মার্কিন নির্বাচন: কেন দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট নয়!
১৭৭৬ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং ১৭৮৯-তে তাদের সংবিধান গৃহীত হয়। সংবিধান গৃহীত হওয়ার দুবছরের মাথায় দশটি সংশোধনী আনা হয়। ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া ফরাসি বিপ্লব গোটা বিশ্বকে নাড়া দেয়। মার্কিন সংবিধান প্রণয়নকারী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনরা উপলব্ধি করেন সমাজে ধর্ম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া সত্ত্বেও ধর্ম সমাজকে বিভাজিত করতে পারে। সে কারণে মার্কিনসংবিধানের প্রথম সংশোধনী হচ্ছে সিনেট ধর্ম নিয়ে কোনো আইন করতে পারবে না।
এরপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। দেশটি আঞ্চলিক যুদ্ধ, বিশ্বযুদ্ধ সবকিছুতেই অংশ নিয়েছে। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৪৬তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন একটু ভিন্ন প্রকৃতির নির্বাচন। এখানে ভোটারদের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাররা ভোট দেন ইলেক্টোরাল ব্যবস্থার প্রতিনিধিকে। প্রতিটি রাজ্যে সাধারণ ভোটারদের ভোটে ইলেক্টোরাল যে দলের বেশি বিজয়ী হয়, ওই দলের সমস্ত ইলেকটোরাল ভোট ওই প্রেসিডেন্টপ্রার্থীর হবে। এরকম নির্বাচন-পদ্ধতির মধ্য থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সিনেট হচ্ছে উচ্চকক্ষ যেখানে নিম্নকক্ষ অর্থাৎ প্রতিনিধি পরিষদের আইন প্রণয়নকে বৈধতা দেওয়া হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ইতিহাসে এ পর্যন্ত ১৭ জন সিনেট সদস্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া আটজন ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্টের মৃত্যুজনিত কারণে প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আর সাতজন ভাইস প্রেসিডেন্ট পরবর্তীকালে নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
জো বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১০ জন বয়োবৃদ্ধ প্রেসিডেন্টের একজন। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বাইডেনের বয়স ৭৮ অতিক্রম করেছে। তিনি মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট। দায়িত্ব গ্রহণের সময় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স ছিল ৭০, সে হিসাবে ট্রাম্প দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বয়স্ক প্রেসিডেন্ট।
নভেম্বরে নির্বাচন এবং পরের জানুয়ারিতে শপথ—এভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন নির্ধারিত। ১৯৪৭ সনে প্রথম কংগ্রেস বিধান পাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রেসিডেন্ট দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। যা সবগুলো রাজ্যের অনুমোদন পেতে ১৯৫১ সাল হয়ে যায়। মার্কিন সংবিধানের ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অদ্যাবধি সেভাবেই চলছে।
২০২৪-এর নির্বাচনে আবারও বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। জো বাইডেন তার মধ্যপ্রাচ্যনীতির কারণে নিজ দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন ব্যাপকভাবে। বহির্বিশ্বেও জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইজরায়েলি বাহিনী একের পর এক মানবতাবিরোধী সামরিক হামলা করে নারী ও শিশুদের ওপর যেভাবে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, তা সমসাময়িক সময়ে এক কালো অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
ট্রাম্পের প্রার্থী হওয়ার বাধাগুলো ক্রমান্বয়ে দূর হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের জন্য অযোগ্য ঘোষিত রায় সর্বোচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছেন। দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীরা সরে দাঁড়িয়েছেন।
ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তিনি হবেন মার্কিন ইতিহাসের দ্বিতীয় অ-পরবর্তী মেয়াদের প্রেসিডেন্ট। এর আগে গ্লোভার ক্লিভল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের ২২তম ও ২৪তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার জীবনে কখনো সিনেট কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছিলেন না। প্রথমেই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন হিলারি ক্লিনটনের বিপক্ষে। ট্রাম্প তার দলের সমর্থন যেভাবে পেয়েছেন, তাতে তিনি আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হলে তা হবে এক বিরল ঘটনা।
মার্কিন সংবিধানে ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে কাউকে দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট পদলাভের পথ বন্ধ করা হয়। কেন এমনটি করা হলো? কারণ ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের সময় যত দীর্ঘ হয়, গণতন্ত্র ও সুশাসন তত সংকুচিত হয়। এই উপলব্ধি থেকে মার্কিন রাষ্ট্রচিন্তায় দুইবারের বেশি রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।
এই একই উপলব্ধি বিশ্বে অন্যান্য দেশেও পরিলক্ষিত হয়। রাশিয়ার একই ব্যবস্থা সাম্প্রতিক রহিত করে আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন সংবিধান পরিবর্তনের কারণে তার শত্রু-মিত্র প্রায় সবার কাছে সমালোচিত হয়েছেন। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেখানকার পার্টি চাইলে প্রেসিডেন্ট শি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পারবেন। সেখানকার পার্টিপ্রধানও তিনি নিজে।
দীর্ঘ ক্ষমতা রাষ্ট্রের ভারসাম্যের নীতি ধ্বংস করে দেয়। জবাবদিহির পরিবর্তে স্বেচ্ছাচারিতার সংস্কৃতি গড়ে উঠে। সর্বত্র কর্তৃত্ববাদিতা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকারব্যবস্থা অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় অনিবার্যভাবে পতিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এ ধরনের ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে গণতন্ত্রহীন স্বৈরাচারী ব্যবস্থা দেখা যায়।
আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় রাষ্ট্রের মালিকানা দেশের জনগণকে দেওয়া হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে রাষ্ট্রের মালিকানার এই বোধ যাতে অন্য কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর যেতে না পারে সে কারণেই দেশে দেশে শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রধান পদটির সময় যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ দুইবারের বেশি প্রধান পদে কেউ দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।
- বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়