নতুন সর্বভারতীয় মোর্চা কি আদৌ সফল হবে?
ভারতের স্বাধীনতার অগ্রভাগে থাকা রাজনৈতিক দল কংগ্রেস স্বাধীনতার পর একটানা ৩০ বছর দেশটির নেতৃত্ব প্রদান করেছিল। এবার এ কংগ্রেসের নেতৃত্বে নতুন এক ২৬ দলীয় জোট গঠিত হলো। ভারতের নির্বাচন কমিশন আইন অনুসারে এই ২৬টি দলের মধ্যে বেশ কয়েকটি জাতীয় পর্যায়ের দল। নির্বাচন কমিশনের এই আইনে আছে, সর্বভারতীয় আঙ্গিকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের ভোট কিংবা প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে রাজ্য পার্লামেন্টে।
'ইন্ডিয়া' নামক নতুন এ রাজনৈতিক জোটের সম্পূর্ণ রূপ হচ্ছে: 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স'। তবে 'ইনক্লুসিভ' হলেও জোটের দলগুলোর মধ্যে রাজ্য পর্যায়ের বিভাজন মারাত্মক — রাজ্য পর্যায়ের নেতৃত্বে সামাজিক কোনো সম্পর্ক নেই । যেমন পশ্চিমবাংলার তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে রাহুল গান্ধীদের কংগ্রেস কিংবা বামেদের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান খুবই বিপরীতমুখী। পরস্পরকে ন্যূনতম জায়গা দিতে প্রস্তুত নয় এই দলগুলোর রাজ্য পর্যায়ের নেতৃত্ব।
নিকট অতীতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে হতাহতের সংখ্যা ব্যাপক হয়েছে। কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল কংগ্রেস — সব দল বেশ কয়েকজন কর্মী হারিয়েছে এ নির্বাচনে। আর তা ঘটেছে এ দলগুলোর কর্মীদের মধ্যকার সরাসরি সংঘর্ষে। অথচ এ রাজনৈতিক নেতারা একত্রে বসে রাতের আহার শেষ করে কীভাবে ক্ষমতা দখল করা যাবে তা নিয়েই আলোচনা চালিয়েছেন কি না তা জানা যায়নি।
মমতা-রাহুলদের সর্বভারতীয় একটি রাজনৈতিক মোর্চা গঠনের এ প্রচেষ্টায় তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রথম থেকেই একটি নেতিবাচক অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। হঠাৎ করে কী কারণে মমতা ব্যানার্জি ব্যাঙ্গালোরের বৈঠকে উপস্থিত হলেন কিংবা মমতা ব্যানার্জিকে দিয়েই এ 'ইন্ডিয়া' নামের প্রস্তাব সোনিয়া গান্ধী উত্থাপন করলেন — তার রাজনৈতিক কৌশল বোঝা খুবই কঠিন। কিন্তু গত কয়েক বছরে মমতার তৃণমূল কংগ্রেসের ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক অবস্থান মূল্যায়ন করলে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের ভোট তৃণমূল কংগ্রেস পাবে না কিংবা তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট বাম কংগ্রেস পাবে না।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এমন একটি বিভাজন অবস্থা চলছে যেখানে কোনোভাবেই এই ভোট জোটে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। তাছাড়া নির্বাচনকেন্দ্রিক এ ধরনের জোট স্থায়ী সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭৭ সালে জনতা দলের নেতৃত্বে যে জোট গঠিত হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে স্থায়ী সরকারব্যবস্থা গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এটি। ১৯৬৫ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু পর সেই সময়কার জ্যেষ্ঠনেতা হিসেবে কংগ্রেসের মোরারজী দেশাইর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর কাছে দলীয় রাজনীতিতে মোরারজী দেশাই ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে তাকে ভারতের উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। সেই সময় ভারতের স্বাধীনতার পরে কংগ্রেসের প্রথম বিভাজন ঘটে। দেশাইর নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছিল। ওই দল পরবর্তীসময়ে জনতা দল নামে আবির্ভূত হয়। এ ইতিহাস থেকে প্রমাণিত হয় নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো জোট ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেয় হয়তো, কিন্তু সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনে না। যদিও সেই দুই বছরের সরকার চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল।
২৬ দলের নতুন এই জোট ভারতের আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে। এই জোটের মধ্যে সবচেয়ে অবিশ্বস্ত যে রাজনৈতিক দল, তা হচ্ছে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস। এই দলটি বিজেপির সঙ্গে একত্রে রাজ্য সরকার গঠন করেছে, অতীতে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করেছে। মমতা ব্যানার্জির জন্ম হয়েছিল কংগ্রেসের রাজনীতিতে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি কংগ্রেসবিরোধী অবস্থান থাকা সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধী তার প্রতি কেন আস্থা রাখছেন তা আগামী নির্বাচনের পরেই বোঝা যাবে।
শেষ পর্যন্ত এ জোট ভোট অব্দি টিকবে কি না সেটিও দেখার বিষয়। জোট গঠনের প্রাথমিক কাজটি হয়তো দলগুলো সম্পাদন করেছে কিন্তু গত কয়েক বছরের ঘটনাসমূহ পর্যায়ক্রমে আলোচনা করলে অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় তৃণমূলকে আস্থা করে যে জোট কংগ্রেস তৈরি করতে যাচ্ছে, তা হয়তো কোনো কার্যকর জোট হবে না।
আগামী ২ আগস্ট থেকে ভারতীয় উচ্চ আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা আর্টিকেল ৩৭০ বিলুপ্তি বিষয়ে পূর্ণশুনানির ব্যবস্থা করেছেন। এটি ভারতীয় রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কাশ্মীরকে বিশেষ অধিকার দেওয়া সংবিধানের এ অনুচ্ছেদটি গৃহীত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। চার বছর আগে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার সেই অধিকার বাতিল করেছিল। এই জোট ভবিষ্যতে কিংবা নির্বাচনের পূর্বে অথবা উচ্চ আদালতের শুনানির পরে এই ৩৭০ ধারা নিয়ে কী অবস্থান গ্রহণ করে, তাও দেখার বিষয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।