প্রাথমিক শিক্ষার সকরুণ অবস্থা!
গত ২৩ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরপর্বে শিক্ষামন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, দেশে বর্তমান কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ১৯ হাজার ১৯৯টি। ধারণা করা হয় প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকা কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কিত কিছু তথ্য তুলে ধরেছে। সে অনুযায়ী, ২০০৮ সনে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২০০টি। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের আমলে ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
কওমি মাদ্রাসার প্রবর্তকরা নারীর প্রতি কতটা বিদ্বেষ পোষণ করে, তা আমরা নারীকে তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা দেওয়ার বয়ান থেকে জানি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকারের আমলে ধর্মীয় শিক্ষার নামে এই কওমি শিক্ষার ব্যাপক বিকাশ ঘটেছে। অথচ সরকারের বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে প্রকাশিত ২০২০ সালের প্রতিবেদনে কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই।
ব্যানবেইসের প্রতিবেদনে কওমি মাদ্রাসা ছাড়া অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যায়। ২০১৫ সাল থেকে নিয়মিত তথ্যবহুল প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ব্যানবেইস। এসব প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার নানা তথ্য উঠে আসে। যতদূর জানা যায়, ইউনেস্কো ও ইউনিসেফের মতো সংস্থাগুলো সঙ্গে এ ধরনের প্রকাশনার জন্য সরকারের চুক্তি আছে। সম্ভবত তাদের অর্থায়নে এটি প্রকাশিত হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। এর ফলে দেশের মানুষ এবং গণমাধ্যম কর্মীরা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল চিত্রটি জানতে পারে।
গভীরভাবে রিপোর্টের দিকে মনোযোগ দিলে প্রাইমারি স্কুল, উচ্চশিক্ষা, আলিয়া মাদ্রাসা সংক্রান্ত অনেক তথ্য এখানে যুক্ত। শুধুমাত্র দেশের কওমি মাদ্রাসা সম্পর্কিত তথ্য এখানে নেই।
ব্যানবেইসের ২০২০ সালের প্রতিবেদন যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দুজন সচিব এবং শিক্ষামন্ত্রীর বাণী দেখতে পাব। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী কিংবা সচিব কারোর বাণীই এই প্রকাশনায় সম্পৃক্ত করা হয়নি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে যে প্রাথমিক শিক্ষা, সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিংবা তার সচিবের বাণী প্রকাশনায় না থাকা মানুষের কাছেও একটি বার্তা পৌঁছায়। তা হলো, প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি সম্ভবত অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তবে এই প্রকাশনায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা দেখতে পাই। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিয়ে প্রকাশিত তথ্যগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১০ সালে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সম্মিলিত সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৯৫ হাজার ২৮১ জন। ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৪৮ হাজার ২০১ উন্নীত হয়।
আবার ২০২০ সালে এই সংখ্যা ২০১০ সালের থেকে কমে ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৪৮০ জনে পৌঁছায়। একইভাবে শিক্ষার্থীদের সংখ্যার একটি চিত্রও আমাদের সামনে উঠে আসে। ২০১০ সালে সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলো মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৭০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৪। আবার ২০১৬ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮৬ লাখ ২ হাজার ৯৮৮। ২০২০ সালে এসে সেই সংখ্যা প্রায় পূর্বাবস্থা অর্থাৎ ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩ হাজার ৮৪৯ জনে ফিরে গেল।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেখান থেকে শুরু সেখানেই এই ব্যাপক তথ্য তারতম্যের ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়া যাবে না। কী কারণে গত ১০ বছরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ল বা কমল তার ব্যাখ্যা এই রিপোর্টটিতে কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই।
এর সাথে যদি আমরা স্কুলের সংখ্যা দেখি, সেক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা ২০১০ সালে ছিল ৭৮ হাজার ৬৮৫টি। ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১ লক্ষ ২৬ হাজার ৬১৬টিতে উপনীত হয়। আবার আমরা দেখতে পাই, ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯০১। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার ৮৪৭। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ১ লাখ ২৯ হাজার ২৫৪। আবার ২০২০ সনের ১ লাখ ৩৩ হাজার ২টি। অর্থাৎ, গত কয়েক বছরে প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা বাড়েনি। দেশের প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থার এই তথ্যচিত্র আমাদের নদী ভাঙ্গনের কাহিনীই মনে করিয়ে দেয়। আমাদের প্রাইমারি শিক্ষাব্যবস্থা একটি ভঙ্গুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।
রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা সরকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই মারাত্মক চিত্রটি বেরিয়ে আসে। পাশাপাশি যদি মাদ্রাসা এবং কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাব্যবস্থা লক্ষ্য করি, তাহলে কত ব্যাপকভাবে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে তা দেখতে পাই। শিক্ষার্থী হিসেবে দেশের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী এখন কিন্ডারগার্টেনমুখী হয়ে উঠেছে।
ব্যাননেইসের প্রতিবেদনে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপকহারে কিন্ডারগার্টেনের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাইমারি শিক্ষা নানামুখী ধারায় বিভক্ত। সরকারি প্রাইমারি, বেসরকারি প্রাইমারি, কিন্ডারগার্টেন, কাওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি। বিষয়টি জাতির জন্য মর্মান্তিক।
দেশে একটি একক শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। প্রাইমারি স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি একরকম স্থবির হয়ে পড়লেও থেমে নেই কাওমি মাদ্রাসার সংখ্যা। বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসার যে ব্যাপক সংখ্যা আমরা জানলাম, তাদের শিক্ষা কার্যক্রম তারা নিজেরাই এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এসব মাদ্রাসার ওপর সরকারের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আছে তা ব্যানবেইস প্রতিবেদনে তাদের সংশ্লিষ্টতা না থাকা থেকেই প্রমাণ করা যায় ।