ফাইবার অবকাঠামোর ঘাটতি পূরণে প্রয়োজন উন্মুক্ত বাজার
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ফাইবার কেবল নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে শুধু লাইসেন্সধারীর স্বার্থ সুরক্ষামূলক বিধিনিষেধের পরিবর্তে দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে উন্মুক্ত বাজারভিত্তিক কার্যকর সমাধান গ্রহণ করা উচিত। একইসঙ্গে, ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মোবাইল অপারেটরদের ফাইবার কেবল স্থাপনে আরোপিত বাধাগুলো দূর করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ফাইবার অপটিক কেবলকে মহাসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। ডিজিটাল ট্রাফিকের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে আমাদের দরকার আট-দশ লেনের মহাসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ে। অথচ সেখানে পুরান ঢাকার 'চিপাগলির' মতো অবকাঠামো দিয়ে এ মহাযজ্ঞ পরিচালনা করা হচ্ছে। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, পিসি ও ট্যাবের মতো ডিভাইসে অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়তই বাড়িয়ে তুলছি এ ডিজিটাল ট্রাফিক।
ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণের আগে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি সোজাসাপ্টা মূল্যায়ন করা দরকার। সম্প্রতি প্রযুক্তি খাতের বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওমডিয়া ফাইবার ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (এফডিআই) র্যাঙ্কিং প্রকাশ করেছে। এ র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানির দিকে।
২০২০ সালে ওমডিয়ার মূল্যায়নে অন্তর্ভুক্ত ৮১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ৮১তম। ২০২১ সালে ৮১টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল ৭১তম। ২০২২ সালে ৮৮টি দেশের মধ্যে আমরা ছিলাম ৬৯তম, এবং ২০২৩ সালে ৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৭০তম অবস্থানে ছিল। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ফাইবার নেটওয়ার্ক উন্নয়নের জন্য আমরা কিছু কাজ করেছি, তবে তা এখনও একেবারেই অপ্রতুল।
এবার দেশে ফাইবার নেটওয়ার্কের অবস্থা দেখে নেওয়া যাক। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে জাতীয় টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) লাইসেন্স চালু হওয়ার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে প্রায় এক লাখ ৫৩ হাজার কিলোমিটার ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হয়েছে।
এ সময়ে এনটিটিএন লাইসেন্সধারী দুটি বেসরকারি অপারেটর কার্যত একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। পরে ২০১৯ সালে তৃতীয় আরেকটি বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটর এ খাতে প্রবেশ করে। ফাইবারের মানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে দুটি বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটর এ খাতে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রেখেছে, এবং একটি নিরবিচ্ছিন্ন ও শক্তিশালী ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তৈরির পরিবর্তে, তাদের স্থাপন করা মোট ফাইবারের ৭৮ শতাংশই বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঝুলন্ত ওভারহেড। যা অত্যাধুনিক ৪জি ও ৫জি সেবা প্রদানের জন্য একেবারেই মানসম্মত নয়।
পাশাপাশি, এনটিটিএন অপারেটরগুলো ফাইবার লিজের ক্ষেত্রে ক্যাপাসিটি-ভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করে ফাইবার ব্যবহারের খরচ ৩ থেকে ৭ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে, সারাদেশে মোবাইল নেটওয়ার্ক সাইটগুলোর মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ফাইবার অপটিক কেবল দিয়ে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়েছে।
ফাইবার কেবলের মান বিচার করলে সেখানেও মিলবে উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান। দেখা গেছে, ফাইবার-সংযুক্ত সাইটগুলোর আউটেজ রেট ৪.৩২ শতাংশ, যেখানে মাইক্রোওয়েভ-সংযুক্ত সাইটগুলোর আউটেজ রেট মাত্র ০.৫৪ শতাংশ।
গ্রাহকদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তাদের প্রধান উদ্বেগ হলো সেবার মান ও খরচ। উভয় ক্ষেত্রেই এনটিটিএন পদ্ধতি আমাদের গ্রাহকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অর্থাৎ, একটি জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি আমরা। এ সমস্যার একটি টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।
সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। প্রথমত, আমরা কি আশা করছি যে টুজি যুগের লাইসেন্সিং ফ্রেমওয়ার্কে যে এনটিটিএন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল তা ফোরজি বা ফাইভজি যুগের চাহিদা মেটাতে সক্ষম? দ্বিতীয়ত, আমরা কি ফাইবার অপটিক কেবল-ভিত্তিক ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের সক্ষমতা বাড়ানোর মতো অবস্থায় আছি? তৃতীয়ত, গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে এনটিটিএন লাইসেন্স কাঠামোর যে লক্ষ্য ছিল, তা অর্জিত হয়েছে কি? চতুর্থত, বর্তমানে বিদ্যমান বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটরদের আগামী ১৫ বছরের টেকনোলজি ও সেবার জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী ও পর্যাপ্ত বিনিয়োগের প্রয়োজন তা পূরণে সক্ষম? সর্বোপরি, গত ১৫ বছরে তৈরি ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক দ্রুত ডিজিটাল যাত্রার পথে বাধা দূর করতে যথেষ্ট?
