিছু মানুষ বিপুল অর্থ আয় করেছেন। এই অর্থ দেশে রাখা তারা নিরাপদ বোধ করেননি বলে পাচার করেছেন।
এই দুর্নীতিবাজরা নিজ দেশকে পঙ্গু করে এত টাকা পাচার করেছেন যে বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দার মধ্যেও দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা ছিল শীর্ষে। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর বাসিন্দাদের পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশিরা। কী অসম্ভব একটা ব্যাপার!
এদিকে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা গেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, উন্নয়ন প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি, জ্বালানি তেল ক্রয়, খাদ্য বিতরণ, ব্যাংক, বীমা ও রাজস্ব খাত ঘিরে অনিয়ম হয়েছে। পাশাপাশি করোনার সময়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশি প্রকল্পে সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়ম ধরা পড়েছিল। করোনাকালেও থেমে ছিল না শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও গরিব মানুষের খাদ্য বিতরণের টাকা ব্যয়ে অনিয়ম।
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয় তা বলতে গেলে তেমন কার্যকর নয়। অডিট আপত্তি উঠলেও গা করা হয়না। কোনরকম জবাবদিহিতা না থাকায় এই দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা অনায়াসে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে যেহেতু কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তাই ধরে নেওয়া যায় বিষয়টির সাথে সাথে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই জড়িত। তাহলে কি এরা সরকারের চাইতেও শক্তিশালী?
এই দেশের কিছু রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ীরা এত কালো টাকার মালিক হয়েছে যে দেশ থেকে তাদের টাকা সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে। প্রকাশিত সংবাদ বলছে যে দেশের ব্যাংক পরিচালক, রাজনীতিবিদ, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল ও সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। তাদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে।
কেন একটার পর একটা ব্যাংক ব্যবসায় ধস নামছে? কোন ব্যাংকের ঋণ খেলাপি কত? কোন ব্যাংকগুলো হঠাৎ করে তারল্য সংকটে পড়েছে? বাংলাদেশ ব্যাংক কেন নির্বাক ভূমিকা পালন করছে? গত এক দশক কি ব্যাংক লুটের দশক হিসেবে চিহ্নিত হবে? একদিকে একের পর এক ব্যাংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা শুরু হয়েছে। তাদের আমানতকৃত অর্থ ঋণের নামে লুটে নিচ্ছে এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের মালিক গোষ্ঠী। কে, কাকে, কেন ঋণ দিচ্ছে, এর কোনো জবাবদিহিতা নেই।
আর্থিক অনিয়ম এবং টাকা লোপাটের অভিযোগ আছে মন্ত্রণালয়, ব্যাংক, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিং খাত, পেট্রোবাংলা-পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, পল্লী বিদ্যুৎ খাত, খাদ্য, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, শিক্ষা, রাজউক, করোনাকালীন স্বাস্থ্যখাতে বৈদেশিক সহায়তায় বাস্তবায়নাধীন প্রকল্প, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়ে রাজস্ব, সামাজিক সুরক্ষা, ভূমি ও খাদ্য বিতরণ খাতের বিরুদ্ধে। আমরা সাধারণ মানুষ গণমাধ্যম আছে বলে তহবিল তছরুপ, ব্যাংক ডাকাতি, অর্থ লোপট এবং সেই অর্থ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার খবর জানতে পারছি।
এই যে হাজার হাজার কোটি টাকা নাই হচ্ছে, এই টাকাগুলো যাচ্ছে কোথায়? অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা সব কি বাইরে চলে যাচ্ছে? যতো টাকা নাই হচ্ছে, সেই পরিমাণে তো দেশে বিনিয়োগ হতে দেখছি না। এমনকি এখন অব্দি কত টাকা লোপাট হয়েছে, এরও কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। সেইসাথে এও ঠিক যে বর্তমানে দেশে যে দারিদ্র্যের হার কত, সরকারিভাবে সে সংক্রান্ত কোন তথ্যও জানা যায়নি। দারিদ্র্যের হার নির্ধারণে কাজ করা সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৬ সালের পর এ সম্পর্কিত কোনো প্রতিবেদনও প্রকাশ করেনি।
দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যখন তাদের প্রতিবেদনে বলেন যে দারিদ্র্যের হারে যে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সরকার সেটা মানতে রাজি নয়। সরকার মনেই করেনা দেশে কোন দরিদ্র মানুষ আছে। তাই হয়তো ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সেই সময় দেশে বিদ্যমান দারিদ্র্যের হারের কথা উল্লেখ করেননি অর্থমন্ত্রী।
আর ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের একটানা এক যুগের শাসনামলের অর্জন নিয়ে একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, 'দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে এবং অতিদারিদ্র্যের হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।' (বণিক বার্তা)
আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে খুব অবাক লাগে এই ভেবে যে আমরা ১ লাখ টাকা ঋণ নিতে চাইলে ব্যাংক গুষ্টি ধরে টান দেয়। অথচ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে অনায়াসে সেই টাকা শোধ করছে না যারা, তাদের কিছুই হচ্ছেনা, উপরন্তু এরা বিদেশে সম্পত্তি কিনছে। দেশে জিডিপি বাড়ছে বলে সরকার ক্রেডিট নিচ্ছে কিন্তু সাধারণ মানুষের হাতে টাকা কমছে। তাহলে এই উন্নয়নের অর্থ কী?
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন