জাতীয়ভাবে আয়োজিত এরকম একমাসব্যাপী বইমেলা পৃথিবীতেই সম্ভবত নেই: এনামুল করিম নির্ঝর
স্থপতি এনামুল করিম নির্ঝর কিন্তু আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, সংগীতলেখক আর গ্রাফিক ডিজাইনারও। তিনি 'আহা' চলচ্চিত্র, 'ভূত' রেস্তোরাঁ বা 'নীনাকাব্য' নামের বাড়ি তৈরি করে সুনাম কুড়িয়েছেন।
এখন মনোযোগ দিয়ে একুশে বইমেলাটাকে গুছিয়ে দিচ্ছেন। এ নিয়ে তার সঙ্গে আলাপে বসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
কবে, কিভাবে বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হলেন?
২০১৯ সালে জানতে পারলাম, আমাকে 'অমর একুশে বইমেলা'র পরিচালনা কমিটিতে রাখা হয়েছে। তারপর বইমেলার নকশা ও অন্যান্য নান্দনিক বিষয় তদারকির প্রস্তাব করা হলো। আমিও সানন্দে যুক্ত হলাম। বিষয়টা কাকতালীয়, আমি অনেকদিন ধরেই আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপনকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন মাধ্যমের সৃজনশীল পেশাজীবীদের নিয়ে একটা প্রক্রিয়া গড়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এখানে তার কিছুটা সুযোগ মিলে যাওয়ায় খুব আগ্রহের সাথে দায়িত্বটা নিয়ে চেষ্টা করলাম একটা আগ্রহী দল সংগঠিত করতে। হাতে সময় খুব ছিল না, এছাড়া যারা বাস্তবায়ন করেন, তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একধরনের বোঝাপড়ার মাধমেই বইমেলায় আমি ও আমার প্রতিষ্ঠানের বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা চর্চার যাত্রা শুরু। তারপর থেকেই আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি প্রক্রিয়াটাকে মজবুত করতে যেন ভবিষ্যতেও তা উপযোগী হয়ে ওঠে।
সৃজনশীল পেশাজীবীদের যুক্ত ভাবনায় কর্তৃপক্ষ, অংশগ্রহণকারী, পৃষ্ঠপোষক, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা দল এবং অন্যান্যদের বোঝাপড়ায় আয়োজন সমৃদ্ধ হয়।
স্থপতি হিসেবে আপনার কেন আগ্রহ হলো এ বিষয়ে?
স্থাপত্য এমন একটি বিষয়, যার মাধ্যমে আপনি চাইলে জনগোষ্ঠীকে নানা মাত্রায় সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবিত করতে পারেন। স্থাপত্যের শক্তি অনেক বিস্তৃত, যা দিয়ে আপনি জীবন ও যাপনকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন। স্থপতি হিসেবে এই আয়োজনকে আমি এদেশের উদযাপন স্থাপত্য চর্চার অন্যতম সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করি। তাই নিজ উদ্যোগেই বেশ সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি কতগুলো বিবেচনাবোধের তালিকা স্থির করে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে। অধিকাংশই পারিনি এখনো। তবে আশাও ছাড়িনি।
একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন?
অস্থায়ী হলেও একমাসের জন্য এই এলাকায় রাতে ঘুমানোর জায়গা ছাড়া মোটামুটি বাকি সব সুযোগ সুবিধাই প্রয়োজন হয়।
এটাকে যতটা সম্ভব জনবান্ধব করে ভাবনার দিক থেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। অবস্থানগত তাৎপর্য থেকে শুরু করে অনায়াসে, স্বাচ্ছন্দে যাতায়াত, তথ্য, বই এবং লেখকদের নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম ইত্যাদিকে সম্ভাবনা, সামর্থ, সমস্যা এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।
