রদ্যাঁর ভাস্কর্য
অগুস্ত রদ্যাঁ, একটি নাম, একজন শিল্পী, একটি প্রতিষ্ঠান, একজন ভাস্কর, একটি শিল্প, কালের গ্রাসকে অগ্রাহ্য করে টিকে থাকা একজন অতিমানব। বর্তমান বিশ্বে ভাস্কর্য নিয়ে কথা বলা মানেই অগুস্ত রদ্যাঁকে নিয়ে কথা বলা। মনে করা হয় উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভাস্কর এই ফরাসিই, কিন্তু আসলে সমগ্র শিল্পকলার ইতিহাসে একমাত্র ফ্লোরেন্সের মাইকেলেঞ্জেলো বাদে আর কোনো শিল্পীই ভাস্কর হিসেবে চতুর্দিকে এমন সুবাস ছড়ানো সম্মান পাননি। বিশ্বের যেকোনো জাদুঘর রদ্যাঁর একটি ভাস্কর্য সংগ্রহে রাখতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করে, প্যারিসের একাধিক জাদুঘরে রদ্যাঁর ভাস্কর্য আছে, আছে ফ্রান্সের বাহিরেও, কিন্তু তার তৈরি শিল্পকলার মূল সংগ্রহ সবই সন্নিবেশিত আছে প্যারিসের রদ্যাঁ জাদুঘরে। আমাদের আজকের যাত্রা সেদিক পানেই।
সিন নদীর তীরে নেপোলিয়নের সমাধিস্তম্ভ লেস ইনভ্যালিদাসের পাশের 79 Rue de Varenne-তে অবস্থিত এই বিশ্বখ্যাত জাদুঘর, যার সামনে সারা বছরই লেগে আছে বিশাল লাইন। কোনোমতে টিকিট সংগ্রহ করে ঢুকে পড়লাম ভেতরের বাগানে, সামনেই সুরম্য জাদুঘর প্রাসাদ। কিন্তু মূল ফটকে দিয়ে প্রবেশের পরপরই ডানদিকে পার্কের ভেতরে গাছঘেরা সুউচ্চ বেদীস্তম্ভে নিরিবিলিতে একা উপবিষ্ট স্বয়ং দ্য থিংকার!
খোদ রদ্যাঁর খোদিত সবচেয়ে বিখ্যাত ভাস্কর্য এটি, এর সমমানের খ্যাতিময় ভাস্কর্য হিসেবে ধরা হয় একমাত্র ভেনাস দ্য মিলো আর মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিডকে। সেই জগদ্বিখ্যাত সৃষ্টি থিংকারকে এভাবে খোলা আকাশের নিচে প্রকৃতির মাঝে এমন নিবিড়ভাবে দেখতে পাব, তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করিনি। পরে জানা গেল, রদ্যাঁ ছাচে ফেলে যে কয়টি ব্রোঞ্জ আর মার্বেলের থিংকার তৈরি করেছিলেন, এটিই সবচেয়ে বৃহৎ আকৃতির। কী অদ্ভুত সেই ভাস্কর্য, যেন পাথরে খোদাই করে প্রাণ ফোটানো!
