ইয়েমেনে সৌদি আরব-ইরানের প্রক্সি যুদ্ধ ও চীনের মধ্যস্থতা: কী হতে পারে সামনের দিনগুলোতে
'আমরা কেবলই একটা রণক্ষেত্র,' এক তরুণ ইয়েমেনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন কথাটি। আক্ষরিক অর্থেই ইয়েমেন যুদ্ধ একটা অন্তহীন ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। গত আট বছর ধরে চলমান এই সংঘাত মূলত সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত রাষ্ট্রপতি মনসুর হাদির সরকার এবং ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত হিসেবে। ২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হাদির পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। সৌদি জোটের বিমান হামলা বেসামরিক অবকাঠামো ও নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি করে। আর তার ফলে ইয়েমেন যুদ্ধ পরিণত হয় একুশ শতকের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ে।
ইউএন অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অভ হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স (ওসিএইচএ) অনুসারে, এ যুদ্ধের ফলে আনুমানিক দুই লাখ ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্য এক লাখ ৩১ হাজার মারা গেছেন পরোক্ষ কারণ যেমন খাদ্য, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং অবকাঠামোর অভাবে। এক কোটি ১০ হাজারের বেশি শিশু মানবিক বিপর্যয়ের শিকার — প্রায় ২২ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। ৪৫ লাখের বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই অনিরাপদ শিবিরে বাস করছেন। স্কুল ও হাসপাতালসমূহের ক্ষতি এবং বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে লাখো শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়েছে।
ইয়েমেনের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটির ওপর প্রভাব বিস্তার করা সৌদি আরব ও ইরানের কাছে বেশ প্রয়োজনীয়। বাব আল-মান্দেব প্রণালির কারণে ইয়েমেন এ দুই দেশের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বাব আল-মান্দেব প্রণালি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
বাব আল-মান্দেব লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরকে সংযোগকারী একটি প্রণালি যেটি আরব উপদ্বীপে অবস্থিত ইয়েমেন এবং হর্ন অব আফ্রিকা অন্তরীপে অবস্থিত জিবুতি, ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়াকে পৃথক করেছে। আরবিতে বাব আল-মান্দেবের অর্থ দুর্দশার দুয়ার, ইয়েমেনের জন্য শব্দার্থটি রীতিমতো পরিহাস। এটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহ রুটের একটি। এর মধ্যে দিয়ে সৌদি আরব এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলো থেকে ইউরোপ এবং এশিয়ায় প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং পেট্রোলিয়াম পণ্য চলাচল করে। আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সমুদ্রবাণিজ্য ও বাণিজ্যের জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ।
কিন্তু বাব আল-মান্দেব প্রণালি কেবল অর্থনৈতিক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি একটি কৌশলগত চোকপয়েন্টও বটে। প্রায়শই ইরান হুমকি দেয়, তারা চাইলেই হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার মতো এই বাব আল-মান্দেব প্রণালি বন্ধ করে দিলেও সারা বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যাবে। কারণ এ পথ ছাড়া সুয়েজ খাল দিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার পশ্চিমে তেল পাঠানো সম্ভব নয়। তখন তেল পাঠাতে হবে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে, পুরো আফ্রিকা ঘুরে। আর সৌদির জন্য এটা খুবই খারাপ সংবাদ, কারণ তাদের পূর্বের হরমুজ প্রণালিতে বৈরী ইরান। আর তা এড়াতে তারা পূর্ব থেকে পশ্চিমে স্থলপথে তেল পরিবহন করে; তারপর সেটা ট্যাংকারে ভরে মান্দেব প্রণালি দিয়ে ইউরোপ রপ্তানি করে। তাই ইরান যদি কোনোভাবে মান্দেব প্রণালিকে আটকে দিতে পারে, তাহলে সৌদির তেল রপ্তানিব্যবস্থা পঙ্গু হয়ে যাবে।
এজন্যই ইরানি-সমর্থিত শিয়া হুতিরা বিদ্রোহের মাধ্যমে হাদিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এডেনের দিকে অগ্রসর হলে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ করেছিল ২০১৫ সালের মার্চে। এ জোটের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল হাদির বৈধতা পুনরুদ্ধার করা, ইরানের প্রভাব মোকাবিলা করা এবং সৌদি আরবের দক্ষিণ সীমান্ত সুরক্ষিত করা। পাশাপাশি এ হস্তক্ষেপের আরেকটি মূল কারণ ছিল সৌদি আরবের তেলের স্বার্থ রক্ষা করা এবং মান্দেব প্রণালির ওপর দেশটির নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।
২০১৯ সালে ইরান প্রথমবারের মতো স্বীকার করে যে তারা হুতিদের 'পরামর্শমূলক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন' প্রদান করেছে। মার্কিন বিশেষজ্ঞরা আরও সন্দেহ করেছেন, ইরান হুতিদের অত্যাধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সহায়তাও দিয়েছে। হুতিরা সেসব অস্ত্র দিয়ে প্রণালির মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করা সৌদি তেল ট্যাংকার এবং জাহাজগুলোতে একাধিকবার ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট এবং ড্রোন দিয়ে হামলা করেছে। ইয়েমেনে সৌদি জোট তাদের বিমান হামলা ও অবরোধ অব্যাহত রাখলে হুতিরা প্রণালি অবরোধ করার হুমকি দিয়েছিল। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে প্রণালির মধ্যে পেরিম দ্বীপের কাছে দুটি সৌদি ট্যাংকার হুতিরা আক্রমণ করেছিল, তখন সৌদি আরব অস্থায়ীভাবে প্রণালির মধ্য দিয়ে তার তেলের চালান স্থগিত করে দেয়।
হুতিদের সমর্থন করার পেছনে ইরানের উদ্দেশ্য জটিল এবং বহুমুখী। এর একটি কারণ হলো ইরান ইয়েমেন এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবের প্রভাব ও স্বার্থ মোকাবিলায় হুতিদের একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে দেখে। হুতিদের কাজে লাগিয়ে সৌদিকে নিজের উঠানে শত্রুর মুখোমুখি করাতে চায় ইরান। আবার হুতিদের ব্যবহার করে মান্দেব প্রণালির মধ্যে দিয়ে সৌদি আরবের তেল রপ্তানি এবং সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল ব্যাহত করতে পারে দেশটি।
এছাড়া সিরিয়া, ইরাক এবং লেবাননের মতো অন্যান্য আঞ্চলিক ইস্যু থেকে সৌদি আরবের মনোযোগ ও রিসোর্স সরিয়ে নিতে ইরান ইয়েমেনি সংঘাতকে কাজে লাগাতে পারে। পাশাপাশি ইরান শিয়া মুসলিমদের নেতা হিসেবে ইসলামিক বিশ্বে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে এ সংঘাতকে ব্যবহার করছে। ইরাক থেকে লেবানন পর্যন্ত নানা প্রক্সি গ্রুপকে কাজে লাগিয়ে ইরান সুন্নি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, যার একটা অংশ হলো ইয়েমেনের হুতিরা।
সৌদির জন্য মান্দেব প্রণালি দরকারি। কারণ প্রণালি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সৌদি আরব পূর্ব আফ্রিকা এবং হর্ন অভ আফ্রিকা জুড়ে তার শক্তি এবং প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সৌদি আরব জিবুতি, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে তার অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক প্রসারিত করছে। এ দেশগুলো কৌশলগতভাবে লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত। তারা ইয়েমেন, ইরাক, সিরিয়া এবং লেবাননে ইরানের উপস্থিতিকে প্রতিরোধ করার জন্য কাজ করে। এর অংশ হিসেবে সৌদি আরব জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে । ২০১৬ সালে সৌদি আরব জিবুতির সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে।
কিন্তু বাব আল-মান্দেব প্রণালি নিয়ন্ত্রণ করাও সৌদি আরবের জন্য চ্যালেঞ্জ। ইয়েমেনের যুদ্ধ একটি ব্যয়বহুল এবং রক্তক্ষয়ী সামরিক হস্তক্ষেপ যেখানে সৌদি জোট মানবিক সংকট ও যুদ্ধাপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক সমালোচনার শিকার হয়েছে। হাদির কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার, হুতিদের পরাজিত করা বা একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিশ্চিত করার মতো প্রধান লক্ষ্যগুলো অর্জন করতেও এ যুদ্ধ ব্যর্থ। উলটো, এটি একটি মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে যা লক্ষ লক্ষ ইয়েমেনিকে দুর্ভিক্ষ, রোগ এবং বাস্তুচ্যুতির সম্মুখীন করেছে। এটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত, আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এবং আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের মতো গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী হুমকিকেও ইন্ধন দিয়েছে।
পাশাপাশি বাব আল-মান্দেব প্রণালি নিয়ন্ত্রণ করা এ অঞ্চলে সৌদি আরবের নিরাপত্তা বা আধিপত্যের নিশ্চয়তা দেয় না। প্রণালিটি এখনও ইরান, তুরস্ক, রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন।
চীনের মধ্যস্থতা কি শেষ করতে পারে ইয়েমেন যুদ্ধ?
চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে আলোচনা চলছে। দুই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কূটনৈতিক অগ্রগতির বিস্ময়কর ঘোষণার পর অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে: ইয়েমেন যুদ্ধে কি তাহলে অবশেষে শেষ হতে পারে?
সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে চুক্তিতে বলা হয়েছে, উভয় দেশ একে অপরের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করবে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়কেও উৎসাহ দেবে। তবে চুক্তিটি বাস্তবায়িত হওয়া এখনো সম্পূর্ণ নিশ্চিত নয়। চুক্তি বাস্তবায়িত হতে হলে উভয় দেশের রাজনীতিবিদ ও সরকারদের সদিচ্ছা থাকতে হবে।
সৌদি আরব এবং ইরান কয়েক দশক ধরে অনেকগুলো প্রক্সি যুদ্ধ করেছে। তবে সম্ভবত সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রক্সি যুদ্ধ হয়েছে ইয়েমেনে। এখন যদি চুক্তিটি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। এক, এ চুক্তি শত্রুতা হ্রাস এবং শান্তি আলোচনার পুনরায় শুরু হওয়ার পথ প্রশস্ত করবে। ফলে ইয়েমেনে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এবং দুই, সংঘাত কমবে, কিন্তু থামবে না। কারণ যুদ্ধ সৌদি আরব এবং ইরান ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, তুরস্ক ও চীন দ্বারা প্রভাবিত।
চীনের জন্য ইয়েমেন যুদ্ধে মধ্যস্থতা করার অনেক কারণ আছে। চীন ইয়েমেনের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং বিনিয়োগকারী — বিশেষ করে ইয়েমেনের জ্বালানি খাতে। চীন তার তেল আমদানি এবং বাণিজ্য রুটের জন্য বাব আল-মান্দেব প্রণালির ওপর নির্ভর করে। চীন ইয়েমেন যুদ্ধে একটি সতর্ক ও বাস্তববাদী পন্থা অবলম্বন করেছে, একটি রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে, মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে এবং সকল পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছে। চীনের প্রধান স্বার্থ হলো তার নাগরিক ও সম্পদ রক্ষা করা, তার শক্তি ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত করা এবং দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে তার ভূমিকা বৃদ্ধি করা।
চীন যদি সৌদি সমর্থিত সরকার এবং ইরান সমর্থিত হুতিদের সাথে বসে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে চায়, তবে এটি অনেক চ্যালেঞ্জ এবং অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হবে। প্রথমত, চীনকে সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে অবিশ্বাস এবং শত্রুতা কাটিয়ে ওঠাতে হবে। দ্বিতীয়ত, চীনকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার এবং তুরস্কের মতো অন্যান্য দেশের সঙ্গেও আলোচনায় বসতে হবে। তৃতীয়ত, চীনকে ইয়েমেনের জটিল এবং খণ্ডিত স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর মোকাবিলা করতে হবে। চতুর্থত, চীনকে ইয়েমেন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথেও নেগোসিয়েশন করতে হবে। কাজেই কেবল সৌদি-ইরান চুক্তি দিয়ে ইয়েমেন যুদ্ধের সমাপ্তি টানা সম্ভব নাও হতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।