বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াবে ও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ করবে জাপান: রাষ্ট্রদূত
দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত হওয়ায় বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতার মাত্রা আরো বিস্তৃত করতে ইচ্ছুক জাপান, জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এডিটর ইনাম আহমেদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইওয়ামা কিমিনোরি বাংলাদেশে সম্ভাব্য জাপানি বিনিয়োগসহ আরো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর জোর দিয়েছেন।
জাপান বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী বন্ধু। স্বাধীনতার পর থেকে জাপান আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়তা করে আসছে। এর জন্য আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। গত মাসে এই দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীরা দেখা করে একটি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অংশ নেন। সেখানে তারা এই দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করার ইচ্ছা পোষণ করেন। এতে আসলে কী পার্থক্য রয়েছে?
কী পরিবর্তন হয়েছে আর কী পরিবর্তন হয়নি তা নিয়ে মাত্র কয়েকদিন আগেই আমি একটি প্রেজেন্টশন দিয়েছি। ২০১৪ সালে জাপানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিস্তৃত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে একটি যৌথ বিবৃতিতে সম্মত হন। আপনি যদি ২০১৪ সালের ওই চুক্তি এবং এখনকার ডকুমেন্টের তুলনা করেন, তাহলে দেখবেন যে মৌলিক কাঠামো একই রয়ে গেছে।
আমরা তিনটি স্তম্ভে আমাদের সম্পর্ককে উন্নত করতে চাই। প্রথমত, রাজনৈতিক স্তম্ভ- যা এই অঞ্চলে এবং একইসাথে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে। দ্বিতীয়ত, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, আমরা পিপল-টু-পিপল এক্সচেঞ্জ প্রসারিত করতে চাই। এই তিনটি স্তম্ভ একই আছে, কিন্তু যা পরিবর্তিত হয়েছে তা হলো- আমরা সহযোগিতার পরিধি আরও বাড়াতে পারি।
যেমন, ২০১৪ সালে ফোকাস ছিল মূলত উন্নয়ন সহায়তার উপর। ২০২৩ সালে কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে যদিও আমরা উন্নয়ন সহায়তা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর জোর দিচ্ছি, এবার বাণিজ্য ও উন্নয়নের উপর আরো বেশি ফোকাস রয়েছে।
এখন যেহেতু বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে, আমরা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে পারস্পরিকভাবে উপকারী অংশীদার হওয়ার দিকে জোর দিচ্ছি। আমার বোধগম্যতা এবং আমার ব্যাখ্যা অনুসারে, আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করবে এটি।
আপনি বাণিজ্য ও বিনিয়োগের কথা বলেছেন, কিন্তু আমরা এখানে তেমন বিনিয়োগকারী আসতে দেখি না। সর্বশেষ বড় বিনিয়োগকারী ছিল জাপান টোব্যাকো। বিনিয়োগের মাত্রা এত কম কেন? জাপানে আমাদের রপ্তানিও কম। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা জাপানে গার্মেন্টস পণ্য পাঠিয়েছি কিন্তু এর পরিমাণ তেমন বেশি নয়। জাপান বেশ বড় একটি বাজার। এই ক্ষেত্রের জন্য কী করা যায়? বাংলাদেশে আসতে পারে এমন কোনো বড় বিনিয়োগকারীর তথ্য কি রয়েছে আপনার কাছে?
এটা সত্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতো বিনিয়োগকারী বা বাণিজ্য অংশীদারদের তুলনায় বাংলাদেশে জাপানি ব্যবসার পরিমাণ এত বেশি নয়। আপনি যদি লক্ষ্য করেন তাহলে দেখবেন, বেশকিছু জাপানি কোম্পানি রয়েছে যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। যদিও এ সংখ্যাটি অত বেশি নয়। এর কারণ কী হতে পারে তা নিয়ে আপনি কথা বলেছেন। এই দেশে জাপানি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো- জটিল অনুমোদন পদ্ধতি ও শুল্ক ছাড়পত্রে বিলম্ব।
বাংলাদেশে বিনিয়োগে জাপানি বিনিয়োগকারীদের অনেক বাধা রয়েছে। সাধারণভাবেই জাপানিরা খুব সতর্ক। কিন্তু একবার তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে করবে। আপনি বড় বিনিয়োগের কথা বলেছেন। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, আমরা গত বছরের ডিসেম্বরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বিএসইজেড প্রতিষ্ঠা করেছি।
যদিও এই মুহুর্তে বিনিয়োগকারীদের প্রকৃত সংখ্যা অত বেশি নয়; কিন্তু আমি প্রকল্প পরিচালকের কাছ থেকে যতদূর জেনেছি, এখানে বিনিয়োগের চাহিদা ও অনুসন্ধান অনেক বেশি। আমি কোনো কোম্পানি সম্পর্কে বিশেষভাবে বলতে পারবো না, তবে এটা বলতে পারি যে এখানে বিনিয়োগের প্রবণতা আছে, পরিস্থিতি আছে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো এবং নিরাপত্তা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলাদেশও সেই পরিকল্পনার একটি অংশ। কীভাবে এই অর্থ ব্যয় করা হবে এবং কীভাবে এটি এই অঞ্চলে কাজে দেবে? এক্ষেত্রে ভিশনটা কী?
