৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার এবং আজকের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা
১.
ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলটি সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব ত্যাগ করে দেশের জনগকে ধারণা দিতে চেয়েছিল যে তারা সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে। কিন্তু কার্যত তেমনটি ঘটেনি। ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে তেমন কিছু ঘটেনি এবং ঘটার মতন বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে বৃহৎ এই রাজনৈতিক দল দুইটি রাজপথ দখলে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় জনগণকে ভোগান্তির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে।
ঢাকাসহ সারাদেশে নানা ভোগান্তির সম্মুখিন মানুষ। এরই মধ্যে প্রায় ১০ দিন টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা। সেটাও দুই গ্রুপে বিভক্ত। দুই গ্রুপের জন্য আলাদা দুটি সপ্তাহ বরাদ্দ করতে হয়েছে। বিভাজন কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও বিভাজন তীব্র। এদেশের মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নানাবিধ প্রশ্নে স্পষ্টভাবেই বিভাজিত।
আগামী নির্বাচনের বাকি একবছরেও কম সময়। এরকম অবস্থায় কেমন যাবে সামনের দিনগুলো সেটি এখন প্রশ্ন।
সরকার হেফাজত ইসলামের সঙ্গে এক ধরনের সমঝোতার চেষ্টা করছে যা প্রায়ই গণমাধ্যমে উঠে আসছে। যদিও হেফাজতের বিরুদ্ধে মামলা কারাগারে থাকা হেফাজতের নেতা ও কর্মীদের মুক্তির বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। মাঠ গরম হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে। সরকার ও বিরোধীপক্ষ সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিতর্ক '৯৫ থেকে শুরু হয়ে আজও চলছে। ইতিহাস বলে এরকম বিতর্ক অতীতেও ছিল এই ভূখণ্ডে। এই ভূখণ্ডের মানুষ ভোট দেওয়ার অধিকার পায় ১৯৩৭ সালের নির্বাচন থেকে। সেই নির্বাচনের নির্বাচনী আইনের আওতায় ১৯৫৪ সালে তদানীন্ত পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা দাবি সামনে নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার সবটা আজ প্রাসঙ্গিক না হলেও ১৫ এবং ২০ নং দাবি এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ১৫ নং দাবিতে বলা হয়েছিল, শাসন ব্যবস্থা থেকে বিচার ব্যবস্থাকে আলাদা করতে হবে। অন্যটি ২০ নং দাবিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, নির্বাচনের ছয় মাস পূর্বে ক্ষমতাসীন সরকারকে পদত্যাগ করে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের আওতায় নির্বাচন দিতে হবে। সেই জোটের অন্যতম নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৫৪ সনের সেই সরকার খুব স্বল্প সময় ক্ষমতায় ছিল। পরবর্তী নির্বাচনের সময়ে দেশটি সামরিক শাসনের কবলে পড়ে, যে কারণে সেই ২০ নম্বর দাবিটি বাস্তবায়নের আর সুযোগ হয়নি।
এরপর ৭৩ সালে আওয়ামী লীগ এবং '৭৯ সালে বিএনপি নির্বাচন করেছে ক্ষমতায় থেকেই। এর পরের একাধিক নির্বাচন ক্ষমতায় থেকেই হয়েছে কিন্তু ৯৬, ২০০১ ও ২০০৯ এই তিনটি নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার বাইরে থেকেই করতে হয়েছে, তারপরেও নির্বাচনগুলো নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি। বছরের প্রথম মাসটি শেষ হলো। আর ১১ মাস পরেই যে নির্বাচন সেখানে সমঝোতার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
২.
অর্থনৈতিক সংকটের কথা নানাভাবে উঠে আসছে। দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা মারাত্মক সংকটের মুখে পড়ছে। গ্যাস- বিদ্যুতের দাম বারবার বৃদ্ধি করা এমনকি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য কোনো আলোচনাই করা হয়নি। আন্তর্জাতিক মূল্যের সাথে সমন্বয়ের কথা বলা হলেও তা করা হয়নি। দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস শিল্প কারখানায় বহুকাল যাবত এক ধরনের ভর্তুকি হিসেবেই চলছিল। সেগুলো সব বাদ দিয়ে কী কারণে এই উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করা হলো তাও সুস্পষ্ট নয়।
তারপরেও গ্যাসের সংকট কাটেনি। মূল্যবৃদ্ধি করায় সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে- তা এখনো স্পষ্ট নয়। এলএনজি আমদানি করার প্রক্রিয়া নিয়েও অনেক প্রশ্ন। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আমদানিতে অসুবিধা হচ্ছে না কিন্তু এর বাইরে যারা রাজনৈতিক পরিচয়বিহীন তারা সংকটের মোকাবেলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
৩.
গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই সারা বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদের নানা বিকাশ ঘটেছে। মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইজরাইলি ধর্মীয় মৌলবাদের তাণ্ডব চলছে বহুকাল ধরে। যাকে নিরবে সমর্থন জানাচ্ছে আমেরিকা। সেখানে পশ্চিমা দেশগুলোর মানবতার প্রশ্ন ধুলায় মিশে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে মানবতার কথা বলে ইউক্রেন যুদ্ধে অস্ত্র যোগান দিচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশ আমেরিকা ও তার মিত্ররা। তারা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য চীনের বিরুদ্ধে নানা লড়াইয়ে লিপ্ত।
অতি সাম্প্রতিক বিবিসি ভারতের মোদির উত্থান সম্পর্কিত যে ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে তার পেছনেও একটি রাজনৈতিক লক্ষ্য আছে। যে বিষয়গুলোকে নিয়ে মোদির বিরুদ্ধে এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হয়েছে তার শুরু '৯২ সালের ঘটনা। তার সাথে নানা ঘটনা সেখানে তুলে ধরা হয়েছে। এত বছর পর এই ঘটনা তুলে ধরার মূল কারণ ভারত ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
পাকিস্তানের পেশোয়ারের মর্মান্তিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।। পেশোয়ার শহরটিতে দীর্ঘকাল মৌলবাদীদের শক্তিশালী ঘাঁটি। এর আগেও একাধিক ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। এবারের আত্মঘাতী হামলায় পঞ্চাশের অধিক পুলিশ নিহত হলো।
আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও ধর্মীয় বিভাজনের চূড়ান্ত রূপ দেখছি। সবচেয়ে নিরীহ ধর্মীয় গোষ্ঠী তাবলীগও দুইভাগে বিভক্ত। প্রায়ই পত্রিকায় আসছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের কর্মকাণ্ডের খবর। দেশের মানুষ আতঙ্কিত।
প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। উভয় দলের রাজনৈতিক মাঠ গরম করার প্রতিযোগিতা দেশকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দিবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ব্যবহার আমরা দেখেছি। ইউটিউব জুড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যা দেশকে মারাত্মক পরিণতির দিকে ঠেলে দিবে। যে সমস্ত ব্যক্তিদের এই প্রচারে লিপ্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার তথ্য নেই। তাই আশঙ্কা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে যত রাজনৈতিক বিভাজন চলবে ততই এই মৌলবাদী শক্তির বিকাশ ঘটবে।
দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশিীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরী। দাতা সংস্থাগুলো পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার শর্ত জুড়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের ভাগ্যেও এই ধরনের শর্ত জুটবে। বাংলাদেশ যতক্ষণ পর্যন্ত আইপিএস- এ যোগ না দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নানা শর্ত চলতেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক।