নারীর অবমাননা ও জাতীয় সংসদে নারী সদস্যদের ‘নীরবতা’
দেশে নারী অবমাননার ঘটনা ঘটছে, নারীর প্রতি অশ্লীল ও অশালীন আচরণ করা হচ্ছে, খুব সহজেই ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। সাধারণত রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে এবং পরিবারে নারী নির্যাতন এবং অবমাননার ঘটনা দেখা যায়। এর বিরুদ্ধে অভিযোগ দিলে বিচারের ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু ক্রমেই দেখা যাচ্ছে নারী নির্যাতন এবং অবমাননার ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের কর্মী, নেতা এবং এমনকি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরাও জড়িয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে যখন সরকারের মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য দ্বারা নারীর অবমাননা ঘটছে। এসব দেখে এবং শুনে আমরা আতংকিত হচ্ছি।
লক্ষ করার বিষয় যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিবাদ হচ্ছে প্রচুর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রতিবাদে গরম হচ্ছে। নারী সংগঠন এবং নেত্রীরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিবৃতিও দিচ্ছেন। কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়, মূল ধারার পত্রিকা পাশ কেটে যায়, তার মূল কারণ যারা এসব অপরাধ করছে তাঁরা ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য কিংবা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত কেউ হলে তো কথাই নাই। সবাই চুপ হয়ে বসে থাকছে। এমনকি অনেক সামাজিক ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও মুখ খুলছেন না। এমনই এক পরিস্থিতিতে আমরা এখন বাংলাদেশ ৫০ বছরের বিজয় দিবস পালন করছি। আমরা কথায় কথায় বলি ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং আড়াই লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই কথায় যদি আমাদের বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকে তাহলে এই বাংলাদেশের মাটিতে কি করে এতো নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অশ্লীল ও অশালীন আচরণ থাকতে পারে? একটি স্বাধীন দেশের নারী কেন ক্রমাগতভাবে অবমাননার শিকার হবে?
সবার প্রতিবাদ হলেও জাতীয় সংসদে এর কোন প্রতিফলন না দেখে প্রশ্ন জাগে, জাতীয় সংসদ আসলে কাদের জন্য? মোট ৩৫০ আসনে সংসদে ৭৩ জন নারী সদস্য সাধারণ আসনে নির্বাচিত এবং সংরক্ষিত আসনে আছেন। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় সংসদে আইন প্রণেতা হিসেবে বসতে পারা অবশ্যই বড় ধরণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়। জাতীয় সংসদে পুরুষ কিংবা নারী যেই হোক জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই বসেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে সংসদ সদস্য বলতে পুরুষরাই ছিলেন। জাতীয় সংসদে সাধারণ আসনে পুরুষদের আধিপত্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণেই ছিল, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। রাজনীতিতে নারী-পুরুষের অসম প্রতিযোগিতা ও সুযোগের কারণে নারী সংসদে বসতে পারেন নি, এখনও সেই অসুবিধা রয়ে গেছে। এখন যুক্ত হয়েছে টাকার জোর এবং পেশিশক্তির প্রতিযোগিতা। তাই দেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব রাখার চিন্তা অবশ্যই ইতিবাচক ছিল। নারীদের জাতীয় সংসদে আনতে হলে, সাময়িকভাবে হলেও, তাদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করার প্রয়োজন