আপনি হয়তো ভারতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পলিসি স্পিচ শুনেছেন যেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশ বা ভারতের মতো নির্দিষ্ট কোনো দেশের জন্য বরাদ্দের বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা নেই। আমাদের প্রতিশ্রুতি মূলত প্রতিটি দেশের অনুরোধের উপর ভিত্তি করে আসবে।
তাই বাংলাদেশ কত বরাদ্দ পাবে তা আমি বলতে পারছি না। অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখলে অনেক কিছুই হচ্ছে। আমরা ঢাকা বিমানবন্দর, মেট্রো রেলের টার্মিনাল থ্রি নির্মাণ করছি, আমরা লাইন সিক্স খুলে দিয়েছি এবং লাইন ওয়ান, লাইন ফাইভ এগুলোর কাজও করবো।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর অনেক বড় একটি প্রকল্প। সর্বোপরি, আমরা অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশাল বিনিয়োগের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আমরা তা চালিয়ে যাব।
এই মুহূর্তে পাইপলাইনে কোনো নির্দিষ্ট বড় অবকাঠামোগত বিনিয়োগ আছে কি? আপনি কি কোনো প্রকল্পের কথা বলতে পারবেন?
এই মুহুর্তে আমরা আগে থেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার দিকেই জোর দিচ্ছি।
জাপানের সমাজে বয়স্কদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। অভিবাসনের ক্ষেত্রেও জাপান খুবই রক্ষণশীল দেশ। এর মানে হলো, দেশের উন্নয়নের জন্য আপনাদের প্রচুর দক্ষ জনশক্তি এবং অ-দক্ষ শ্রমের প্রয়োজন। আপনি কি বাংলাদেশ থেকে জাপানে জনশক্তির বৃহত্তর অভিবাসনের কোন সুযোগ দেখতে পাচ্ছেন?
আমরা যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই, তাহলেই বুঝবো যে আমরা একটি বয়স্ক-সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের মুখোমুখি হচ্ছি। আমি জাপানি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জেনেছি যে তাদের মেধাবী এবং দক্ষ শ্রমশক্তি প্রয়োজন। বাংলাদেশ থেকে নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণির দক্ষ শ্রমশক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের একটি কাঠামো রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে দুটি ক্যাটাগরির (কৃষি ও নার্সিং) জন্য দক্ষতা পরীক্ষা শুরু করেছি।
আমি মনে করি, আপনার দেশ থেকে এই ক্যাটাগরিতে শ্রমশক্তি পাওয়ার সুযোগ থাকবে। কিন্তু চাহিদা অনেক বেশি। আমি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের অন্যান্য সেক্টরের সহকর্মীদের সাথে কথা বলেছি। আইসিটি খাতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক প্রকল্প এবং অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যার মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ, প্রতিভাবান আইসিটি সংশ্লিষ্ট লোকজন জাপানের কোম্পানিগুলো পরিদর্শন করবে এবং কাজ করবে। আমি মনে করি আগামী বছরগুলোতে এই পরিধি আরও বাড়বে।
পরিচর্যাকারী এবং নার্সদের কোনো ব্যাচ কি এরমধ্যে জাপানে গেছে?
আমি যেমনটা বললাম- ফ্রেমওয়ার্ক আছে এবং আমরা সবেমাত্র ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করতে শুরু করেছি। তাই সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে এখনই বলতে পারছি না।
মনে হচ্ছে এশিয়া একদিকে চীনের সাথে নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, আবার অন্যদিকে অকাস, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত একটি জোট গঠন করছে। এ অঞ্চলে বাড়তে থাকা উত্তেজনা কি আপনি দেখছেন? এটা কিভাবে আমাদের প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে? আমরা ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের সংঘাত নিয়ে ভীত। এ অবস্থায় আরেকটি সংঘাত বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি করবে। এই বিষয়গুলোকে আপনি কিভাবে দেখেন?
প্রথমত, আমি এশিয়া সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট জেনারেলাইজেশন করতে চাই না। আপনি ঠিক বলেছেন যে কিছু অঞ্চলে আমরা অস্থিতিশীলতা দেখতে পাচ্ছি। যেমন আমরা যদি আমাদের আশেপাশের অঞ্চলের দিকে তাকাই, যদি আমরা উত্তর কোরিয়ার দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো যে উত্তর কোরিয়া থেকে জাপানের দিকে ঘন ঘন ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের কারণে আমরা ভুগছি। এখানে বেশ কয়েকটি হটস্পট রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা হটস্পটগুলো কীভাবে এবং কী উপায়ে ম্যানেজ করতে পারি।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী পলিসি স্পিচে যে বিষয়টির উপর জোর দিয়েছেন তা হলো অন্তর্ভুক্তি। যদিও আমরা একটি মুক্ত এবং উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগের পক্ষে, তিনি অন্তর্ভুক্তির উপর বেশি জোর দেন। তিনি কানেক্টিভিটি প্রচার করতে চান যাতে জাপানি কোম্পানিগুলো এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তায় অবদান রাখতে পারে।
আমরা যা করতে চাই তা হলো, পৃথক অঞ্চল বা পৃথক জায়গার সাথে মোকাবিলা করা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা, স্থিতিশীল অর্থনীতি এবং জনগণের মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিতভাবে বিভিন্ন উপায়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখব। এই পদক্ষেপগুলো উত্তেজনা প্রশমিত করবে। সব ফ্যাক্টর যাতে একত্রিতভাবে কাজ করতে পারে সেটিই আমাদের নীতি।