আমেরিকান নিষেধাজ্ঞা স্নায়ুযুদ্ধের নতুন রূপ
ট্রাম্পের পথই অনুসরণ করছেন জো বাইডেন। বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয়ের রণকৌশল একই রকমের। কর্তৃত্ববাদ তাদের লক্ষ্য। তাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে। ট্রাম্পের বিদায়ের পর ধারণা করা হচ্ছিল, নতুন বিশ্ব পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক পরিসরে বাইডেন ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করছেন। বিশ্বের অন্যান্য অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে পুরাতন কায়দায় দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছেন। চায়না ও রাশিয়ার সাথে পূর্বসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসৃত নীতি বাস্তবায়ন করছেন। বাহ্যিকভাবে কিছুটা পার্থক্য বিশ্ব রাজনীতিতে ঘটানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তা খুব কার্যকর কিছু নয়। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্বে সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষ নিয়েছেন বাইডেন। মার্কিন অস্ত্র সেখানে পৌঁছতে শুরু করেছে।
বিশ্বের ১০০ দেশ নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'গণতান্ত্রিক সম্মেলন' অনুষ্ঠিত হয়েছে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো মূলত বর্তমান মার্কিন বৈদেশিক নীতির সহযাত্রী ও সমর্থক। এই সম্মেলন থেকে দূরে রাখার অন্যতম কারণ হতে পারে, সাম্প্রতিক বাংলাদেশ চীন সম্পর্ক। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে আসলে চীন ঐ প্রকল্পে কারিগরি সহায়তার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে কার্যকর সখ্যতা অর্জন করে এবং তা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুখকর নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘকাল যাবত ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান উভয়ই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলত তাদের অস্ত্র বাণিজ্যের স্বার্থে। এই ধারা থেকে ডোনান্ড ট্রাম্প বেরিয়ে এসে ভারতের মোদির সরকারের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। উদ্দেশ্য, রাশিয়ার সাথে ভারতের সামরিক সহায়তার সম্পর্কে ভাগ বসানো। ভারতের সাথে চীনের বৈরিতা ডোনাল্ড ট্রাম্প কাজে লাগিয়ে ভারত মার্কিন সহায়তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। গত মার্কিন নির্বাচনে মোদি প্রকাশ্যে ট্রাম্পের জন্য ভোট প্রার্থনা করেছিলেন। কিছুটা হলেও জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
তবে আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের বিলুপ্তির বিরুদ্ধে কোন মত প্রকাশ করেনি । কাশ্মীরি জনগণের উপরে অব্যাহত ঘটনাসমূহকে কীভাবে দেখে তাও তাদের দিক থেকে প্রকাশ করা হয়নি। তারপরও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে প্রতিযোগিতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা চীনের সঙ্গে শুরু হয়েছে তার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। চীন সক্ষমতায় এখন ক্ষেত্রবিশেষে মার্কিনীদেরকে ছাড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলেশন। এর টেকনোলজির দিক থেকে চীন অনেক বেশি অগ্রসরমান। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই মার্কিনীদের ছাড়িয়ে গেছে চীন। এমনি একটি অবস্থায় মার্কিন পলিটিশিয়ানরা চীনের উত্থান মেনে নিতে পারছে না। সেকারণে মার্কিন প্রশাসনের সর্বস্তরে চীন বিরোধী আবহ তৈরি হয়েছে। তারই অনুসরণে পৃথিবীর নানা দেশে নানা বৈদেশিক নীতি সৃষ্টি হচ্ছে।
