বৈশাখের ও নববর্ষের মতো আনন্দ
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের যে উৎসব তার সবটা ধর্মমুখী নয়। বাংলার সার্বজনীন উৎসব 'বৈশাখ' ও ধর্মমুখী নয়! প্রচলনের একেবারে শুরুতে ছিল মূলত 'কৃষিমুখী' এবং ক্রমশ সেটা খাজনা আদায় আর নবান্ন (নতুন ফসল তোলার আনন্দময় দিন) মুখী হয়। শুরু থেকেই এটা ছিল ব্যতিক্রম এবং আজও এটা একই পথে হাঁটছে! বৈশাখকে পকেটজাত করার চেষ্টা ছিল ধর্মাশ্রয়ী শাসক আর ধর্ম ব্যবসায়ীদের! আজও এই চেষ্টা আছে কর্পোরেটদের! গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক সে যেমন একই গন্ধ বিলাবে, বৈশাখও তাই। জল কেটে যেমন আলাদা করা যায় না তেমনি বাঙালির সত্ত্বা থেকে বৈশাখকে আলাদা করা অসম্ভব।
এদেশের মানুষ ইংরেজি নববর্ষের শুরুর আগের দিনটাকে 'থার্টি ফার্স্ট' নামে খুব ভালো করে চেনে। এটা শুরু হয় মধ্যরাতে। বৈশাখ শুরু হয় সূর্যোদয়ের সাথে সাথে। বৈশাখ সূর্যাস্তের সাথে সাথে ঘুমের দিকে চলে যেতে থাকে। থার্টি ফার্স্টে মদের বারগুলোতে উপচে পড়া ভিড় বা হুজ্জত হাঙ্গামা এড়াতে পুলিশ এখন বাধ্যতামূলক বার বন্ধ রাখতে বলে। বৈশাখের সাথে কোনকালেই 'মদ্যযোগ' ছিল না, আনন্দটাই ছিল মুখ্য! এই আনন্দ ছিল মেলায়, এই আনন্দ ছিল খোলা মাঠ কিংবা হাঁটে, নদীর মোহনায়, বটতলায় কিংবা বাউলের গানে। আনন্দ ছিল নতুন খাবার,মুড়ি, মুড়কি, লাড্ডু কিংবা পায়েসে, নতুন চালের সুবাসে। আনন্দ ছিল হালখাতায়, আনন্দ ছিল নবান্ন উৎসবে। বৈশাখের আনন্দ মিলনে, বিভাজনে নয়!
অন্যদিকে ইংরেজরা 'হ্যাপি নিউ ইয়ার' পালন করতে কত কিছুই না করে। শুনেছি রাশানরা মধ্যরাতের আগে কাব্য করে কিছু লেখে রঙিন কাগজে। এরপর সেই কাগজ পুড়িয়ে ধূসর বর্ণ ছাই মেশায় হুইস্কি, ভদকা বা শ্যাম্পেনের সঙ্গে! হয়তো কোন শুভকামনা পান করে অথবা এটাকেই কেউ কেউ প্রার্থনা ভাবে। হিন্দু পুরাণে যেমন '১০৮টি নীলপদ্মের' ঘটনা আছে (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে-ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি/দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়/ বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টি নীলপদ্ম!') তেমনি জাপানিরা বছরের শেষ দিনে প্যাগোডাতে ১০৮ বার ঘণ্টা বাজায়। বিশ্বাস তাদের এমন যে, এই ১০৮ কারণেই পৃথিবীতে দুঃখ নেমে আসতে পারে! সুতরাং ঘণ্টা বাজিয়ে দুঃখ বিদায় করে নতুন বছরের শুরুতে সুখ কামনায় আনন্দ করা যাক!
