তামাক: শুধু করারোপ নয়, কড়া নজরদারিও চাই
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছ থেকে বাংলাদেশ ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ গ্রহণ করছে, তার একটি কিস্তি ইতিমধ্যে ব্যবহার হয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক সংকটকালে এই ঋণের প্রয়োজন ছিল। তবে আইএমএফের ঋণের সাথে শর্ত দেয়া থাকে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে যথেষ্ট রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। জিডিপির ০.৫% পরিমাণ বাড়তি রাজস্ব ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ আইএমএফের ঋণ পরিশোধের বোঝাটা জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে। আমরা জানি বিশ্ব অর্থ লগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেয় উন্নয়নের নামে, সে উন্নয়ন হোক বা না হোক জনগণকেই এই ঋণের বোঝা বইতে হয়, এটা নতুন কিছু নয়। এবং এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, অধিকাংশ গরিব দেশে বা স্বল্পন্নোত দেশের চিত্র একই। ঋণের দায় নিয়েই জন্মগ্রহণ করে আজকের প্রতিটি শিশু।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই রাজস্ব কীভাবে বেশি করে সংগ্রহ করবে সেই চিন্তা নিশ্চয়ই তাদের আছে। বাজেটে বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের ওপর কম-বেশি করারোপ করা হয়। এতে জনগণ বাড়তি চাপ অনুভব করলেও, এবং রাজনৈতিক দল "বাজেট মানি না" স্লোগানে মুখর হলেও তা কোনো কাজে লাগে না। বাজেট ঘোষণার এক মাসের মাথায় তা গৃহীত হয়ে যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশি করে করারোপ করে এবং নির্দিষ্ট পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে রাজস্ব বাড়ানো যায় এবং একই সাথে এর ব্যবহার কমিয়ে জনস্বার্থ রক্ষা করা যায়। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে তামাকদ্রব্য, যেমন বিড়ি, সিগারেট, জর্দা এবং গুল। ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য করের আওতায় আনা হয়েছে। এই পণ্যের সেবনকারীর সংখ্যা মোট প্রাপ্তবয়স্ক বা ১৫ বছরের বেশি বয়সের জনসংখ্যার ৩৫.৫%। প্রায় প্রতি তিনজনের একজন কোনো না কোনো প্রকার তামাকদ্রব্য সেবন করছেন এবং নানা রকম রোগে আক্রান্ত হবার কারণে স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে, বছরে যা প্রায় ৩০,৫৬০ কোটি টাকা। অথচ ২০২২-২৩ সালের স্বাস্থ্য খাতের বাজেটই ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। এই বিপুল অংকের ব্যয়ের একটি বড় অংশ জনগণকে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়। সবদিক বিবেচনা করলে তামাকের ব্যবহার কমানোর জন্যে বিক্রয় ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা একান্তই জরুরি। বিষয়টি তামাক নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রমের জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ।
তামাকদ্রব্যের ওপর করারোপের সময় সিগারেটের ওপর কর বাড়িয়ে দেওয়ার বিষয়ে অনেক হিসাব-নিকাশ করা হয়। কর বাড়াতে হবে এই বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এমনকি সম্ভবত খোদ সিগারেট উৎপাদক কোম্পানিও খুব তর্ক করবে না। কিন্তু কত এবং কী হারে বাড়ানো হবে তা নিয়েই দেনদরবার হয়। এবং দেখা যায় একদিকে তামাক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সংগঠন সোচ্চারভাবে কর আরোপ নিয়ে প্রস্তাব দিচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানি তার নিজস্ব কায়দায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছে। এই হস্তক্ষেপের বিষয়টি খুব গোপন থাকে না এবং তার বিরুদ্ধেও তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনদের নজরদারি জারি রাখতে হয়। বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশান অন টোবাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে এমন হস্তক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে না। এই কনভেনশানের ৫.৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রতিটি দেশ তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য গৃহীত নীতি এবং আইনকে তামাক কোম্পানির বাণিজ্যিক এবং কায়েমী স্বার্থ থেকে রক্ষা করবে। দেখা যায় সচিত্র সতর্কবাণী দেয়া এবং সিগারেটের ওপর করারোপের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানিগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ যেন রক্ষা হয় সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
