কৃষি অর্থনীতির নীরব বন্ধু বাংলার প্যাঁচারা
পাখিদের মধ্যে একটি রহস্যময় ও অনন্য সুন্দর পাখি হলো প্যাঁচা। পাখিরা যে পৃথিবীর সুন্দরতম মহিমান্বিত সরীসৃপ, তার প্রমাণ মেলে প্যাঁচার সৌন্দর্যে। Stigiformes বর্গের অন্তর্গত Tytonida (Barn Owl) ও Strigidae (True Owl) পরিবারে ২২০ প্রজাতির অধিক প্যাঁচার সন্ধান পাওয়া গেছে পৃথিবীতে। এইসব প্যাঁচার মধ্যে Balkiston's Fish Owl হলো পৃথিবীর বৃহত্তম এবং Elf Owl হলো পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্যাঁচা।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এমন একটি অবস্থানে নিজেকে প্রকাশিত করেছে যা জীববৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রয়েছে পাহাড়ি চিরসবুজ বন, দক্ষিণ-পশ্চিমে বিশ্বের বৃহত্তম লোনাপানির বন সুন্দরবন, দক্ষিণজুড়ে বঙ্গোপসাগরের বিশালতা, আর মধ্যাঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিম পর্যন্ত শালবন। এছাড়া জালের মত ছড়ানো নদনদী। এই অঞ্চলগুলো সম্মিলিতভাবে গড়ে তুলেছে জীববৈচিত্র্যের এক অপূর্ব সমাহার।
হাজারো বৈচিত্র্যময় জীবের আশ্রয়স্থল হিসাবে বাংলাদেশ সারা পৃথিবীতে পরিচিত। এছাড়া আমাদের দেশ ওরিয়েন্টাল নামক প্রাণিভৌগোলিক অঞ্চলের ইন্দো-হিমালায় ও ইন্দো-চায়না অংশের সংযোগস্থলে হওয়ায় প্রাণীবৈচিত্র্যে যুক্ত হয়েছে এক অনন্য মাত্রা। সব মিলে তৈরি হয়েছে বন্য পশুপাখির এক বিশাল ভান্ডার, যা কিনা এদেশের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এছাড়া এই ছোট দেশের মধ্যেই রয়েছে পৃথক ২২টি জীব-পরিবেশীয় অঞ্চল, যার ফলে অঞ্চলভেদে এই এলাকা পেয়েছে জীববৈচিত্র্যে এক অনন্য বৈচিত্র্যময়তা। আর বৈচিত্র্যময় জীববৈচিত্র্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এদেশের বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
বাংলাদেশ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও প্রকাশিত বই অনুযায়ী, সারা দেশে ২ পরিবারে, ৯ গণে ১৮ প্রজাতির প্যাঁচার উপস্থিতির কথা পাওয়া গেছে। এছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশে Jungle Owlet-এর সন্ধান পাওয়া গেছে। বাহারি শারীরিক গঠনের পাশাপাশি প্যাঁচার রয়েছে বৈচিত্র্যময় কণ্ঠ, যা খুবই কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের এবং একটি দীর্ঘ পথ পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে এবং প্যাঁচা শনাক্তকরণে যা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
প্যাঁচার সম্মুখের বড় চোখ, কানের পালকের গঠন, চঞ্চুর গঠন এবং চ্যাপ্টা গোলাকার মুখ পাখিটির শারীরিক গঠনে দিয়েছে বৈচিত্র্য। এছাড়া চোখের চারিদিকে গোলাকারভাবে সাজানো পালকের বিন্যাস প্যাঁচার মুখকে করেছে অন্যান্য পাখি থেকে অনন্য। প্যাঁচা দীর্ঘদৃষ্টিসম্পন্ন পক্ষী। এজন্য সম্মুখের কয়েক ইঞ্চি এরা দেখতে পারে না। এছাড়া প্যাঁচা তার ঘাড় ও মাথা ২৭০ ডিগ্রি ঘোরাতে পারে তার দেহের চারিপাশে।
অ্যান্টার্কটিকা বাদে সমস্ত অঞ্চলে প্যাঁচার দেখা মেলে। প্যাঁচারা নিশাচর হলেও কিছু প্যাঁচা আছে দিবাচর। এরা নিঃশব্দে উড়তে পারে। পুরুষ ও স্ত্রী প্যাঁচা দেখতে একরকম হলেও স্ত্রী প্যাঁচা আকারে বড়।
বাংলাদেশে Tytonidae পরিবারেরর একমাত্র সদস্য প্যাঁচা হলো লক্ষ্মী প্যাঁচা বা Common Barn-owl. সনাতন ধর্মে লক্ষ্মী ধনসম্পদের দেবী হিসেবে পূজিত, আর তার বাহন এই লক্ষ্মী প্যাঁচা। সাধারণত ইঁদুর খেয়ে কৃষকের ধান রক্ষা করে এই প্যাঁচা, যা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সারা দেশে একসময় সংখ্যায় প্রচুর থাকলেও এখন খুব কম চোখে পড়ে। বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করে এরা। বাসা বানায় গাছ বা দালানের গর্তে।
Strigidae পরিবারে প্যাঁচা রয়েছে ১৭ প্রজাতির। নতুন করে যুক্ত হয়েছে একটি।
Short-eared Owl বা ছোট-কান প্যাঁচা বাংলাদেশের একমাত্র দিবাচর প্যাঁচা এবং এরা একমাত্র পরিযায়ী প্যাঁচা। সাধারণত একা অথবা ছোট গ্রুপে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে এরা। ইঁদুর, ছোট পাখি এবং বড় আকৃতির পোকা ধরে খায়। এরা শীতকালে আমাদের দেশে পরিযান করে এবং সাধারণত প্রধানত নদীতীরবর্তী ও খোলা প্রান্তরে এদের দেখা মেলে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি যে প্যাঁচা আমাদের চোখে পড়ে, তার নাম খুঁড়ুলে প্যাঁচা বা Spotted Owlet. এই প্যাঁচারা নিশাচর। একাকী অথবা ছোট দলবদ্ধ হয়ে থাকে। ছোট পাখি, সরীসৃপ, ইঁদুর ও পোকামাকড় ধরে খায়। নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এরা প্রজননে অংশ নেয়। সারা দেশেই আছে এই প্যাঁচা।
সারা দেশে সচরাচর বনজঙ্গলে দেখতে পাওয়া প্যাঁচার একটি প্রজাতি হলো Brown Boobook বা খয়রা শিকরে প্যাঁচা। এরা নিশাচর। একাকী অথবা জোড়াবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। সাধারণত পোকামাকড় ও ছোট সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী খেয়ে থাকে।
Ketupa গণের অধীনে তিন প্রজাতির Fish owl রয়েছে আমাদের দেশে। এরা সাধারণত বড় আকারের, বড় কান ঝুঁটি। এরা মাছশিকারি। এদের মধ্যে Brown Fish Owl সারাদেশে দেখা যায়। অপরদিকে Buffy Fish Owl শুধু সুন্দরবন এবং Tawny Fish Owl দেশের উত্তর-পশ্চিমান্চলের মৌলভীবাজার এবং মধ্যভাগের মধুপুর, টাঙ্গাইলে দেখা গেছে। এ তিন ধরনের প্যাঁচার খাদ্যতালিকায় রয়েছে বড় পোকামাকড়, মাছ, ছোট সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী।
Bubo গণের অন্তর্ভুক্ত দুই প্রজাতির হুতুম প্যাঁচার দেখা মেলে আমাদের দেশে। এরা বৃহৎ আকৃতির, শক্তিশালী প্যাঁচা। এরা একাকী অথবা জোড়াবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। মেটে হুতুম প্যাঁচার (Dusky Eagle Owl) সারাদেশে বিস্তৃতি থাকলেও এখন খুবই কম দেখা মেলে। খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়, মাছ, ছোট সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী খেয়ে থাকে। চিতি পেট হুতুম প্যাঁচা বা Spot-bellied Eagle Owl আমাদের দেশে প্রাপ্ত সবথেকে বড় আকৃতির প্যাঁচা (৬৩ সে.মি.)। এর খাদ্যতালিকায় রয়েছে ময়ূর, বন মোরগ, শিয়াল, খরগোশ, সাপ, মাছ। আমাদের দেশের মিশ্র চিরসবুজ বনে এদের দেখা মেলে।
Otus গণে রয়েছে তিন প্রজাতির নিম প্যাঁচা আমাদের দেশে।
নিম প্যাঁচারা আকারে ছোট, দেখতে সুন্দর, মাথা বড়, লেজ ছোট। নিম প্যাঁচারা সাধারণত বনজঙ্গলে, গাছের কোটরে থাকে। এরা নিশাচর হয়। একাকী অথবা জোড়াবদ্ধ হয়ে থাকে। সাধারণত ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী ও পোকামাকড় খায়। নিম প্যাঁচার মধ্যে Collared - scopes Owl বা কণ্ঠী নিম প্যাঁচার দেখা সারা দেশেই মেলে। Oriental Scopes-owl বা উদয়ী নিম প্যাঁচার দেখাও সারা দেশেই পাওয়া যায়, কিন্তু সংখ্যায় কম। এছাড়া Mountain Scopes Owl বা পাহাড়ি নিম প্যাঁচার দেখা মেলে বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলে, যা সংখ্যায় খুবই কম। এছাড়া কিছুদিন আগে Indian Scopes Owl-এর সন্ধান পাওয়া গেছে রাজশাহী অঞ্চলে।
Glaucidium গণের দুটি প্যাঁচা পাওয়া যায় আমাদের দেশে। এরা ছোট আকারের প্যাঁচা। কান ঝুঁটি নেই। পুরো পা ও আঙুলের উপরিভাগ পালকে আবৃত। ডানা গোলাকার। বাংলাদেশের পাহাড়ি বনাঞ্চলে এদের দেখা যায় খুবই কম। এরা নিশাচর, পোকামাকড় ও ছোট মেরুদণ্ডী প্রাণী খায়।
Collared Owlet বা দাগিঘাড়-কুটি প্যাঁচা বাংলাদেশের সবথেকে ছোট প্যাঁচা। এরা আকারে ১৭ সেন্টিমিটার চড়ুই পাখির থেকে কিছুটা বড়। এদের মাথার পিছনে মেকি চোখসদৃশ গঠন রয়েছে যা দিনের বেলায় অন্যান্য শিকারি পশুপাখির আক্রমণ থেকে এদের রক্ষা করে।
Asian Barred Owlet বা এশীয় দাগী প্যাঁচার সারা দেহে আড়াআড়ি সাদাটে লাইন থাকে।
এছাড়া Strix গণের এক প্রজাতির প্যাঁচা দেখা মেলে আমাদের দেশে। এরা বড় আকারের প্যাঁচা, কান ঝুঁটি নেই। Brown Wood-Owl বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি; পাহাড়ি বন, প্যারাবন, পত্রঝরা বনে এর দেখা মেলে।
নিশাচর এই প্যাঁচা একাকী অথবা জোড়াবদ্ধ হয়ে থাকে। সাধারণত ইদুঁর, ছোট পাখি এবং সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণী খেয়ে থাকে এরা।
আইইউসিএন বাংলাদেশ ২০১৫-এর তথ্যমতে Tawny Fish Owl, Buffy Fish Owl এবং Mountain Scopes Owl-এর অবস্থা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ডাটা নেই। Collared Owlet-এর তথ্য বিশ্লেষিত হয়নি। এছাড়া বাকি সবাই Least Concern বা বিপদমুক্ত।
এই পৃথিবীর সব জীববৈচিত্র্যের কিছু না কিছু উপকার রয়েছে। আর প্যাঁচা আমাদের জন্য অনেক উপকারী একটি পাখি।
প্যাঁচা পরিবেশের জন্য একটি নির্দেশক প্রাণী। প্যাঁচার উপস্থিতি পরিবেশের সুস্থতা নির্দেশ করে।
প্যাঁচারা প্রধানত ইঁদুর-জাতীয় প্রাণী খায়। আর ইদুঁর ধানের শত্রু। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট করে এই ইদুঁর।
আর প্যাঁচা ইদুঁর খেয়ে ইদুঁর নিয়ন্ত্রণ করে। ২০১০ সালে প্রকাশিত একটি হিসাবে দেখা গেছে যে একটি প্যাঁচা তার সারাজীবনে ২৫ লক্ষ টাকার ফসল রক্ষা করে। তৎকালীন হিসাব থেকে বর্তমানে এই পরিমাণ আরও বেশি হবে।
কিছু প্যাঁচা মাছ খায়। এরা সাধারণত জলাশয়ের আশপাশ থেকে অসুস্থ মাছ খেয়ে থাকে। এই মাছ জলাশয়ে মাছের সংক্রামক রোগ তৈরি করে অনেক বড় ক্ষতি করে।
এছাড়া প্যাঁচা পোকামাকড় খায়, যা ফসলের খেতে ক্ষতিকর রোগ তৈরি করে।
কোথাও প্যাঁচা থাকলে ওই এলাকায় শত শত কোটি টাকা খরচ করে আলাদা বালাইনাশক কিনতে হয় না। এতে ফসলের মান যেমন ঠিক থাকে তেমনি ফসল রক্ষা পায় বিষাক্ততা থেকে।
এছাড়াও প্যাঁচা প্রতি মুহূর্তে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে আমাদের পরিবেশে। পরিবেশের ভারসম্য রক্ষা ও খাদ্যশৃঙ্খল ঠিক রাখায় প্যাঁচা রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বর্তমানে শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রভাব সারা বিশ্বব্যাপী। প্যাঁচার সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে দিন দিন, বন উজাড়, আবাসস্থল নষ্টের ফলে প্যাঁচা আজ সংকটাপন্ন। এছাড়া ঔষধ প্রয়োগের ফলে মৃত ইদুঁর খেয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয় অনেক প্যাঁচার। আগের মতো এখন আর দেখা মেলে না পরিবেশের বন্ধু এই পাখিটির।
বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাওয়া পাখিটি নীরবে আমাদের যে কত উপকার করে যাচ্ছে, তা হয়তো আমরা জানিও না। প্রকৃতি তার মধ্যেই রেখেছে সব সমস্যার সমাধান, কিন্তু আমরা না বুঝেই তা ধ্বংস করছি। অন্তত আমাদের প্রয়োজনেই বাঁচাতে হবে প্রকৃতিকে।
আর বাংলার বুকে বেঁচে থাকুক প্যাঁচারা পরম নিরাপত্তায়। আর হয়ে থাকুক কৃষকদের বন্ধু।
বঙ্গদেশে থাকলে প্যাঁচা,
কৃষকের ক্ষেতে ফলবে সোনা।
-
আশিকুর রহমান সমী: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিকাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস বাংলাদেশ)
-
ড. মোহাম্মদ ফিরোজ জামান: অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়