রাজশাহী: আধুনিক এক শহরের প্রতিফলন
শহর বা নগর সভ্যতার উৎপত্তি মূলত মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মধ্য দিয়ে। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে শিল্প বিপ্লবের শুরু হয় এবং এর বিরূপ প্রভাব পরে মানুষের ওপর। অতিমাত্রায় শিল্পকারখানা স্থাপনের কারণে শহরগুলোতে জায়গার অনুপাতে বাড়তে থাকে জনসংখ্যা। ফলে দ্রুতগতিতে অপরিকপ্লিত নগরায়ন ঘটতে শুরু করে।
শিল্প বিপ্লবের ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে শহরকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে 'নগর বা শহর পরিকল্পনা'-র প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। নগর পরিকল্পনা বলতে বোঝায়, ভূমির সঠিক বিভাজন, পরিকল্পিত উপায়ে শহরের প্রতিটি উপকরণ যেমন রাস্তাঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এছাড়া, এলাকার ধরণ ও প্রয়োজন অনুযায়ী ইমারত নির্মাণ ও বিন্যাস, শহরের মানুষের জন্য বাসস্থান, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ ও পয়োঃনিষ্কাশণ ব্যবস্থার পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা পূরণও এর অন্তর্গত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সর্বোপরি, একটি শহরকে শহরে বসবাসকারী সকলের জন্য বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলাই নগর পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য।
জাতিসংঘের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর শতকরা ৬৮ শতাংশ মানুষ শহরে বসবাস করবে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সুপরিকল্পিত শহর নিশ্চিত করতে 'আধুনিক শহর' বা 'স্মার্ট সিটি' ধারণার উদ্ভব। আধুনিক শহর বলতে কোনো শহরের সেই উন্নয়নকে বোঝায় যেখানে সম্পদের সঠিক, সুষম ও সুষ্ঠু বন্টণ নিশ্চিত করা হয়। এখানে তথ্য ও প্রযুক্তির উপর অনেক বেশি জোর দেয়া হয়।
একটি আধুনিক শহর গঠন করতে হলে সে শহরকে ছয়টি বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে হবে। বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: আধুনিক সরকার বা স্মার্ট গভারনেন্স, আধুনিক অর্থনীতি বা স্মার্ট ইকোনমি, আধুনিক পরিবেশ বা স্মার্ট এনভায়রনমেন্ট, আধুনিক জীবনযাত্রা বা স্মার্ট লিভিং, আধুনিক গতিশীলতা বা স্মার্ট মবিলিটি, আধুনিক মানুষ বা স্মার্ট পিপল।
একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শহরগুলোকে আধুনিকায়ন করে তোলার জন্য কিছু বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে উন্নয়নের সাথে জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্তকরণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন, কাঠামোগত উন্নয়ন, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ, পরিবেশ এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ এনং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি।
উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সময়োপযোগী ব্যবহার আধুনিক শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য যা বর্তমানে বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আধুনিক শহর গঠনের উদ্দেশ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হাতে নেয়া হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে 'ক্যাম্পেইন ফর স্মার্ট সিটি ইন বাংলাদেশ'। এছাড়াও, আইসিটির উপরে বর্তমানে বিশেষভাবে জোর দেয়া হচ্ছে। এর প্রতিফলন নগর উন্নয়নের সকল ক্ষেত্রে দেখা যাবে।
রাজশাহী বাংলাদেশের অতি প্রাচীনতম এবং ঐতিহ্যমন্ডিত একটি জেলা। রাজশাহী শহরকে রেশমনগরী বা সিল্কনগরী হিসেবে সম্বোধন করা হয়।বর্তমানে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে ৩০ টি ওয়ার্ড অন্তর্ভুক্ত এবং ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী এখানকার জনসংখ্যা ৪,৪৯,৭৫৬। পদ্মার তীরে অবস্থিত এ শহরটি উত্তরদিকে ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হচ্ছে। যেহেতু এখন পর্যন্ত রাজশাহী শহরে অতিমাত্রায় নগরায়ণ ঘটেনি, এজন্য একটি আধুনিক শহর হিসেবে এটিকে গড়ে তোলার সুযোগও বেশি।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তপক্ষ (আরডিএ) ২০ সাল মেয়াদী মাষ্টার প্ল্যান তৈরি করেছে এবং ১০-সাল মেয়াদী এরিয়া প্ল্যানও তৈরি করা হয়েছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন 'ভিশন ২০১৮' নামে একটি উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজশাহী শহরকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে স্বচ্ছল করে তোলা এবং আইসিটি গ্লোবাল ভিলেজ এর সাথে একে সমন্বিত করা।
রাজশাহী শহরকে আধুনিকায়ন করার লক্ষে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরকম প্রকল্প শুরু হয়েছে এবং সেগুলো চলমান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সড়ক নির্মাণ, উন্নয়ন এবং সড়ক বর্ধিতকরণ । সিটি বাইপাস তৈরি একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। নগরায়নের সাথে সাথে বর্ধিত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ৫ টি নতুন ফ্লাইওভার তৈরির উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া হাই টেক পার্কের নির্মাণ রাজশাহী শহরকে উন্নয়নের নতুন দিকে ধাবিত করবে বলে আশা করা হয়।