পদ্মা সেতুতে কারিগরি সহায়তা দিয়ে বর্তমান সরকারকে বড় ধরনের রাজনৈতিক সাফল্য আনতে সহায়তা করেছে চীন। ২০০১ পরবর্তী সরকার বাংলাদেশে তাইওয়ানের ট্রেড সেন্টার খোলার অনুমতি দিয়ে চীনের সাথে স্থায়ী একটা বৈরিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যা বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চীনের সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাইওয়ান প্রশ্নটি চীনের জন্য স্পর্শকাতর। যে মার্কিনিরা আজ তাইওয়ানের পক্ষ নিয়ে এতো কথা বলে, তারাই ১৯৭২ সালে তাইওয়ানের জাতিসংঘের সদস্য পদ বাতিল করে চীনকে অন্তর্ভুক্ত করে। অথচ আমাদের সরকার কোন যুক্তিতে বা কোন প্রেক্ষিতে তাইওয়ানের কনস্যুলেট অফিস করার অনুমতি দিয়েছিল তা বোধগম্য নয়। আজ বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকার ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোষানলে পড়েছে এ কথা বলা যেতে পারে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মানবতার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই বেশি যায়।
'ব্যাপক বিধ্বংসী' অস্ত্রের কথা বলে গোটা ইরাক ধ্বংস করে দেওয়ার দায় তারা কীভাবে এড়িয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ইরাক, মিশর, লিবিয়া এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির দায় মার্কিনিরা এড়াতে পারে না। এতগুলো ভুল ও অনৈতিক যুদ্ধের জন্য তারা কখনই বিশ্ববাসীর কাছে কোন কৈফিয়ত দেয়নি রবং আজ তারা বিশ্বের নানা প্রান্তের মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র খুঁজে বেড়ায় যা প্রতারণার সামিল।
মার্কিনিদের বিরুদ্ধে কোনো অবরোধ সৃষ্টি করা যায় না কারণ, মার্কিন মুদ্রা ডলার বিশ্ব বাণিজ্যের চালকের আসনে দখল করেছে অনেক আগেই। ডলারের নিয়ন্ত্রণ মার্কিনীদের হাতে। যে কারণে তারা তাদের ইচ্ছামত যে কোন দেশের প্রতি বিভিন্ন ধরনের অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে। বাংলাদেশের একটি বিশেষ বাহিনী কিংবা প্রাক্তন সামরিক বাহিনী প্রধান অথবা বর্তমান পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য অনেক দেশের, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিরুদ্ধেও এ ধরনের অভিযোগ আছে।
যদিও অন্য অনেক দেশের মত আমাদের দেশেও দীর্ঘদিন যাবত 'বন্দুকযুদ্ধের' গল্প প্রচলিত আছে। বন্দুকযুদ্ধ দিয়ে পৃথিবীর নানা দেশের নানা ইতিহাস রচিত আছে। কোন কোন দেশে বন্দুকযুদ্ধ সমস্যার একটি আপাত সমাধান হয়ত দিয়েছে কিন্তু মধ্যদিয়ে আরও হাজারটা সমস্যার জন্ম দিয়েছে। যেমনটি আমাদের দেশের মেজর সিনহার ঘটনা। থাইল্যান্ড, ভারত, ফিলিপিন, কলাম্বিয়া, ব্রাজিলসহ পৃথিবীর বহু দেশে বন্দুকযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। প্রচলিত আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের শৈথিল্য, আইন প্রয়োগের অদক্ষতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার ফলে জনমনে বন্দুকযুদ্ধের প্রতি এক ধরনের সমর্থন তৈরি হয়। মানুষ অত্যাচারি ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীর বিনাশ দেখতে চায়, বন্দুকযুদ্ধ কখনো কখনো মানুষের সেই ইচ্ছা পূরণের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এই প্রবণতা বিপদজনক। এটা সভ্যতা ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইনের কোন দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের কোন সীমাবদ্ধতা বা বিচারে যে কোন ধরনের দীর্ঘসূত্রিতা প্রতিরোধ করা গেলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা তৈরি হবে এবং বন্দুকযুদ্ধের প্রতি নির্ভরতা দূর হবে।
আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বিরাট অংশ এই দুটি বলয়ের উপর নির্ভরশীল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এখন আমাদের গার্মেন্টস শিল্পের দ্রুত বিকাশ সংঘটিত হয়েছে। এটা সম্ভবত চীন- মার্কিন বাণিজ্য দ্বন্দ্বের একটি ফসল। তারপরও আমাদেরকে সমস্ত বিষয়টাকে খুব গভীর মনোযোগের সঙ্গে দেখতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি। আজকেই প্রথম আলো পত্রিকার একটি তথ্যচিত্রে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চাল আমদানিকারক দেশ! এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মাথায় রেখে আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য অটুট রাখার স্বার্থেই যেন আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি প্রতিফলিত হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা অত্যন্ত জরুরি।