যথারীতি তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেট, বিড়ি, জর্দা এবং গুলের ওপর নির্দিষ্ট হারে কর বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে। তারা ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রস্তাবগুলো দিয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে আইএমএফের শর্ত পূরণে তামাকজাত দ্রব্যের মতো ক্ষতিকর দ্রব্যের দাম বাড়ালে জনস্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে ।
তামাকদ্রব্য ব্যবহার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এই কথা তামাকসেবী নিজেও স্বীকার করবেন। কারণ তার তো নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা হতেই থাকে। এর ভুক্তভোগী তার সাথে সাথে তার পরিবারের সদস্যরাও অর্থনৈতিকভাবে হয়, সেসব কথাও এখন আর নতুন নয়। উল্লেখ করার বিষয় হচ্ছে, এবারের তামাক কর প্রস্তাবের আলোচনায় এসেছে আইএমএফের ঋণ পরিশোধের জন্য যে বাড়তি রাজস্ব দরকার এবং তা তামাকের মতো ক্ষতিকর পণ্যের ওপর উচ্চ করারোপ করে নেওয়া যেতে পারে, সে বিষয়টি। সেটা সম্ভব। সিগারেটের সমপূরক শুল্ক, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সার চার্জ, ও ভ্যাট থেকে ৪২.৩ হাজার কোটি টাকা অর্জিত হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের তুলনায় ৯.৬ হাজার কোটি টাকা বেশি।
এটা উদ্বেগের বিষয় যে সিগারেটের ওপর করারোপের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় জিডিপির আনুপাতিক হারে ক্রমে কমে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেখিয়েছে, ২০১৮-১৯ সালে সরকারি রাজস্ব আয়ের ১১% অথবা জিডিপির ১% সিগারেটের কর থেকে আসত। কিন্তু তা ক্রমেই কমে গিয়ে ২০২১-২২ সালে রাজস্ব আয়ের ৮.৪% এবং জিডিপির ০.৮% হয়ে যাচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে তারা বিক্রয় কম দেখাচ্ছে, অর্থাৎ সরাসরি কর ফাঁকি দিচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে এই ধরনের কর ফাঁকির অনেক চিত্র উঠে এসেছে।
তামাকদ্রব্যের মধ্যে সিগারেট নিয়েই বেশি আলোচনা হয় এবং করারোপের ক্ষেত্রেও সিগারেটের ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে যায়, কারণ সিগারেট কোম্পানির প্রভাবে সিগারেটের চার-স্তর ভাগ করে করারোপের বিধান করা হয়েছে যা পৃথিবীর খুব কম দেশেই আছে। এবং আন্তর্জাতিকভাবেই এই স্তরভাগের বিষয়টি ত্রুটিযুক্ত মনে করা হয়। বলাবাহুল্য, এই স্তর ভাগের বিষয়টি তামাক কোম্পানির প্রভাবেই করা হয়েছে।
করারোপের কারণে সিগারেট বেশি দামে বিক্রি হলেই সেই টাকা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কোষাগারে ঢুকবে এমন কথা নেই। সাংবাদিক সুশান্ত সিংহা বিশেষ প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন যে সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে যে দাম লেখা থাকে সেই দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়, যেমন সিগারেটের গায়ে ২৮৪ টাকা লেখা আছে বিক্রি হচ্ছে ৩২০ টাকায়; কিংবা ৮০ টাকা লেখা রয়েছে, বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সর্ব্বোচ্চ খুচরা মূল্য বা MRP-Maximum Retail Price, নির্ধারণ করে দেয়। এই দামের মধ্যেই সরকারের ট্যাক্স-ভ্যাট-সিগারেট কোম্পানির উৎপাদন-বিপণনের কমিশন অন্তর্ভুক্ত। এনবিআর সদস্য জাকিয়া সুলতানা (মুশক নীতি) এবং চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রাহমাতুল মুনিম এই ধরণের বাড়তি মূল্যে বিক্রিকে অবৈধ বলেছেন। সাংবাদিক সুশান্ত সিনহা হিশাব করে দেখিয়েছেন যে কোম্পানি প্যাকেট প্রতি দাম এবং শলাকা প্রতি দামের মধ্যে হিশাবের গড়মিল করে অতিরিক্ত দাম হাতিয়ে নেয়। যেমন একটি সিগারেট ব্রান্ডের প্রতি শলাকা ৮ টাকা, ২০ শলাকার প্যাকেট ১৬০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু প্যাকেটের গায়ে লেখা আছে MRP ১৩০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি প্যাকেট ৩০ টাকা এবং শলাকা প্রতি ১.৫০ টাকা বাড়তি নেয়া হচ্ছে। এনবিআর এর হিশাবে প্রতিদিন ২০ কোটি শলাকা বিক্রি হয়, সেক্ষেত্রে প্রতিদিন প্রতি শলাকায় ১ টাকাও বেশি নিলে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা বাড়তি পাচ্ছে কোম্পানি, যা দেখার কেউ নেই [একাত্তর টিভি প্রতিবেদন, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩]।
ভোরের কাগজে [১৭ অক্টোবর, ২০২২] এনবিআর এর বরাতে একই কথা আরো বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে নিম্নস্তরে সিগারেটে (১০ শলাকা) ৫৭ টাকা, মধ্যমস্তরে ৬৫ টাকা, উচ্চস্তরে ১১১ টাকা ও অতি উচ্চস্তরে ৬৫ টাকা সম্পূরক শুল্ক দিতে হয়। সঙ্গে রয়েছে ১৫ টাকা ভ্যাট ও এক শতাংশ হারে সারচার্জ। সে হিসাবে প্রতিদিন নিম্নস্তরে বাড়তি বিক্রি করা সিগারেটে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ১২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা এবং অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যমস্তরে হারাচ্ছে প্রায় দুই কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর চার স্তরের সিগারেট থেকে মাসে প্রায় ৪১০ কোটি ৪০ লাখ এবং বছরে প্রায় ৪ হাজার ৯৯৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। এছাড়া সিগারেটের প্যাকেটে খুচরা মূল্যের আগে 'সর্বোচ্চ' শব্দ লেখা নেই। আর তাতেই প্রতিদিন সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে প্রায় ২০ কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত চলে যাচ্ছে, যা মাসে প্রায় ৬০০ কোটি আর বছরে দাঁড়ায় প্রায় ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই টাকা বৈধভাবে নিলে সরকারের কোষাগারে যেতে পারত।
তামাক কোম্পানির কর ফাঁকি দেওয়ার আরো নানা অভিনব পন্থার খবর সংবাদে আসে। তারা বাজেট ঘোষণার আগে সর্ব্বোচ্চ দাম না লেখা এবং নতুন মোড়ক তৈরিতে সময় ক্ষেপণ করার কৌশল অবলম্বন করে। এনবিআর এর হিসাবে এভাবে সরকার প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে।
এনবিআরের দিক থেকে রাজস্ব হারানোর বিষয়টি উদ্বেগজনক হলেও তারা বিষয়টি নজরদারিতে রাখেনি। তারা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছে অবশ্যই। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এখন বিষয়টি সাংবাদিকদের নজরে এসেছে এবং তারা অংক কষে ক্ষতির হিসাব বুঝিয়ে দিচ্ছেন বলে আমরা জানতে পারছি।
তবে এ কথা পরিষ্কারভাবে বলা দরকার যে আইএমএফের ঋণ পরিশোধের জন্য তামাকদ্রব্যের ওপর করারোপ বেশি করে বেশি রাজস্ব পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পেলেও আমাদের দেখতে হবে এর ফলে তামাক ব্যবহার কমছে কি না। করারোপের কারণে যদি সিগারেট-বিড়ি-জর্দার দাম উল্লেখযোগ্যভাবে না কমে, সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারী বেশি দামে কিনলে তাতে কোম্পানি এবং এনবিআর সন্তুষ্ট হবে, কিন্তু তামাক নিয়ন্ত্রণের উদেশ্য সফল হবে না। রাস্তাঘাটে চায়ের দোকানে, বাস স্ট্যান্ডে, ফুটপাতে দাঁড়িয়ে সিগারেট (চারটি স্তরের যেকোনো একটি) সেবন করছে, পানের সাথে জর্দা খাচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে পান-জর্দা সেবন কমছে না। নাটকে, সিনেমায় সিগারেটের প্রচার বেড়ে গেছে। তার অর্থ হচ্ছে করারোপ করে দাম কিছুটা বাড়লেও তা এখনো ক্রেতা বা ভোক্তার নাগালের মধ্যেই আছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তামাক দ্রব্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। দোকানে খুচরা শলাকা আকারে সিগারেট-বিড়ি বিক্রি হচ্ছে, জর্দাও কৌটা ছাড়া খুচরা বিক্রি হচ্ছে। তাহলে ক্রেতা একবারে ৮-১০ টাকাকে বেশি সমস্যা হিসেবে দেখছে না। তার তো এটা নেশা! তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনে তাই সকল প্রকার তামাকদ্রব্য খুচরা বিক্রি নিষেধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আমাদের রাজস্ব লাগবে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের জনস্বাস্থ্য অবস্থাও উন্নত করতে হবে। তামাকসেবীদের এই ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার থেকে সরিয়ে একটি সুস্থ জীবন দিতে এগিয়ে আসুন।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী