ন্যাটো’র সম্প্রসারণ কি এখন এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে?
ন্যাটো'র সম্প্রসারণ কি এখন এশিয়ার দিকে ঝুঁকছে? আসন্ন লিথুনিয়ার সম্মেলন তেমন-ই ইঙ্গিত দেয়। ইউরোপের দেশগুলোর বাইরের – জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া এই ৪ দেশের প্রধানমন্ত্রীরা বর্তমানে লিথুনিয়ার ছোট্ট শহর ভিলনিয়াসে ন্যাটোর শীর্ষ নেতাদের সাথে একত্রিত হয়েছেন। আজ বুধবার দিন শেষে বোঝা যাবে, এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত, যা বিশ্বের ভূরাজনীতিতে অদূর ভবিষ্যতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
গত বছরের শীর্ষ সম্মেলনেও ন্যাটো বহির্ভূত দেশ – অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, এবং এশিয়ার জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া যোগ দিয়েছিল মাদ্রিদে। ইতোমধ্যে এবছর ন্যাটোর সচিব জাপান সফর করেছেন। জাপানে একটি লিয়াজোঁ অফিস করতে চায় ন্যাটো। ফলে যেটা ছিল গুঞ্জন, সেটাই এখন দৃঢ়তা পাচ্ছে। অর্থাৎ, ন্যাটো এশিয়াতে পা রাখছে। যদিও জো বাইডেন লিথুনিয়ার পথে নিউইয়র্ক ত্যাগ করার আগে, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়াটা সময়ের ব্যাপার বলেই উল্লেখ করেছেন; তথাপি এই সম্মেলনে, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম অথবা নেই বললেই চলে।
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামরিকভাবে মোকাবিলার বিষয়টি মাথায় রেখেই ন্যাটো গঠিত হয়েছিল। এই সামরিক জোটের বিপরীতে, সোভিয়েত বলয়ভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে ওয়ারশ চুক্তি করা হয়েছিল। পাল্টা-ব্যবস্থা হিসেবে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নামে করা ওয়ারশ জোট ন্যাটোর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯১ সালে পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে অনেকগুলো দেশের জন্ম হয়। একের পর এক দেশর স্বাধীনতা লাভের মধ্যে দিয়ে ওয়ারশ চুক্তি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
ওয়ারশ চুক্তি বিলুপ্ত করার সময়, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটোর সাথে একটি সমঝোতা হয়েছিল, সেটা হলো- ন্যাটো আর সম্প্রসারণ করা হবে না। ন্যাটো সেই সমঝোতা মেনে চলেনি। সোভিয়েতের ভাঙ্গনের পর পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশকে ন্যাটোর সদস্য পদ দেওয়া হয়। বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের নেপথ্যের আরেকটি কারণ ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্য-ভুক্ত করার সম্ভাবনা। এবারের ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনের অন্যতম বিষয়, ইউক্রেনের সদস্যপদ।
ন্যাটোকে প্রকৃতপক্ষে ধনী রাষ্ট্রগুলোর একটি সামরিক ফোরাম বলা যেতে পারে। পূর্ব ইউরোপের ছোট ছোট দু-একটি দেশ যাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ন্যাটোর অন্য সদস্য দেশগুলোর মতো নয়, তাদেরকেও ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেয়া হয়েছে কারণ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদেরকে কাজে লাগানো যাবে। আবার ন্যাটোর এশিয়ামুখী সম্প্রসারণে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া, অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ যে চারটি দেশকে একত্রিত করা হচ্ছে – তারা বিশ্ব অর্থনীতিতে অগ্রসর দেশ। জাপান এশিয়ায় চীনের পরে শীর্ষ অর্থনীতির দেশ। আর অর্থনীতিতে চীন ও জাপানের পরেই দ. কোরিয়ার অবস্থান এশিয়ায়।
এতদিন ধরে ন্যাটোর প্রধান ব্যয় বহন করত আমেরিকা। কিন্তু, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সে বিষয়ে মার্কিন জনগণকে সচেতন করে- ন্যাটোর অর্থায়ন কমিয়ে দেন। ফলে বর্তমান মার্কিন প্রশাসন এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের এই দেশগুলোকে তাদের সদস্যভুক্ত করতে চাইবে অর্থায়নের জন্য, এটাই স্বাভাবিক। অর্থায়নের বাইরে দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার মূল উদ্দেশ্য হয়তো, আগামী দিনে তাদের চীনের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোও।
প্রাথমিকভাবে ধারণা করতে হচ্ছিল, কোয়াড সদস্য দেশ হিসেবে ভারতকেও হয়তো ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হবে, কিন্তু তা করা হয়নি। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো আগামী দিনে বিশ্বকে আরো নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা মার্কিনীদের ডলারের সার্বভৌমত্ব যেন নির্বিঘ্ন থাকে, তারই পদক্ষেপ ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ। যদিও ন্যাটো-ভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলো ডলারে বাণিজ্য করে না, কিংবা জাপানও তার নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য করে। তবু এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি জাপান ও দ. কোরিয়াকে দলভুক্ত করতে পারলে -- চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে মার্কিনীরা, তারই ইঙ্গিত এশিয়ার এই দুইটি দেশকে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের আহ্বান।