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈসাবি (ত্রিপুরা জনগোষ্ঠির 'বৈসুক',মারমাদের 'সাংগ্রাই' আর চাকমাদের 'বিজু' এই তিন মিলিয়ে বৈসাবি) সংক্রান্তির মতো ভারতের মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম কিংবা থাইল্যান্ডে নববর্ষ শুরু হয় পানি ও রং ছিটিয়ে। ছেলেরা মেয়েদের ছিটায়,মেয়েরা ছেলেদের। রোগ-শোক-জরা সব যেন মুছে ধুয়ে দিয়ে যায় জল- বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে সেই কামনাই তুলে ধরা হয়।
ইরানিরা তাদের বর্ষবরণ 'নওরোজ' উৎসবে একদা রঙিন খামে চিঠি লিখতো আর উপহার পাঠাতো প্রিয় মানুষদের। নওরোজ এখনও সাতদিন ধরে পালন করা হয়ে থাকে অনেকটা বাংলাদেশি টেলিভিশন চ্যানেলের সাত দিনব্যাপী ঈদ উৎসবের মতো। প্রায় একই রকম রেওয়াজ ছিল চীনাদের বর্ষবরণ উৎসবে। চীনারা রঙিন সাজে সাজতে পছন্দ করে খুব। পৃথিবীর অনেক দেশের হ্যালোউইন উৎসবও তাই। রঙিন আর সাজসজ্জা নির্ভর। উৎসব সবসময় রঙিন হবারই কথা।
আরবেও একসময়, মক্কা-মদিনায় বর্ষবরণের প্রথা হিসেবে নওরোজই পালিত হতো। পরে ঈদ উৎসব পালন শুরু হয়!
বর্ষবরণের উৎসব জাতিভেদে আলাদা আলাদা। ভিয়েতনামে যে খৃস্টানরা বসবাস করেন, পহেলা জানুয়ারি তাদের মুখ্য বর্ষবরণের উৎসব নয়। তাদের বর্ষবরণের উৎসবের নাম 'তেত' যার দিন তারিখ আলাদা। ইহুদিদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম 'রাসহাসানা' কিন্তু একজন জার্মান বা একজন অ্যামেরিকান ইহুদির মুখ্য বর্ষবরণ উৎসব আলাদা। বর্ষবরণ উৎসব জাতিভেদে ভিন্ন কিন্তু বেশিরভাগ বর্ষবরণ উৎসব ধর্ম প্রভাবিত নয়! বৈশাখও তেমন নয়, তবু কেমন একটা চোখ রাঙানি চলে আসে কখনো সখনো। যদিও এটা নতুন নয়।
'চোখ রাঙানি' প্রয়োজন হয় 'দাবায়ে' রাখতে কিংবা শোষণ করতে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে বাংলা নববর্ষ পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ফলাফল খুব স্বল্প সময়ে পাকিস্তানিরা এই বঙ্গের সরকারকে (জিতেছিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিল তৎকালীন ক্ষমতার দোসর মুসলিম লীগ) উৎখাত করেছিল। এরপর থেকেই ক্রমশ আরও বেশি বাঙালির প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল। রমনার বটমূলে বৈশাখ উদযাপন হয়ে দাঁড়ায় বাঙালির শিল্পিত প্রতিবাদ। ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান বাঙালির নববর্ষ পালনকে 'হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব' বলে মন্তব্য করেছিলেন। কেউ কেউ এখনও এর বাইরে বের হতে পারে নি।
নববর্ষের আনন্দ ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক নয়, জাতিভেদে নববর্ষ পালনের রেওয়াজ হয়তো আলাদা, কিন্তু উৎসবের রঙ কিন্তু এক।
মঙ্গল শোভাযাত্রা আসলে আনন্দ আর মঙ্গল কামনায় মানুষের সামষ্টিক রঙিন উপস্থিতি। মায়ের কোলে শিশু যেমন, বৈশাখের কাছে বাঙালিও তেমন, বাঙালির কাছে বৈশাখও তেমন।
নতুন বছর আর সদ্যোজাত শিশু আসার আনন্দই আলাদা। মঙ্গল শোভাযাত্রার রঙিন পাখির মতো বৈশাখের আনন্দে রঙিন হোক বাঙালি, আনন্দে ভেসে যাক বাংলাদেশ!
- আহসান কবির: রম্যলেখক