ইউরোপের বিভিন্ন চিত্রকলার জাদুঘর পরিদর্শনের সৌভাগ্য হওয়ায় নানা শিল্পীর অসংখ্য অতি নিখুঁত, সুন্দর, শৈল্পিক ভাস্কর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এমন অনন্যসাধারণ মাস্টারপিস চোখে পড়েনি একটিও। এ যে অদ্বিতীয়, এ যে রদ্যাঁর থিংকার। একজন মানুষ নগ্নগাত্রে বলিষ্ঠভাবে বসে আছে, একটি হাত আলতোভাবে পড়ে আছে হাঁটুর ওপরে, অন্যটি থুতনিতে স্পর্শ করে কী গভীরভাবেই না সে চিন্তামগ্ন! চিন্তা এই পৃথিবীর জন্য, এর বাসিন্দাদের জন্য। এ কারণেই রদ্যাঁ এই বিশেষ ভাস্কর্যটি তৈরি করার পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় দ্য থিংকার। অনেকের মতে, মানুষের মনে আশার আলো জাগায় ব্রোঞ্জ-মার্বেলের এই ভাস্কর্য। প্যারিসের অনেক জায়গা ঘুরে অবশেষে তাকে স্থাপন করা হয় বর্তমান স্থানে। মনে করা হয় মহাকবি দান্তের অনুকরণে মূর্তিটি গড়া হয়েছে, কিন্তু এত কিছু জানার পরও বারবার বিস্ময়াভূত হতে হয় নেহাত পাথর কুঁদে কী করে এতটা অনুভূতি, এতটা আবেগ বের করা সম্ভব! এ তো কেবল সৌন্দর্য নয়, সৌষ্ঠব নয়, এ তো নিখাদ চিন্তামগ্ন, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন জ্ঞানী মানুষ।
দ্য থিংকারের পাশের বাগিচাতেই রদ্যাঁর আরেক বিখ্যাত কাজ—প্রমাণ আকারের বালজাকের ভাস্কর্য। বিশ্বনন্দিত এই ফরাসি সাহিত্যিকের অসংখ্য ভাস্কর্য গড়েছেন রদ্যাঁ, এটাই আকারে সবচেয়ে বড়। সে-ও আছে প্রকৃতির কোলে—রোদে, ঝড়ে, বৃষ্টিতে থিংকারের মতো। এরপর ঢুকে পড়লাম মূল ভবনে, এককালে যার পরিচিতি ছিল হোটেল বায়রন নামে। অতি সুসজ্জিত, সুরম্য ভবন, বিশাল কারুকার্যময় ঝাড়বাতি প্রতিটি কক্ষে। সেইসাথে চোখধাঁধানো সিঁড়ি আর জানালার রেলিং। ইতিহাসখ্যাত এই স্থাপনাটির সাথে জড়িয়ে আছে ভুবনবিদিত বিশ্বখ্যাত শিল্পীর নাম, অবশেষে অগুস্ত্য রদ্যাঁ তার মৃত্যুর পরে সমস্ত সংগ্রহ দিয়ে রদ্যাঁ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হবে এমন চুক্তিতে এসে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এখানে নিজের কর্মস্থল টিকিয়ে রাখার অধিকার আদায় করেন।
ভেতরে রদ্যাঁর সারাজীবনের অসংখ্য কাজ, তার সবগুলোর মোটামুটি বর্ণনা দিতে গেলেও হাজার পাতার বই ছাড়িয়ে যাবে, তাই বেছে বেছে অতি বিখ্যাতগুলোর বর্ণনাই কেবল দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমেই নজরে এল ল্য ক্যাথেড্রাল, কনুই-এর সামান্য পর থেকে শুরু হওয়া কেবল দুটি হাত আর তার দশটি আঙ্গুল যে কী সুষমামণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে তার প্রমাণ ল্য ক্যাথেড্রাল।
এরপর আমাদের নজরে আসে হ্যান্ড অভ গড, একটি বিশাল হাত একতাল কাদা ছেনে নর ও নারী বানাচ্ছে, তারা দুজন আবার পরস্পরের সাথে নিবিড় আলিঙ্গনাবদ্ধ। কী যে নিখুঁত সে মর্মর পাথরের হাত, শিরা-উপশিরা পর্যন্ত স্পষ্ট বোঝা যায়। আর দর্শক যেন দুদিক থেকে অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সেজন্য এর কাছেই বসানো আছে বিশালাকার আয়না।