ছিল। সেটাই করা হয়েছে। ১৯৭২ সালে সংবিধানের ৬৫(২) ধারায় জাতীয় সংসদে ৩০০টি আসন এবং ৬৫(৩) ধারায় ১৫টি আসন কেবল মহিলাদের জন্যে "সংরক্ষিত" রাখা এবং এই ১৫ জন আইনানুযায়ী পুর্বোক্ত সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। এবং এই সুবিধা প্রথম ১০ বছরের জন্যে রাখা ছিল। কিন্তু ৩১৫ আসনের সংসদ হলেও ১৫টি আসনের নির্বাচনের ভার জনগণকে দেয়া হয়নি। ধারণা করা হয়েছিল ১০ বছর অভিজ্ঞতা অর্জন করে এই নারীরা সরাসরি নির্বাচন করতে পারবেন, কারণ সাধারণ আসনে নির্বাচন করতে কোন বাধা ছিল না। কিন্তু দশ বছর পার হবার আগেই ১৯৭৮ সালে এই সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ৩০ এবং মেয়াদ ১৫ বছর করা হয়, অর্থাৎ ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত করা হয়। এখানেই বড় ধরণের ভুল হয়ে গিয়েছিল। মেয়াদ ও আসন সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি ছিল। নারীদের জন্যে আসনগুলো সরাসরি জনগণের ভোটে বা নারীদের ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে করার বিধান শুরু থেকে থাকলে সংরক্ষিত আসন থাকলেও সেখানে নারী স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার বাধ্যবাধকতা থাকত।
এরই মধ্যে অনেক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। যারা এই আসন নিয়ে ভেবেছিলেন তারা আর ক্ষমতায় ছিলেন না, ফলে যে সরকার এসেছে তারা নিজের মতো করেই সংরক্ষিত আসনে নারীদের বসিয়েছেন। বসাবার দায়িত্ব ছিল পুরুষ সদস্যদের ওপরই। তারা এই আসনগুলোকে জাতীয় সংসদে নিজের দলের বোনাস হিসেবেই দেখেছেন। এই বোনাস সদস্যদের নিস্ক্রিয়তা স্বৈরশাসনের আমলে জেনারেল এরশাদের চোখেও লেগেছিল। তিনি এই আসনগুলোকে "একসেট অলংকার" আখ্যায়িত করে অবমাননাকর মন্তব্য করেছিলেন।
এরপর বারে বারে গণতান্ত্রিক সরকার এলেও ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বড় দুটি দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতার পালা বদল করেছেন, এবং সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত আসন সংখ্যা ৫০ হয়েছে। কিন্তু কেউই নির্বাচন পদ্ধতি পাল্টাননি। তাঁরা তাঁদের দলের নারী নেত্রীদেরকে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন। শুধু এখন পার্থক্য হয়েছে এইটুকুই যে আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সকল আসনের মালিক হয়ে যেত এখন তার আনুপাতিক হারে সংসদে অংশগ্রহণকারি অন্যান্য রাজনৈতিক দলও দু'একটি আসন পাচ্ছে। তাই এই সংসদে ৫০ আসনের মধ্যে জাতীয় পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ও বিএনপির নারী সদস্যও আসন পেয়েছেন। ইন্টার পার্লামেন্টরি ইউনিয়নের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংসদে মোট ৭৩ জন নারী সদস্য আছেন, যা মোট আসনের মাত্র ২০%; তার মধ্যে ৫০ জন সংরক্ষিত আসনের বা পরোক্ষ নির্বাচিত। তাদের বাদ দিলে সরাসরি নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য মাত্র ২৩ জন। পৃথিবীর অনেক দেশেই জাতীয় সংসদে নারীর সংখ্যা ১০% কম, সেদিক থেকে সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান খুব খারাপ নয়।