এছাড়া, রাজশাহী শিক্ষানগরী হিসেবেও পরিচিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উন্নতকরণের চেষ্টা চলছে।
এসবের পাশাপাশি ড্রেইনেজ সিস্টেম এর উন্নয়নের উপরে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেহেতু রাজশাহী শহর পদ্মা নদীর পাশে গড়ে উঠেছে, তাই এখানে বন্যা হবার একটি আশংকা থেকে যায়। যাতে করে জলাবদ্ধতা তৈরি না হয় এবং শহরবাসীকে বর্ষাকালে।
ভোগান্তি না পোহাতে হয় সেজন্য এই দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরণের প্রায় ৯৩.৪ কিলোমিটার ড্রেইন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাশাপাশি শহর রক্ষাকারী বাধ নির্মাণ ও এর সংরক্ষনসহ সৌন্দর্য বর্ধনের কাজও করা হয়েছে। কাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে রাজশাহী একটি দৃষ্টান্ত। এটি নিঃসন্দেহে আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য।
নগর পরিকল্পনা বা আধুনিক শহরায়ন সবসময় পথচারীদের চলাচলের উপর গুরুত্ব দেয়। এখন রাজশাহী শহরে ফুটপাথ নির্মানের উপরও কাজ হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে এখন দৃষ্টিনন্দিত ফুটপাথ তৈরি হচ্ছে। রাজশাহী এশিয়ার একটি গ্রিন সিটি হিসেবে পরিচিত। এই সুনাম ধরে রাখতে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সিটি কর্পোরেশন বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে।
উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি সংরক্ষণ ও যথোপযুক্ত ব্যবহার উপযোগী করে তোলার জন্য উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে রাজশাহীর শহীদ এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা উন্নয়নের কাজ চলছে। পদ্মার পাড়ের সৌন্দর্য বর্ধনের কাজও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাজশাহীর বিভিন্ন স্থানে ভরাট হয়ে যাওয়া এবং প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পুকুরগুলোকে পুনঃরুজ্জিবীত করার প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।এছাড়াও শহর ও শহরের মানুষের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য গুরুত্বপুর্ণ ইন্টারসেকশন গুলোতে লাগানো হয়েছে ফ্ল্যাশ লাইট।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একটি আধুনিক শহর হিসেবে গড়ে তুলতে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। জোর দিতে হবে আরও উন্নয়নের দিকে। রাজশাহীতে এখনও অনেক সমস্যা রয়ে গেছে সেগুলো সমাধানের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। শহরের কাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু একই সাথে এটিও পর্যালোচনা করে দেখা দরকার সব উন্নয়ন বা পুনঃনির্মাণের আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা।
সড়ক নির্মাণের জন্য অনেক পুরনো স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে যা বহুযুগ আগের ঐতিহ্যকে ধারণ করে। আধুনিক শহর কিন্তু ঐতিহ্য সংরক্ষণ কেও গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে পদ্মা নদীর ধার ঘেষেই নির্মিত হচ্ছে হাই-টেক পার্ক। এই স্থাপনার কারণে যাতে করে পদ্মা নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভাটা না পড়ে সেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে।
এছাড়াও পরিবেশদূষন যাতে না হয় সেজন্য যথাযথ নিষ্কাষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। রাজশাহী শহর উন্নয়নের একটি বড় সুযোগ হল প্রকৃতি রক্ষার পরিকল্পনা। পদ্মার ধারে, বিভিন্ন পার্কে, উন্মুক্ত স্থানগুলোতে সঠিকভাবে ল্যান্ডস্কেপ প্ল্যানিং করতে হবে। এছাড়া, বাচ্চাদের খেলার পার্কগুলোর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
ড্রেইনেজ নেটওয়ার্কের পাশাপাশি সাস্টেইনেবল আরবান ড্রেইনেজ সিস্টেমের উপর বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন।
স্মার্ট সিটি ইনডেক্স ২০২০ অনুযায়ী, বিশ্বের ১০৯টি স্মার্ট সিটি বা আধুনিক শহরের তালিকা করা হয়েছে। দুঃখের বিষয় হল, রাজধানী ঢাকা এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি। অতি মাত্রায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট আরও বিষয় এর জন্য দায়ী। অপরদিকে রাজশাহী পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে এখন পরিচিতি লাভ করেছে এবং উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে।
যেসকল উন্নয়ন হয়েছে তার পুরোটাই স্মার্ট সিটি গভারনেন্সের উদাহরণ। এই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে এবং আধুনিক শহরের মূল উদ্দেশ্যকে চিন্তা করে উন্নয়ন করা হয়, তাহলে রাজশাহী হতে পারে বাংলাদেশের আধুনিক শহরের উদাহরণ।
- লেখক: বিভাগীয় প্রধান, নগর ও পরিকল্পনা বিভাগ (ইউ আর পি), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)।