হাসিনার আমলে বিচার বিভাগ আর এখন যা হচ্ছে
ঢাকার নিম্ন আদালতগুলো হঠাৎ করেই বিচারকার্যে খুব দক্ষ হয়ে উঠেছেন। গত তিনদিনে নিম্ন বিচার বিভাগের বিচারক-ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রায় পাঁচ হাজার জামিন মঞ্জুর করেছেন — যেন ন্যায়বিচারের দ্বার হঠাৎ করে খুলে গিয়েছে।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত এ দ্বারের আগল বন্ধ ছিল। আদালতে জামিন পাওয়া যেত না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যাদেরকে আটক বা গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করত, তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হতো। অনেককেই পুলিশের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এমনকি ১৭ বছরের একটি ছেলেকে রিমান্ডে রাখা হয়েছিল। এ কৌশলটি ছিল ছাত্র বিক্ষোভকে নৃশংসভাবে দমন করার জন্য হাসিনা সরকারের পরিকল্পনার একটি অংশ।
গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে একই ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা হয়েছিল। সরকারের অধীনে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনের প্রতিবাদকারী বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে তৎকালীন হাসিনা সরকার দমন অভিযান শুরু করে।
দমনপীড়নে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাসহ হাজার হাজার বিরোধী নেতাকে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা অসংখ্য মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এবং হাসিনা টানা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই তাদের অনেকেই জেল থেকে ছাড়া পান।
এবার ৫ জুলাই হাসিনা সরকারের পতন বিচারের দ্বার খুলে দিলো।
তার পতনের পর বিরাজমান অরাজক অবস্থা আমাদের পুলিশ ও বিচার বিভাগের মতো সব প্রতিষ্ঠানের ভঙ্গুর অবস্থাও প্রকাশ করেছে। এটি হাসিনা সরকারের সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের চরম পরিণতি।
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নতার মাঝে ঢাকার বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলো কাজ করছেন। কিন্তু হাসিনার পদত্যাগের পর পুরো পুলিশ প্রশাসন ভেঙে পড়ায় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে আইন কর্মকর্তারা অনুপস্থিত থাকায় জেলা পর্যায়ের নিম্ন আদালতগুলো অনেকাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছেন।
উচ্চ আদালত অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। আবার কবে খুলবে কেউ জানে না। বিগত সরকারের সময় পক্ষপাতমূলক ভূমিকায় থাকার অভিযোগে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং তার কার্যালয়ের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও পদত্যাগ করেছেন।
ঢাকার আদালতগুলোর একই বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটরা এখন কেন ভিন্ন আচরণ করছেন? প্রশ্নটা বড়, কিন্তু উত্তরটা সহজ। তারা উৎখাত হওয়া হাসিনা সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
যুগে যুগে সব সরকার নিম্ন আদালতের ওপর নিয়ন্ত্রণ খাটিয়েছে তাদের পক্ষপাতমূলক স্বার্থের জন্য, বিশেষ করে ভিন্নমত দমাতে ও বিরোধীদের কারাগারে পাঠাতে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিচার বিভাগের যে অপব্যবহার ঘটেছে, তা অতীতের সব নজির ছাড়িয়ে গেছে।
একের পর এক সরকার কয়েক দশক ধরে বিচার বিভাগকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে তা জানতে আবারও একবার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতারা একটি গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তারা গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য হিসেবে পরিচিত একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা তৈরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন।
তাই সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে।
নিম্ন বিচার বিভাগের বিষয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল ১১৬ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টকে বিচারক ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদায়ন, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুর এবং শৃঙ্খলাসহ নিম্ন বিচার বিভাগের বিষয়সমূহের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংসদ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের সেই ক্ষমতা বাতিল করে তা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদ দখল করে একদলীয় শাসন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন।
পরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসনামলে সামরিক আইন ঘোষণার মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদ আরও সংশোধন করা হয়। এ সংশোধনে একটি বিধান চালু করা হয়, যাতে বলা হয় রাষ্ট্রপতি উচ্চ আদালতের সঙ্গে পরামর্শ করে তার কর্তৃত্ব প্রয়োগ করবেন।