কিন্তু পরিসংখ্যানে বাড়লেও কোন মতেই সংরক্ষিত ৫০টি আসন গুণগতভাবে পিছিয়ে আছে। এই আসন গুলোতে মনোনয়ন পাবার জন্যে বিশাল লাইন ধরে, তদবির হয়, তাবেদারিতে যে বেশি ভাল তার স্থান আগে হয় – এসব চলছে। প্রতিটি বড় দলে নারী সদস্য আছেন, তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত আছেন এবং দেশের ও জনগণের জন্যে তাঁদের ভাবনাও আছে। কেউ কেউ নারী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। তাই আমি বলতে চাই যে এই আসনে যারা বসেছেন তাঁরা সবাই 'অ-যোগ্য" নন ; বরং বলতে হয়, তাঁদের যোগ্যতা ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই। সরকার দলীয় নারী সংসদ সদস্যরা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে কথা বললে টেবিল চাপড়ে সম্মতি জানাতে পটু হয়ে গেছেন। কেউ কেউ কোন নিয়ে বক্তব্য দিতে গেলে লিখিত তোষামোদী বক্তব্য পাঠ করেন, যার মধ্যে নারীর প্রসংগ কদাচিৎ থাকে।
তবুও প্রশ্ন উঠছে, আজ যখন একজন প্রতিমন্ত্রী এবং একই সঙ্গে সংসদ সদস্য নারীর বিরুদ্ধে এতো অবমাননা করেন, সেখানে এই ৭৩ জন নারী সদস্যরা কী করে চুপ হয়ে থাকেন? তাঁদের নীরবতা প্রমাণ করে তাঁরা জাতীয় সংসদে নারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে বসেননি, বসেছেন দল এবং নিজের ব্যাক্তিগত স্বার্থে। তাঁরা কি বলতে পারেন না যে এই ধরণের পুরুষ সব নারীর সম্মানের জন্যে হুমকি? তাঁরা কি ব্যাক্তিগতভাবে কিংবা দলগতভাবে কোন বক্তব্য দিতে পারেন না? সরকার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী যেখানে মুরাদ হাসানকে মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেছেন, সেখানে কি সংসদের নারী সদস্যরা এই বার্তা পান না যে বিষয়টা প্রধানমন্ত্রী ভালভাবে নেন নাই? সংসদে সদস্যপদ নিয়ে হাইকোর্ট বলেছে এটা স্পীকারের এখতিয়ার। স্পীকার ড শিরীন শারমীন চৌধুরি একজন নারী, তিনি আইনে পড়াশোনা করেছেন। কাজেই এখানে তাঁরও তো দায়িত্ব রয়েছে একটা এমন সিদ্ধান্ত দেয়ার যা এই জাতীয় সংসদের মর্যাদা বাড়াবে। তাঁর অবস্থান প্রমাণ করবে যে এই জাতীয় সংসদে অন্তত নারী বিরোধীদের স্থান হবে না।
আমরা অনেকেই সমাজে নারী স্বার্থে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করি এবং জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হবার জন্যে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্যদের কাছে যাই। বিভিন্ন সভায় তাঁদের আমন্ত্রণ জানাই এবং তথ্য উপাত্ত দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে অন্তত অন্যান্য সাংসদদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। এই ব্যাপারে আমরা সফলও হয়েছি এবং অনেক নারী সংসদ সদস্যের কাছ থেকে আন্তরিক ও ইতিবাচক সাড়াও পেয়েছি। সাধারণ আসনে যেসব নারী নির্বাচিত হয়ে এসেছেন তাঁদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে জবাবদিহিতা আছে। তারা শুধু নারী নয় সকল মানুষের পক্ষে কথা বলবেন, এটাই প্রত্যাশা থাকে। তাই বলে তাঁরা নারী হয়ে নারীর অবমাননার বিরুদ্ধে কথা বলবেন না এটাই বা কেমন কথা? তাদের দায়ও তো কম নয়। সংরক্ষিত নারী আসনের তো কোন নির্বাচনী এলাকা নেই। তাঁরা নিজ এলাকার জন্যে কাজ করতে চাইলেও তাঁদের প্রধান জবাবদিহিতা তো এই নারী সমাজের কাছেই। তাঁরা নারী বলেই এই আসন গুলোতে বসেছেন শুধু নিজেদের জন্যে নয়, দেশের নারীদের অধিকার রক্ষার জন্যে। নারীর অমর্যাদা হলে তাঁদের কি মর্যাদা বজায় থাকে? সংসদেরই কোন পুরুষ সদস্য দ্বারা নারীর অবমাননা হলে, যা স্বয়ং প্রধান মন্ত্রী আমলে নিয়েছেন, তাঁদের কি কিছুই করণীয় নেই? এর জন্যে কি নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে তাঁদের কাছে তদবীর করতে হবে?
নারী সংসদ সদস্যদের "নীরবতা" এই অবমাননায় আরো খারাপ মাত্রা যোগ করবে।
আমরা আশা করবো এই নীরবতা নিশ্চয়ই ভাঙ্গবে।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী