ভূরাজনীতির খেলায় সর্বদা সতর্ক কূটনৈতিক পদক্ষেপই কাম্য
পৃথিবী এবছর সবচেয়ে উষ্ণতম গ্রীষ্ম পার করলো। উত্তাপের এই প্রবণতা পরিবেশ-প্রতিবেশ ছাড়িয়ে মানুষের সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রবেশ করছে সমভাবে। গত শতাব্দীর শেষদিকে পৃথিবীর উৎপাদন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। পৃথিবী মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে প্রবেশ করে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, উৎপাদিত পণ্যের নতুন বাজার, যোগাযোগ ব্যবস্থায় নিত্য-নতুন আবিষ্কারের ফলে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ে – প্রয়োজনীয় পণ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন ৮০০ কোটি। গত তিন দশকে চীন সারা পৃথিবীর পণ্যবাজারের সিংহভাগ দখল করে নেয়– যেকারণে বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাশীল দেশগুলো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের ধারণা, চীন এভাবেই বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে। শুরু হয় চীনকে ঠেকানোর নানামুখী তৎপরতা।
চীনও বসে থাকেনি। বিশ্ববাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ ডলারের বিকল্প নিয়ে ভাবতে থাকে। উদীয়মান অর্থনীতির ৫টি দেশকে নিয়ে গঠন করে ব্রিকস।
বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকট, পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং মূদ্রাস্ফীতির চাপে প্রায় সকল দেশ। এরকম একটি মন্দা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি দেশ জাতীয়, আঞ্চলিক বা তার বাইরেও নানান ফোরামে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনই এক বিশ্ব পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভেদ ও বিভক্তি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা ও নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ দৃশ্যমান না হওয়ার কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও আতঙ্কজনক।
ক্ষমতাসীনদের দাবি, বিরোধীরা দেশে 'নৈরাজ্য' সৃষ্টি করতে চায়; অন্যদিকে বিরোধীদের দাবি, ক্ষমতাসীনরা 'গণতান্ত্রিক নয়' তারা 'কর্তৃত্ববাদি'। এই বিতর্কের 'মীমাংসার' দায়িত্ব নিয়ে হাজির হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকরা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন ছুটছেন কূটনীতিকদের পিছনে। কেউ 'নালিশ' জানাচ্ছেন, কেউবা 'নালিশের জবাব' দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে চলার পরামর্শ দিচ্ছে, ভিসানীতির কথা বলে প্রছন্ন হুমকি দিচ্ছে, আবার দুই দেশের সরকার প্রধান আন্তরিক পরিবেশে হাস্যোজ্জ্বল সেলফি কী ইঙ্গিত দিচ্ছে– তা এখনও স্পষ্ট নয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নতজানু অভিবাদন, ফরাসি প্রেসিডেন্টের ঝটিকা সফর ইত্যাদি নানান ঘটনা বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের জন্য শান্তিসনদ মনে হতে পারে; কিন্তু এই ফ্রান্সই ভারতে রাফায়েল যুদ্ধবিমান সরবরাহকারী দেশ।
রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়-বিক্রয় ও সরবরাহ নিয়ে নানামুখী দুর্নীতির কথা আমরা শুনেছি। যে দুর্নীতির চূড়ান্ত মীমাংসা হয় ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে। ভারতের বিরোধী দলসমূহ একাট্টা হয়ে বহু তথ্যপ্রমাণ হাজির করে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করেছিল। ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ ও ফ্রান্সের বিমান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কারসাজি করে বিমানের মূল্য কয়েকগুণ বাড়ানোর তথ্যপ্রমাণের সন্ধান পাওয়া যায়। ফলে প্রসঙ্গটি আদালতে গড়ায়। নিষ্পত্তি হয় প্রধান বিচারপতির এজলাসে। প্রধান বিচারপতির এজলাস 'দুর্নীতির পক্ষে অকাট্য তথ্যপ্রমাণ না পাওয়ায়' রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয় ও সরবরাহে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রদান করে।
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ঐ প্রধান বিচারপতি তার পুরষ্কারও পেয়েছেন তাৎক্ষনাৎ। রাফায়েল যুদ্ধবিমান দুর্নীতির মামলার রায়টি ছিল প্রধান বিচারপতির কর্মজীবনের শেষ দিককার ঘটনা। অবসরের পর তিনি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সম্ভবত একমাত্র– যিনি প্রধান বিচারপতি থেকে রাজ্যসভার সদস্য হয়েছেন।
পৃথিবীর কোন দেশই তার নিজের স্বার্থের বাইরে পদক্ষেপ নেয় না। পশ্চিমাদের প্রয়োজন এখন চীন সাগর থেকে শুরু করে এশিয়ার এই অঞ্চলে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। রাশিয়াকে ঠেকানোর জন্য যেমন ন্যাটোকে ইউরোপে পুবদিকে সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখতে হয়েছে, তেমনি চীনকে ঠেকানোর জন্য দরকার চীন সাগর ও এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ।
এরকম পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য উভয় সংকট। চীনসহ পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই আমাদের উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের চীনের বিনিয়োগ সর্বাধিক। অন্যদিকে গ্রামীণ ও সামাজিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এর প্রকল্প সংখ্যা সর্বাধিক। জাপানও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অংশীদার। আমাদের রপ্তানি আয়ের বড় বাজার এখনও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। সেকারণেই সর্বদা সতর্ক কূটনৈতিক পদক্ষেপ আমাদের কাম্য।