একই কক্ষের অন্য অংশে আছে রদ্যাঁর তৈরি সবচেয়ে রোমান্টিক ভাস্কর্য দ্য কিস বা চুম্বন। দুই প্রমাণ আকারের জীবন্ত নর-নারী পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ, অধরে অধর মিলিয়ে যাচ্ছে। দান্তের চরিত্র ফ্রান্সেসকা আর পাওলো থেকে মূল ধারণা নেওয়া হলেও অনেকের মতে নারীমূর্তিটির মুখের আদল রদ্যাঁর ছাত্রী ও প্রেমিকা ক্যামিল ক্লোদেলের মুখাবয়ব থেকে নেওয়া। উল্লেখ্য, রদ্যাঁ জাদুঘরে স্বয়ং রদ্যাঁ বাদে একমাত্র ক্যামিল ক্লোদেলের কাজের সংগ্রহ আছে।
একজন খাঁটি শিল্পীর মতোই রদ্যাঁ ছিলেন সর্বদাই জীবনের নানান দিক নিয়ে উৎসুক, সারা জীবন তিনি নানা ধরনের জিনিস সংগ্রহে মত্ত ছিলেন, গ্রিক-রোমান সভ্যতার নিদর্শন থেকে সমসাময়িক চিত্রকলা পর্যন্ত। এই জাদুঘরের বিভিন্ন দেয়ালে তার নিজস্ব সংগৃহীত চিত্রকর্মগুলো ঝুলছে, এর মধ্যে রেনোয়া, এডভার্ড মুঙ্ক, ক্লদ মোনের অমূল্য পেইন্টিং বাদেও আছে ভিনসেন্ট ভ্যান গগের তিন তিনটি মাস্টারপিস। এমন আর্টের মূল্য বিচার করা যায় না, কিন্তু অনায়াসে বলা যায়, যেকোনো সময় নিলামে উঠলে প্রতিটি পেইন্টিংয়ের দাম বাংলাদশি মুদ্রায় এক হাজার কোটি টাকার ওপরে হবে!
দোতলার এক কক্ষে দেখা হলো ছোট মডেলের দ্য থিংকারের সাথে। কী অবিশ্বাস্য সৃষ্টি, বাইরের বড়টির মতোই তার চোখে-মুখে গভীর চিন্তা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের ছাপ।
এরপরে নিচতলা-উপরতলার প্রতিটি ঘরে আছে রদ্যাঁর তৈরি অসংখ্য নয়নকাড়া, নিখুঁত, যেকোনো বিচারে বিশ্বের সেরা ভাস্কর্যের অদ্বিতীয় সংগ্রহশালা। কোনোটা মার্বেলের, কোনোটা বা ধাতব। কোনটা ফেলে কোনটার বর্ণনা দেব। সেইসাথে আছে তার কিছু আত্মপ্রতিকৃতিও।
ঘণ্টা কয়েক মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই জাদুময় কক্ষগুলোতে অতিবাহিত করে প্রবেশ করলাম রদ্যাঁ জাদুঘরের অতি বিখ্যাত বাগানের পানে। ঘন সবুজ ঘাসের লন, দুপাশে গাছের সারি, সেই সাথে বাগানের বিভিন্ন জায়গায় নব নব আঙ্গিকের ভাস্কর্য। সবার শেষে এসে দাঁড়ালাম রদ্যাঁ অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি নরকের দরজা বা গেট অভ হেল ভাস্কর্যের সামনে। আসলে একটি বিশেষ ভাস্কর্য না বলে নানা ভাস্কর্যের সমাহার বলা উচিত—সুউচ্চ সুবিশাল এক সিংহদরজা, যেন খুললেই দেখা যাবে লেলিহান অগ্নিশিখার দেদীপ্যমান জ্বলন্ত নরক। ইতালীয় মহাকবি দান্তের ডিভাইন কমেডি আর ফরাসি কবিশ্রেষ্ঠ শার্ল ব্যোদলেয়ারের 'দ্য ফ্লাওয়ার্স অভ দ্য ইভিল' কাব্যগ্রন্থ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে এই বিশাল কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন রদ্যাঁ। দরজার ওপরে কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থানরত চিন্তারত থিংকার, আর্তনাদরত নর-নারীরা, জাদুঘরের ভিতরে দেখা নানা ভাস্কর্যের ক্ষুদে মডেল এখানে স্থান পেয়েছে।
দৃঢ় চিত্তে বলতে পারি রদ্যাঁর যেকোনো একটি সৃষ্টিই যেখানে শিল্পকলার রাজ্যে একজন শিল্পীকে অমর করে রাখার জন্য যথেষ্ট, সেখানে এত মাষ্টারপিস! কেবলই ভক্তিতে মাথা নুইয়ে দেয় অগুস্ত রদ্যাঁর প্রতি, তার শিল্প সাধনার প্রতি।।