এমন একটা স্থানে বইমেলা হয়- যেখানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের স্মৃতি আছে, স্বাধীনতা স্তম্ভ আছে, শহীদ মিনার আছে, বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা ইনস্টিটিউট আছে। ইতিহাস, রাজনীতি, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাজধানীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য এটা।
সুতরাং এই প্রাঙ্গণের আয়োজনকে অতীত স্মৃতির সাথে সম্পৃক্ত করে চৈতন্য জাগ্রত করার চেষ্টাও অন্যতম দায়িত্ব। আমাদের পূর্বপুরুষরা দেশ স্বাধীন করার জন্য, মাতৃভাষার জন্য রক্ত দিয়ে তা অর্জন করেছেন, সেই ভাষার মাসেই আমরা বইমেলা করছি। একটানা একমাস ধরে বই নিয়ে এমন আর কোনো আয়োজন তো জাতীয়ভাবে আমাদের নেই। পৃথিবীতেও সম্ভবত নেই। তাই বইমেলার সামগ্রিক পরিকল্পনাকে স্থপতিদের জন্য অনুশীলনের চমৎকার একটি সুযোগ মনে করি। এটাকে শুধুমাত্র বছরের নিয়মিত প্রকল্প না ভেবে, একটু প্রক্রিয়া হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ দিলে ভবিষ্যতে তরুণ স্থপতি ও অন্যান্য সৃজনশীল পেশার কর্মীদের আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
নাগরিক হিসেবে আমাদের অভ্যাস, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিচর্চা বিষয়ে আমাদের অবস্থান এবং জাতীয় ভাবমূর্তি গড়তে দায়িত্ববোধ ইত্যাদিকে ঘঁষামাজা করতে এটা চমৎকার ক্ষেত্র। এই আয়োজন আমার কাছে সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে জাতীয় রুচিবোধ এবং চৈতন্যচর্চার বাৎসরিক মহড়া। এই একটা মাস থেকেই পাওয়া যেতে পারে সারা বছরের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুপ্রেরণা।
মেলার বয়স তো প্রায় আমাদের স্বাধীনতার সমান। কেন স্থপতিকে সম্পৃক্ত করার কথা এতদিনেও ভাবা হলো না?
সেটা আমি জানিনা, তবে পেছনে না তাকিয়ে বরং এই সময়টায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে কী করতে পারি সেটা ভাবা এবং বাস্তবায়নই সবচেয়ে জরুরি বিষয় আমার কাছে। হয়তো এটাকে তেমন জরুরি মনে করা হয়নি।
আমাদের তো দুই ধরনের মানসিকতা। একদল সবকিছুকেই শুধুমাত্র প্রকল্প হিসেবে দেখে এবং যা সাময়িক। যার লক্ষ্য মূলত উপার্জন। আরেক দল প্রকল্পকে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্ত করতে চেষ্টা করে যায়। তাতে উপার্জন, অর্জন সবটাই হয়, তবে ধাপে ধাপে। একটা ভিশন তো থাকতে হবে কর্তাব্যক্তিদের, মানে তাদের অ্যাপ্রোচটারও মেরামত হওয়া জরুরি।
সবক্ষেত্রেই এদেশে খুব কম সংখ্যক মানুষ কাজকে প্রসেস হিসাবে দেখে। এই প্রসেস বা প্রক্রিয়া প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত হয়। যদি এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখি তাহলে যে কোনো কাজই ক্রমশ সমৃদ্ধ হতে পারে।
অমর একুশে বইমেলার আয়োজনকে কেন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখবো না?
একবছরের আয়োজন শেষ হলে তার সফলতা, ব্যর্থতা, সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে আগামী বইমেলা কী হতে পারে, কারা দায়িত্ব নেবে এসব ভাবনা তো প্রক্রিয়ারই অংশ। এমন উপলব্ধি হলে দূরদৃষ্টির চর্চায় সংশ্লিষ্টরা বুঝতে চেষ্টা করবেন আগামী আয়োজনগুলো আসলে কেমন হতে পারে।
বইমেলার সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে খুশি হয়েছেন বললেন, খুশিকে কিভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন?