হাসিনা-নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সবসময় সামরিক শাসনের তীব্র সমালোচক ছিল। তবে সামরিক সরকারের প্রবর্তিত বিধান বজায় রাখার ক্ষেত্রে এটি দ্বিধা করেনি।
২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীতে ১১৬ অনুচ্ছেদে একই বিধান অপরিবর্তিত রাখা হয়।
২০১৭ সালে ১৬তম সংশোধনীর রায়ে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে: "১১৬ অনুচ্ছেদে 'উচ্চ আদালত' শব্দের স্থলে 'রাষ্ট্রপতি' শব্দের প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নিম্ন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপ সংকুচিত ও হ্রাস করা হয়েছে।"
'যদিও এ ক্ষমতা প্রয়োগে পরামর্শের বিধান রয়েছে, কার্যত এ পরামর্শ অর্থহীন যদি নির্বাহী বিভাগ উচ্চ আদালতকে সহযোগিতা না করে,' আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়।
এছাড়া প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে যে, ১১৬ ধারা প্রয়োগের সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি নিজে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, কারণ রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ব্যতীত তার বাকি সমস্ত কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে সম্পাদন করেন।
এভাবে প্রধানমন্ত্রী নিম্ন বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, 'নিম্ন ও উচ্চতর বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষমতাসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকলে বিচার বিভাগে কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না।'
সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের নিয়োগের জন্য একটি পৃথক আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার প্রতি কোনো মনোযোগ না দিয়ে সরকার সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগের নিয়ন্ত্রণও ধরে রেখেছিল। সুনির্দিষ্ট আইনের অনুপস্থিতি সরকারকে তার নিজের পছন্দের বিচারক নিয়োগের সুযোগ দিত।
এসব বিধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচার বিভাগের ওপর তার সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা দিয়েছে। এছাড়া অনিরপেক্ষ নির্বাচন তাকে সংসদেও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল। তিনি রাষ্ট্রের তিনটি শাখায় তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন এবং বাংলাদেশের 'সর্বশক্তিমান নেত্রী' হিসেবে আবির্ভূত হন।
তার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। সংসদ তার মন্ত্রিসভাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে পারেনি। তার মন্ত্রিসভার সদস্যরাও তার প্রতি অন্ধভাবে অনুগত ছিলেন।
আর এমন পরিস্থিতিতে ফলাফল কী হতে পারে?
প্রায় ৩০০ বছর আগে ফরাসি দার্শনিক, বিচারক ও আলোকিত যুগের অন্যতম মহান রাজনৈতিক দার্শনিক ব্যারন ডি মন্টেস্কুর করা একটি সতর্কবাণীর দুর্দান্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
'যখন আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা ম্যাজিস্ট্রেট বডির কাছে থাকে, তখন কোনো স্বাধীনতা থাকতে পারে না। কারণ পাছে রাজা বা সিনেট অত্যাচারী আইন প্রণয়ন করে… তার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে,' বলেছিলেন মন্টেস্কু।
যদি নির্বাহী, আইন প্রণয়ন ও বিচার — এ তিনটি ক্ষমতা কেবল এক ব্যক্তি বা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী প্রয়োগ করে, তাহলে কী হবে?
মন্টেস্কু লিখেছিলেন: 'একক কোনো সত্তা এ তিনটি ক্ষমতা প্রয়োগ করলে… সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।'
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করার পরেও হাসিনা অবশ্য সবসময় দাবি করে এসেছিলেন, তার সরকার আইনত জনগণ দ্বারা নির্বাচিত সরকার।
যারা তাদের ক্ষমতা দখলকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য আইনি ঢাল ব্যবহার করে, তাদের নিয়ে মন্টেস্কু বলেছিলেন, 'আইনের চাদরে আর ন্যায়ের নামে যা সংঘটিত হয়, তার চেয়ে বড় অত্যাচার আর কিছু নেই।'
বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার এ সংস্কৃতি আমাদেরকে পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক দলের মানুষ এবং সাধারণ মানুষ উভয়ই এ অপচর্চার ভুক্তভোগী হয়েছেন। এছাড়া কার্যকর 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স' নিশ্চিত করার জন্যও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃথকীকরণ অপরিহার্য।
পুনশ্চ: শনিবার (১০ আগস্ট) বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন। এরপর আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। তারা হলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন।