অবশেষে অ্যালকোহল নিয়ে মৌলিক প্রশ্নটিই জিজ্ঞাসা করা হয়েছে
অবশেষে, সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তোলা হলো- বাংলাদেশে অ্যালকোহল কেনো মাদক হিসেবে গণ্য হয়?
দীর্ঘদিন ধরে আমাদের একান্ত আলাপচারিতায়ও বারবার উঠে এসেছে এই একই প্রশ্ন। শেষ পর্যন্ত আইন, স্বরাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের এ ধরনের লেবেলিংয়ের পেছনে যুক্তি ব্যাখ্যা করতে বলেছে হাইকোর্ট।
অ্যালকোহল যদি আসলেই মাদক হয়, তাহলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক আমদানিকারক। বিষয়টি আমাদের দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো কিছু নয়।
তবে, এ প্রশ্নের উত্তরে কোনো যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না থাকলেও থাকতে পারে অস্বস্তিকর ও তিক্ত কিছু উত্তর।
প্রথমেই, মাদক ও অ্যালকোহলের মধ্যে পার্থক্য জেনে নেওয়া যাক। হাজারো বছর ধরে চলে আসছে অ্যালকোহলের ব্যবহার। অ্যালকোহলের প্রাচীনতম চিহ্ন পাওয়া গেছে লেভান্টে, যা বর্তমানে ফিলিস্তিনের পার্শ্ববর্তী এলাকা হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া, এই অঞ্চলেই মানুষ প্রথম কৃষিকাজ শুরু করে। অ্যালকোহলের জন্য প্রয়োজন মল্ট। স্বাভাবিকভাবেই যাযাবর জীবন থেকে বসতি স্থাপনকারী মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনতম চাষীদের হাতে তৈরি হতো পানীয় উপযোগী বিয়ার। এমনকি বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতাগুলোতেও অ্যালকোহলের ব্যবহার ও সেবনের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়।
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সামাজিক পানীয় অ্যালকোহল। সারা বিশ্বের শক্তিশালী এবং সম্মানিত পুরুষ ও নারীদের ডিনার টেবিলে পরিবেশিত হয় এটি। ইসলামী দেশগুলো ছাড়া, প্রায় সব দেশেই মদ বৈধ। এই পণ্যটি মাদকদ্রব্য হলে এত জ্ঞানী পুরুষ ও নারীরা এটিকে নিশ্চই ব্যাপকভাবে সেবন করতে পারতেন না।
বাংলাদেশে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ বা অপ্রাপ্যও নয়। তবে, এর পেছনে রয়েছে একটি অদ্ভুত এবং ভণ্ড আইন। সে আইনে বলা আছে, একজন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে একজন ডাক্তারের স্বাক্ষরিত লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে যেখানে ভুয়া নির্দেশনা লেখা থাকবে। আইন অনুযায়ী সেই নির্দেশনায় লাইসেন্সধারীর স্বাস্থ্যগত কারণে মাসে সাত ইউনিট অ্যালকোহল পান করার কথা লেখা থাকতে হবে।
আদতে এটি কখনোই সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যগত কারণে একজন ব্যক্তির কখনই অ্যালকোহলের প্রয়োজন পড়ে না। অ্যালকোহলের প্রতিটি ফোঁটাই বিষ। মানুষের হার্ট, কিডনি, লিভার, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ এবং অবশ্যই মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে এটি। শুধুমাত্র একজন মদ্যপ ব্যক্তিই মাসে সাত ইউনিট অ্যালকোহল পান করতে পারে।
ফলে, অ্যালকোহল পান করতে এই বাধ্যতামূলক সরকারি মিথ্যার আশ্রয় নিতে বাধ্য হন বাংলাদেশিরা; এমন একটি পানীয় যা বিশ্বের সবখানেই অবাধে পান করা যায়।
এই দেশেও যে মানুষ অবাধে মদ্যপান করেনা, তা কিন্তু নয়। অনেক উচ্চপদস্থ থেকে শুরু করে প্রায় সব পেশার অনেক লোককে আমি সুস্থ অবস্থায় প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করতে দেখেছি। কিন্তু ন্যায়পরায়ণতার নীরব-নিস্তব্ধ আবরণের ছায়ায় এসব যুক্তিকে অস্বীকার করা হয়।
তাহলে, কেন প্রয়োজন এই 'লাইসেন্স'? এবং কেনোই বা অ্যালকোহলকে মাদকদ্রব্য হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে?
কাউকে সহজেই মামলায় জড়ানো ও জেল খাটানোর হাতিয়ার হিসেবে একে ব্যবহার করা বেশ সহজ। আমরা অতীতে এবং সাম্প্রতিক দিনগুলোতেও অনেকবার এমনটি হতে দেখেছি । এরমধ্যে, নায়িকা পরীমনির ঘটনাটি বহুল আলোচিত। মানুষকে হয়রানির লক্ষ্যে ব্যবহৃত হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে অ্যালকোহল।
একইসাথে, এটি চাঁদাবাজির হাতিয়ারও হয়ে উঠেছে। আমি অ্যালকোহল বহনকারী কিছু লোকদের চিনি যাদের পথ আটকে টাকার দাবি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই টাকা পেয়ে তবেই ছাড়া হয় তাদেরকে।
এসবের পর অবশেষে অ্যালকোহলকে মাদক হিসেবে গণ্য করা মৌলিক প্রশ্নটি তুলেছে হাইকোর্ট। এটি শুধুমাত্র অ্যালকোহল সেবন নিয়ে একটি সাধারণ প্রশ্ন নয়; বরং নৈতিকতা এবং নীতিশাস্ত্রের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন এটি।
- লেখক: সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
- মূল লেখা: At last, the pertinent question about alcohol has been asked
- ভাষান্তর: সাদিয়া আফরিন শায়লা