প্রাথমিকভাবে খুশি হয়েছি, কিন্তু ভাবনা উন্মুক্ত করার চেষ্টায় নানান সংগ্রামে হাবুডুবু খাচ্ছি। আর অধিকাংশেরই ধারণা আমি ডিজাইন মানে শুধু লে-আউটের একটা প্রাথমিক নকশা আর কিছু অলংকরণ করে দেব। আসলে তো বিষয়টা তা নয়। বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা প্রক্রিয়া হিসেবে আমি আমার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহকর্মীদের সাথে স্থাপতিক বিষয়গুলোর বিবেচনা ও প্রয়োগ থেকে শুরু করে নান্দনিকতা, পারস্পারিক সম্প্রীতি, যুক্ত উদ্ভাবনী চেষ্টা ইত্যাদিতে আগ্রহীদল গড়ার সূচনা করেছি মাত্র।
এতোদিন বাংলা একাডেমি তাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিয়মিত একভাবে মেলাটাকে আয়োজন করেছে। এটাকে পরবর্তী স্তরে নিতে আমাদের জন্য এটা সুযোগ মাত্র। এ কারণে আগ্রহীদল গড়া জরুরি, স্থপতি মূল দায়িত্ব নিলেও লেখক, প্রকাশক, শিল্পী, কুশলী, প্রযুক্তিবিদসহ অন্যসকল সৃজনশীল পেশাজীবী এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে এটা করতে হবে। বাংলা একাডেমি কতৃপক্ষ আগ্রহী হলে আমার সামান্য মেধা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অমর একুশে বইমেলাকে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে পারে।
তারা আমাকে রেখেছে কিছুটা সংযুক্ত, বিযুক্ত দশায়। যে কারণে আমি মনে করি না তেমন সাফল্য আনতে পেরেছি । উদাহরণ দিয়ে বলি, ধরুন গত বছর থেকে মহামারির কারণে নানান অনিশ্চয়তায় কোনকিছুই ঠিকমতো হয়নি। বারবার বলেও কাউকে বোঝাতেই পারিনি, এটাতো সংকটকালীন ব্যবস্থাপনা চর্চার বিশাল একটা সুযোগ ছিল। আমরা সেভাবেই একটা সৃজনশীল প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করার চেষ্টা করতে পারতাম। যেটা ভবিষ্যতের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকতে পারতো। প্রয়োজনে প্রকাশক এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলোচনা বা কর্মশালা করা যেতো । একটা ভিশন ফিক্স করে কিন্তু একইসঙ্গে এর ব্যবস্থাপনাগত দিক, বাণিজ্যিক দিক, সৃজনশীল, প্রযুক্তিগতসহ আরো যত দিক আছে সবমিলিয়ে একটা উপযোগী কর্মপন্থা বের করতে পারতাম। কিন্তু কোথায় যেন আটকে থাকলো।
আমি যতই বোঝবার চেষ্টা নিয়েছি, কেউ কেউ ভেবেছেন এটা আমার আমার ব্যক্তিগত স্বার্থ। সুতরাং খুশি হবার জন্য আমাকে আরো ধৈর্য নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এবছর তো কিছুই করতে পারিনি, খুবই এলোমেলো। আমার তরুণ সহকর্মীরা যারা দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল তারাও বেশ হতাশ। একটা বড় বিষয় কি, নতুন কিছু ভাবতে ভয় পাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। অজুহাতের পর অজুহাত। এসবের পরও বলবো কিছু ব্যক্তির প্রবল সমর্থনের কারণে আমাদের উৎসাহ টিকে আছে। এবার আগামী আয়োজনের জন্য অনেক আগে থেকেই আবারো বিস্তৃত আলোচনার চেষ্টা করবো । দেখি বোঝাতে পারি কিনা।
আপনি ব্যক্তিমানুষটিকে মেলার সঙ্গে কীভাবে জড়াচ্ছেন?
আমি একে বলি আইএসআর বা ইন্টেলেকচুয়াল সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি মানে বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তা দায়িত্বপালন চর্চা। করপোরেটরা যেমন সিএসআর করে ওদের টাকা আর ইচ্ছে দিয়ে। আমরা পেশাজীবীরা সেটা করতে পারি মেধা, দক্ষতা বিনিয়োগ করে। নিয়মিত জীবিকার জন্য উপার্জনের পাশাপাশি যার যেমন সাধ্য বা সুযোগ তা দিয়ে বিনামূল্যে সেবা দেয়ার চেষ্টা। আমরা দেশ, সমাজ, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কত কিছুই তো নিয়েছি, কত ঋণ আমাদের। ফেরত বা শোধ করার সরাসরি উপায় যেহেতু নেই, পে-ফরওয়ার্ড করতে চেষ্টা করতে পারি।
অনেকদিন ধরেই এরকম বেশ কিছু প্রক্রিয়ায় সক্রিয় আছি এবং ভবিষ্যতে আরো গুছিয়ে এটাকে একটা পর্যায়ে নিতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে উপলক্ষ্য করে 'নয় বছরের বড়' শিরোনামে একটা উদ্যোগকে বিস্তৃত করার জন্য ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। যাতে বিভিন্ন সৃজনশীল পেশাজীবীদের পারস্পারিক হয়ে উঠার সম্ভাবনা আছে। অমর একুশে বইমেলায় সম্পৃক্ত হওয়ার আগ্রহটা এই সূত্রেই। দেখি কতটা এগোতে পারি!
নকশায় নতুন কি কি থাকছে এবার?