সরকার মোবাইল অপারেটরদের ক্ষেত্রে মুক্ত বাজার নীতি গ্রহণ করায় টেলিযোগাযোগ খাত আমাদের দেশে সফল হয়েছে। একসময় আমাদের দেশে ছয়টি মোবাইল ফোন অপারেটর ছিল—যার মধ্যে পাঁচটি ছিল বহুজাতিক কোম্পানি এবং একটি ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত অপারেটর। সকলেই পরস্পর তীব্র প্রতিযোগিতা করেছে। তারা পাল্লা দিয়ে নেটওয়ার্ক ব্যবহারের খরচ কমিয়ে দিয়েছিল। নেটওয়ার্ক ও ব্যবসা বিস্তারের ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত সক্রিয় ছিল এবং প্রতি বছর যথেষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে। এরপর কিছু অপারেটর বিভিন্ন কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি। তাদেরকে ব্যবসা গুটিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। কখনোই কর্তৃপক্ষ কোনো অপারেটরের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার বিষয়টির দিকে গুরুত্ব দেয়নি।
অন্যদিকে, এনটিটিএন-এর ক্ষেত্রে আমরা একেবারেই ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাচ্ছি। লাইসেন্সিং ব্যবস্থাটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত চর্চার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ক্ষেত্রে মোবাইল অপারেটরদের নিজেদের ফাইবার সম্প্রসারণের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
অতএব, এ সমস্যা আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। এখন প্রশ্ন হলো—এর সমাধান কী?
মজার ব্যাপার হলো, এ এনটিটিএন খাত শুধু বাংলাদেশেই আছে তা নয়। তাই এর সমাধান করতে হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশ কীভাবে এর মোকাবিলা করেছে—তা মূল্যায়ন করতে হবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, একটি লাইসেন্সের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সুরক্ষাবাদী নীতি নয়, এ সমস্যা সমাধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুফল এনেছে মুক্ত বাজার নীতির মাধ্যমে।
এজন্য প্রথমেই দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির এ গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করতে সক্ষম যে কারও জন্য বাধা সৃষ্টি করে, এমন সব ধরনের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া উচিত। তার মানে এ নয় যে, স্থানীয় বেসরকারি এনটিটিএন অপারেটরদের বন্ধ করে দিতে হবে। মোটেও তা নয়! বরং কে এ ব্যবসার অংশ হতে পারবে বা পারবে না—তা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত।
আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত দ্রুততম সময়ে আমাদের ফাইবার নেটওয়ার্ক অবকাঠামোতে ব্যাপক বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা। একটি শক্তিশালী, ব্যয়-সাশ্রয়ী ও উচ্চ মানসম্পন্ন ফাইবার অবকাঠামো তৈরি করার জন্য এটি অপরিহার্য।
যদি কোনো স্থানীয় অপারেটরের এ ব্যবসায় বিনিয়োগ করার সক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকে, তাহলে অবশ্যই তাদের অনুমোদন দেওয়া উচিত। একইভাবে, যদি কোনো বিদেশি মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর বা অন্য কোনো দক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করতে চায় এবং তাদের সেই প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকে, তবে কেন তাদের বিনিয়োগে বাধা দেওয়া হবে? বিশেষত, যখন কিনা তা আমাদের এ জটিল সমস্যা সমাধান করতে পারে?
তবে, উপযুক্ত বিনিয়োগকারীদের নির্বাচন করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগকারী এ বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে পারে। তবে তাদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিও পূর্ণাঙ্গভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন যাতে আমরা তাদের ওই বিশেষ খাতে বিনিয়োগের দক্ষতার মূল্যায়ন করতে পারি। ফাইবার অবকাঠামোতে বিনিয়োগ কোনো ক্ষুদ্র বা মাঝারি পুঁজির ব্যবসা নয়। এটি একটি বিশাল বিনিয়োগের ক্ষেত্র এবং এর রিটার্ন হয় দীর্ঘমেয়াদি।
এ খাতে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত বিনিয়োগে আগ্রহ আছে কি না তা নির্ধারণ করেই তাদের বাজারে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া উচিত। তা না হলে বর্তমান পরিস্থিতি কোনোকালেই ঠিক হবে না। কারণ যে ধরনের ফাইবার অবকাঠামো আমাদের প্রয়োজন, তার চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করতে তারা চিরকালই হিমশিম খেতে থাকবে। এখন যদি আমরা দক্ষতার সঙ্গে সঠিক বিনিয়োগকারীদের নির্বাচন করতে পারি, তাহলেই কেবল দ্রুততম সময়ে পুনরুদ্ধারের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
পরিশেষে, আমি আশা করি, আমাদের ফাইবার অবকাঠামো উন্নয়নে উন্মুক্ত বাজারের প্রতি আস্থা রেখে আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারব। আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় জেনেছি উন্মুক্ত বাজারের প্রতি বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হলে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাই, যুক্তিসঙ্গত চিন্তাভাবনা ও দক্ষ বিনিয়োগকারী নির্বাচনের একটি সুসংগঠিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়া গেলেই সবার জন্য মঙ্গল।
নিয়াজ মোহাম্মদ সিদ্দিকী: স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন পেশাদার এবং জেনারেল ম্যানেজার, মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন, রবি আজিয়াটা পিএলসি।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।