ইউক্রেনের সবকিছু ভালো যাচ্ছে না
ইউক্রেনের অনুরোধে পশ্চিমাবিশ্বের দেশগুলো এটিকে ট্যাংক, অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, দূরপাল্লার বোমা ইত্যাদি হয়তো সরবরাহ করবে, কিন্তু এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে দেশটি নতুন কিছু সমস্যার মুখোমুখিও হবে।
খুব দ্রুত ও জরুরিভিত্তিতে ইউক্রেনকে এসব অস্ত্র সরবরাহ করার একটি অর্থ হতে পারে — দেশটির সবকিছু এখন ভালো যাচ্ছে না এবং অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এটি এখন রাশিয়ার কাছে হারার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
ইউক্রেন যেসব অস্ত্রের সরবরাহ পাচ্ছে এগুলো তাদের ক্ষয়িষ্ণু অস্ত্রভান্ডারের প্রতিস্থাপক হিসেবে সরবরাহ করা হচ্ছে না। বরং এগুলো পাঠানোর উদ্দেশ্য যুদ্ধের মোড় ইউক্রেনের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।
এ অস্ত্রগুলোর কারণে ইউরোপের যুদ্ধ আরও বড় হওয়ার বিষয়ে সন্দেহের খুব কম অবকাশই রয়েছে। রাশিয়া চাইবে এসব অস্ত্রের ট্রানজিট কেন্দ্রগুলোতে আঘাত হানতে। এক্ষেত্রে মস্কোর বড় লক্ষ্য হতে পারে পোল্যান্ড। পাশাপাশি দেশটির প্রতিশোধমূলক হামলার সম্ভাব্য শিকার হতে পারে জার্মানির রেলপথ ও রাস্তাগুলো।
আপগ্রেড করা পারমাণবিক অস্ত্র ইউরোপে স্থানান্তরের মার্কিন সিদ্ধান্তের ফলে রাশিয়া ধারণা করতে পারে, ইউক্রেনের পতন হলে ন্যাটো ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাবে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সাপেক্ষে তুলনা করলে রাশিয়ার কাছেও বড় সংখ্যক ট্যাকটিক্যাল ও কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে।
দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনের সেনারা এখন পিছু হটছে। যদি তা চলতে থাকে, তাহলে ইউক্রেন শীঘ্রই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ হারাবে।
এদিকে পেন্টাগন মনে করছে, রাশিয়া দনবাসে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে এ এলাকা পরিত্যাগ করার আহ্বানও করেছে।
কিন্তু দনবাস ছেড়ে একেবারে পিছু হটলে ইউক্রেনের কেন্দ্রভাগ রাশিয়ার জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়বে। আর তার সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে ইউক্রেনের অভ্যন্তরের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তার বেশিরভাগ রাজনৈতিক-বিরোধীদের গ্রেপ্তার করেছেন। তার অপছন্দের গণমাধ্যমগুলোর কণ্ঠরোধও করেছেন তিনি। এমনকি ইউক্রেনের গোপন পুলিশ এসবিইউ'র হাতে জেলেনস্কির অনেক প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতা নিকেশ হয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
কিন্তু যদি ইউক্রেনের জনগণ বুঝতে শুরু করে দেশটির হার প্রায় সন্নিকটে, সেক্ষেত্রে জোর খাটিয়ে নিজেকে বা সহকর্মীদের আর রক্ষা করতে পারবেন না জেলেনস্কি।
গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করলেও, ইউক্রেন মূলত একটি কর্তৃত্ববাদী দেশ। সংবাদে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য প্রকাশে বাধা দেওয়া ও রাজনৈতিক বিরোধীশক্তিকে কণ্ঠরোধ করার মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী দেশের রূপ নিয়েছে ইউক্রেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে খবর আজকাল কখনো চাপা থাকে না, আর তা নিয়েই তটস্থ থাকতে হতে পারে জেলেনস্কি ও তার দলকে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, নতুন অস্ত্রব্যবস্থা পাঠানোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধক্ষেত্রের গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ার আশা করছে। ইউক্রেনকে লেপার্ড টু ট্যাংক দিতে এবং পোল্যান্ড যেন তাদের লেপার্ডগুলো ইউক্রেনকে সরবরাহ করে, তার অনুমতি দিতে জার্মানির ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
পোল্যান্ডের কাছে প্রায় ৫৬৯টি ট্যাংক রয়েছে, এর মধ্যে ৩৯৮টি সচল। আর তার মধ্যে ২৫০টি লেপার্ড টু ট্যাংক। এ ট্যাংকগুলোর স্থলে ১৮০টি কোরিয়ান কে-২ ব্ল্যাক প্যান্থার ট্যাংক সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির। কে-২ ব্ল্যাক প্যান্থার একটি অত্যাধুনিক ট্যাংক।
লেপার্ড টু ট্যাংকগুলো আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা কার্যকরী হবে তা আগ বাড়িয়ে বলার কোনো উপায় নেই। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ার আলেপ্পোর কাছে আইএসআইএস-এর দখলিকৃত স্থানে যুদ্ধে অসংখ্য লেপার্ড ট্যাংক ধ্বংস হয়। মোট ১০টি লেপার্ড ট্যাংক ধ্বংস হয় ওই যুদ্ধে। এগুলোর অনেকগুলো ধ্বংস হয়েছিল রাশিয়ার তৈরি ট্যাংকবিধ্বংসী মিসাইল, আইইডি, ও রকেটের আঘাতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে আব্রামস এম-১ ট্যাংক পাঠাবে না বলে শুরুতে জানালেও এখন বলছে তারা এটি পাঠাতেও পারে।
কিন্তু, রাশিয়া ইউক্রেনের আকাশের বেশিরভাগ অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। মার্কিন ট্যাংক ধ্বংসে রাশিয়া আকাশ থেকে সহজেই হামলা চালাতে পারবে। রাশিয়ার অস্ত্রের সামনে মার্কিন ট্যাংক পরাস্ত হলে তা মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ইউরোপের নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আমেরিকার সক্ষমতার বিষয়ে নেতিবাচক বার্তা দেবে।
ইউক্রেন যুদ্ধের আরেকটি সমূহ বিপদ হতে পারে — এ যুদ্ধ ইউরোপের অন্যান্য দেশে, বিশেষত পোল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়তে পারে। রাশিয়ার কাছে আরেকটি 'বিকল্প' হতে পারে মার্কিন সমর্থনের জবাবে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়র মতো একটি বা একাধিক বাল্টিক রাষ্ট্র আক্রমণ করা।
বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাল্ফ অব ফিনল্যান্ডে এস্তোনিয়ার অবস্থান ও রাশিয়ার সঙ্গে দেশটির সংবেদনশীল সীমান্তের কারণে এস্তোনিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বাল্টিক দেশ হয়ে উঠেছে।
ফিনল্যান্ড ইতোমধ্যে ন্যাটোর একটি ডে ফ্যাক্টো সদস্য হয়ে উঠেছে। এতে গাল্ফ অব ফিনল্যান্ড রাশিয়ার জন্য তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি বৈরিভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। এর ফলে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য ক্রমবর্ধমান এ হুমকির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপ বাড়বে।
ওপর থেকে বাইডেন প্রশাসনকে দেখে মনে হচ্ছে, এটি ইউক্রেনের হারের সম্ভাবনা, যুদ্ধ বৃদ্ধির হুমকি ইত্যাদিতে বিশেষ কর্ণপাত করছে না। বরং মার্কিন সরকার ও এর মিত্ররা নিয়মিত দাবি করছে, ইউক্রেন থেকে রাশিয়াকে দূর করার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে তারা।
যদি এ ধরনের দাবি সত্য হতো, তাহলে ইউক্রেনের জন্য তড়িঘড়ি করে এত অস্ত্র পাঠানোর প্রয়োজন হতো না।
বর্তমানে যুদ্ধ সংক্রান্ত যেসব সংবাদ বাইরে প্রকাশিত হচ্ছে, তার বেশিরভাগই ইউক্রেনের প্রচারণা। আর সেগুলোকেই মেনে নিচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো। তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে সঠিক খবর ফাঁস হচ্ছে।
সর্বশেষ একটি জার্মান প্রতিবেদনে বার্লিনের বিএনডি ফরেইন ইন্টেলিজেন্সের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, বাখমুত এলাকায় ইউক্রেনীয় বাহিনীর মৃত্যুহার অনেক বেশি — দিনে প্রায় শ'খানেক।
ওয়াশিংটনকে এখন কিছু বিপজ্জনক বিকল্প থেকে পদক্ষেপ বেছে নিতে হবে। এটির কি নিজেদের সৈন্য বা বিমানশক্তি ইউক্রেনে সরবরাহ করা উচিত? যদি যুক্তরাষ্ট্র তা করে, তাহলে ইউরোপে কত দ্রুত যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে?
ন্যাটোও কি সবসময়ে মতো উদ্ধত চরিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ইউক্রেনে সেনা পাঠানো সমর্থন করবে নাকি অবশেষে চাপের মুখে নতি স্বীকার করবে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী এ সামরিক জোটটি?
এর বিকল্প এবং অতি সম্ভাব্য দৃশ্যপটটি হতে পারে, ওয়াশিংটন শেষ পর্যন্ত শান্তি আলোচনার ওপর জোর দেবে। আর রাশিয়াও কি আলোচনার টেবিলে বসে কোনো চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবে? অবশ্যই, কিন্তু তা কেবল তখনই, যদি রাশিয়ার কাছে চুক্তির মূল্য পর্যাপ্ত মনে হয়।