এবার মনে হয় না নতুন কিছু পাওয়া যাবে। কিছুটা আগের বারের পুনরাবৃত্তি। নতুন নতুন চমৎকার সব চিন্তা ছিল। কিন্ত মেলা হওয়া না হওয়ার অনিশ্চয়তা এবং অন্যান্য জটিলতায় তেমন কিছু বৈশিষ্ট্য আনা সম্ভব হলো না। তবে আবারো বলি, নকশা এই প্রক্রিয়ার একটা মৌলিক অংশ মাত্র, যাকে কেন্দ্র করে সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে হয়। এখন অবধি এই ধারণাই আছে, স্টল প্যাভেলিয়নগুলোকে সারিবদ্ধ করা, কয়েকটা গেট, আনুষ্ঠানিকতার জন্য কিছু সাজসজ্জা। এগুলোর সাথে বিশেষ বৈশিষ্ট্য তৈরি করাও বিশেষভাবে জরুরি।
আগামী প্রজন্মের সাথে সাথে সম্পৃক্ততা, প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ততা, সারা দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষ ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ততা। বইমেলার প্রতি মানুষের প্রবল আগ্রহ, স্পৃহা ব্যাপক। এর সঙ্গে আমাদের ভাষার আন্দোলন, স্বাধীনতা যুদ্ধ, বাঙালি সংস্কৃতি, অনুভূতি-আবেগ ইত্যাদি সবই জড়িত। সেটাকে মাথায় রেখে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা দিতে পারলেই স্মৃতি নির্মাণ সম্ভব।
আপনি এটাকে কী ধরনের স্থাপত্যচর্চা বলছেন? ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেকচার? এর সাথে আপনার মূল পেশার কী সম্পর্ক?
আমি এটাকে উদযাপন স্থাপত্য বলি। উদযাপন ঘিরেই যেহেতু সমস্ত পরিকল্পনা সেভাবেই একটা শৃঙ্খলা পরিণত হতে পারে। তবে অবশ্যই স্থাপত্যের মূল সুর এবং ল্যান্ডস্কেপ এসবই বাস্তবতায় পারস্পরিক হয়ে ওঠে। এটা অস্থায়ী হলেও আমার মূল পেশার কাজের প্রক্রিয়া, বিবেচনাবোধ, অভিজ্ঞতা কাজে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা কি, এমন কাজ করার জন্য সাধারণ জ্ঞানটাই যথেষ্ট। আমরা মেলাটাকে ভালোবাসি, তাই একে একটা স্তরে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখি।
২০১৯ থেকে ২০২২ কতটা অগ্রগতি?
উনিশে আমরা কেবল জায়গাটাকে জ্যামিতিকভাবে ভাগ করতে পেরেছিলাম। ২০২০ এর মেলায় পরিধি বেড়েছিল অনেক, কার্যক্রমেও কিছুটা মাত্রাযোগ হয়েছিল। এ বছর পরিকল্পনায় ছিল যেহেতু স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর আর সেই সঙ্গে মুজিব বর্ষ তাই বঙ্গবন্ধুর 'কারাগারের রোজনামচা' বইটাকে থিম বা ন্যারেটিভ বা আখ্যান করে তুলতে। সুযোগ পেলে এটা এমন হতো যে শাহবাগ, টিএসসি, কাঁটাবন থেকে পলাশী হয়ে শহীদ মিনার হয়ে কার্জন হল পর্যন্ত একটা বলয় তৈরি করে একধরনের ইনস্টলেশন নির্মাণ। কিন্তু ঐ যে মেলা হবে কি হবে না, সেটা জানতেই তো সময় চলে গেল। এখন যে পর্যায়ে আছি আমরা, কর্তৃপক্ষ চাইলে অগ্রগতিটা স্পষ্ট করার জন্যই পারস্পারিক বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। লেখক-প্রকাশকসহ বাকি আগ্রহীদের নিয়ে আলোচনা উন্মুক্ত করতে হবে।
তাহলে সবমিলিয়ে কতটা ফল পেলেন?
এতো কেবল সূচনাপর্ব। কত রকমের জটিলতা, বলতে গেলে কাজই তো সেভাবে শুরু করা সম্ভব হয়নি। হয়তো বাহ্যিক কিছু বদলেছে। বিন্যাস কিছুটা স্বচ্ছন্দের হয়েছে, স্বাধীনতা স্তম্ভের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী প্রান্ত। কিন্তু বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, মাঝের রাস্তা সবকিছুর ভেতর একাত্মতা আনতে আরও বোঝাপড়া দরকার। সবচেয়ে বড় কথা, কেমন মেলা চাই? এই প্রশ্নের স্বচ্ছ উত্তরটাও জানা জরুরি।
তাছাড়া আয়োজনের চরিত্রটাকেও তো সময়োপযোগী করা জরুরি। বইকে কেন্দ্র করে কত ধরনের উদ্যোগ হতে পারে। সাহিত্যে, পাঠে, ভাষায়, রুচিবোধে সাধারণকে বিশেষ করে তরুণদের উৎসাহী করতে এই আয়োজন নতুন নতুন ধারণায় সমৃদ্ধ করা দরকার। সুতরাং এগুলো নিয়ে নানান ভাবনা থাকলেও এখনো তেমন কাজে লাগাতে পারিনি। ক্ষমতায় যারা থাকেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদৃষ্টি যা-ই থাকুক এগুলো শোনার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ২০২০ এ যেমন চারুকলা ও স্থাপত্যের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য স্থাপনা-ধারণা নামে প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন সংযুক্ত করেছিলাম, সাড়াও পেয়েছিলাম বেশ। কিন্তু আর এগোয়নি। নতুন পাঠকদের জন্য, প্রবাসীদের জন্য বেশ কিছু আইডিয়া এখনো কাজে লাগেনি। কিশোর, তরুণদের জন্য তো আলাদাভাবে কতকিছু করা দরকার।
আর কিছু বলতে চান আপনি?
আমরা যারা স্বপ্ন দেখি, নিঃস্বার্থভাবে লেগে থাকি প্রক্রিয়া নির্মাণের আশায় । চাই দেশের কাজে মেধা প্রয়োগ করতে। যেটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে, তরুণদের মধ্যে সেটা ছড়িয়ে দিতে। দেশের বয়স ৫০ হয়েছে, যেসব আয়োজন নিয়মিত হয়েছে সেগুলোকে ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচনা করে চর্চাকে সমৃদ্ধ করা অন্যতম প্রধান কাজ।
শিশু-কিশোর তরুণদের আগ্রহ বাড়াতে বইমেলার অবস্থানটিকে চিন্তা-চৈতন্যের গন্তব্য বানাতে কিছু স্থায়ী, কিছু অস্থায়ী অবকাঠামোর সমন্বয়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণকে সংযুক্ত করে ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা করা জরুরী। আশেপাশে বিভিন্ন উন্নয়নকর্ম চলছে, আগামী বিশ বছর পর বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার শততম উদযাপনে মেলার আয়োজন কেমন হতে পারে, তার সুযোগসুবিধা এখন থেকেই রেখে দিতে হবে।
সৃজনশীল নানা শাখায় বিচরণ করে আমার পুরো বিষয়টার প্রতি আলাদা আগ্রহ আছে । নিজে উদ্যোগ নিয়ে যতটা সম্ভব বলতে চেষ্টা করবো। তবে পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের আগ্রহটাও জরুরি। তারা এগিয়ে আসলে বিষয়টা সহজ হয়। মনোযোগ দিয়ে নতুন ধারণা শুনতে তো আর কোনো বাজেট লাগছে না তাদের।
যে যুগে উপার্জনের দাপটে অর্জন হারিয়ে যায়, সেসময়টায় যেকোন শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আয়োজন-উযযাপন ভিন্ন স্তরে নেওয়াটা সৃজনশীল পেশাজীবীদের দ্বায়িত্ব বটে! মাথায় একগাদা আইডিয়া নিয়ে যদি ঠিকমতো কাজে লাগাতে না পারেন, সেটা তো বিষাদের বিষয় । তারপরও বোঝাতে চেষ্টা করি, শুধুমাত্র নতুন বিন্যাস নয়, বরং অন্যান্য তরুণ পেশাজীবীদের আগ্রহী করে এই আয়োজনকে আরো বেশি সফল ও সমৃদ্ধ করা যায় কীভাবে। ভবিষ্যতের জন্য এমন কোনো মাস্টারপ্ল্যান যদি করা যায়, যেটাতে মূল মেলা ফেব্রুয়ারিতে হলেও, স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রাঙ্গণকে কাজে লাগিয়ে বছরে আরো কিছু উদ্যোগের ধারণা, সকলের আগ্রহীদের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি।
এই আয়োজন, উদযাপনটা যেন সামগ্রিক হয় সেই লক্ষ্যে কেউ লোগো এবং গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করবে, কেউ শিশু চত্বর, কেউ লেখক চত্বর বা অন্যান্য অংশের স্থাপত্য। কেউ বলবে, আরেকদল শুনবে, কেউ নিজের জায়গা করে নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠবে ইত্যাদি ইত্যাদি। রাষ্ট্র যেমন ভূমিকা রাখবে, প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগতভাবে আগ্রহীরাও কিছু কিছু ভূমিকা রাখবে।
এভাবেই তো নানান অনুশীলন চর্চার ভেতর দিয়েই একধরনের সভ্যতা গড়ে ওঠে। জাতীয়ভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই আয়োজনটিকে আমি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখি।