'চা-খোর'দের দেশে নেই চা, আছে 'চা-য়ে লাতে'!
চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন সারা দুনিয়ায় শীর্ষ দশ দেশের তালিকার বাইরে। এখনো আমাদের বার্ষিক মোট উৎপাদন ৮০ হাজার টনের সামান্য এদিক-ওদিক। অন্যদিকে, চীনের মোট বার্ষিক উৎপাদন ২৫ লাখ টনের মতো।
তবে, আমাদের উৎপাদন যা-ই হোক, আমরা 'চা-খোর' জাতি – কারণ আমরা চা 'খাই'। চা 'খাওয়া'র মতো চা নিয়ে কিছু পরস্পরবিরোধী বিষয় আমাদের মধ্যে আছে।
আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই 'চা' হিসেবে নিয়মিত যেটা পান করে থাকি সেটা আসলে 'চা-ভিত্তিক পানীয়'। দুধ-চিনি দেওয়া এই চা-কে এখন কেউ কেউ কায়দা করে 'চা-য়ে' অথবা 'চা-য়ে লাতে'ও বলে থাকেন।
পুরনো পাতি নাকি কাঁচা পাতি, ডাস্ট নাকি টি-ব্যাগ, ব্র্যান্ড নাকি আজিমপুর, চিনি কম নাকি চিনি বেশি, চিনি নাকি গুড় নাকি মধু, গরুর দুধ নাকি মহিষের দুধ নাকি গুঁড়ো দুধ নাকি কনডেন্সড মিল্ক, আদা নাকি লেবু নাকি এলাচ-তেজপাতা, টোস্ট বিস্কুটের গুঁড়ো নাকি ফেটানো ডিম- ইত্যাদি নানা প্রকারের ভ্যারিয়েশনের সুবাদে 'দেশি চা' এখন একটি সমৃদ্ধ ও বিচিত্র পানীয় প্রকরণে পরিণত হয়েছে।
সাত লেয়ার, তন্দুর, ফল, কাঁচামরিচ, ড্রাগন, ভেষজ ইত্যাদি নানা প্রকরণ নিয়মিত এখানে যোগ হচ্ছে। পুরান ঢাকায় গায়ে হলুদ, বিয়ে ইত্যাদি অনুষ্ঠানে 'শিরিন চা' এবং 'নামকিন চা' নামের দুটো বিশেষ রকমের চা পরিবেশন করা হতো। এর মধ্যে শিরিন চা পানের সৌভাগ্য হয়েছে। এটি আসলেই 'খাওয়া'র জিনিস – ঢাকাই পনির সহযোগে খেতে হয়। অন্যদিকে, নামকিন চা মোটেও তিব্বতী চা নয়। এটিও 'খাওয়া'র জিনিস যা শুকনো মিষ্টি সহযোগে খেতে হয়। পুরনো লোকজন যারা এই দুটো চা বানাতে জানেন তাদের কারো কাছ থেকে রেসিপি জেনে এগুলো নতুন করে বাজারে চালানো সম্ভব।
দেশের লোকজন দিনে কয়েক কোটি কাপ চা 'খেয়ে' থাকলেও এদেশে পরিচ্ছন্ন বা ভদ্রস্থ চায়ের দোকান প্রায় নেই। প্রায় সব চায়ের দোকানই হয় ছাপড়া অথবা টংঘর অথবা ফুটপাতের উপর। এর বাইরে আছে ফ্লাস্কভিত্তিক মোবাইল চা। অনেক রেস্টুরেন্টে চা বিক্রি করা হয় বটে তবে সেটা মূল খাবারের অনুসঙ্গ হিসাবে, স্বাধীন পদ হিসেবে নয়।
এদেশের কফির দোকানগুলোর কোনো কোনোটাতে চা পাওয়া যায় বটে তবে সেগুলোর কোনোটাই স্বাভাবিক চা নয়, হয় সেগুলো সাধারণ 'কালো চা' ব্যতীত রাজ্যের সব ঘাসলতাপাতা চা, নয়তো ঠাণ্ডা বরফ দেওয়া চা, অথবা মশলাপাতি এমন পরিমাণে মেশানো যে সেটা যে 'চা' তাই বোঝা যায় না। ঐসব কফির দোকানগুলোর মতো আজকাল মানুষের বাসাতে গেলে স্বাভাবিক চা চেয়েও পাওয়া যায় না। কারণ দেশি চা পান সম্ভবত এখনো 'জাতে উঠতে' পারেনি।
বাংলাদেশে চা উৎপাদিত হলেও আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এদেশে পাতার মান/গ্রেড, সুবাসের হেরফের, লিকারের হেরফের অনুযায়ী চায়ের যে শ্রেণিবিভাগ তা অনুযায়ী চা পাতা/গুঁড়ো কিনতে পাওয়া যায় না। এ কারণে কেউ নিজের ইচ্ছেমতো চা ব্লেন্ড করতে পারেন না।
এদেশে ভ্যারাইটি অনুযায়ী চা অর্থাৎ আসাম, দার্জিলিং, সিলোন ইত্যাদি চা দূরে থাক, ১৯৬৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নিজেদের চা ইনস্টিটিউটের আবিষ্কৃত বিটি'র ১৮টি, বিটিএস-এর ৪টি ও এনপিএস-এর ১টি ভ্যারাইটির চা পর্যন্ত বাজারে আলাদা পরিচয়ে পাওয়া যায় না।
দেশি চায়ের মধ্যে হবিগঞ্জের বাহুবলের বাগানগুলোর চায়ের লিকার নাকি সবচেয়ে কড়া হয়। বাজারে 'বাহুবলের কড়া চা' বলে কোনো কিছু কখনোই মেলেনি। ফলে চা পানের মধ্যে যে সূক্ষ্ম রুচিবোধ, শৌখিনতা, নিজস্ব সংস্কৃতি ইত্যাদির চর্চা গড়ে উঠতে পারতো, তা এখানে হয়নি।
মতিঝিলের আলিকো ভবনের পাশের ইস্পাহানীদের বিক্রয় কেন্দ্র থেকে আমাদের বাসার চা কেনা হতো, অন্তত মধ্য-নব্বই পর্যন্ত। 'গ্রীন স্পট', 'রেড স্পট', 'গ্রীন ডাস্ট' ইত্যাদি পেরিয়ে আশির দশক থেকে আমরা 'মির্জাপুর'-এ থিতু হই। অবশ্য টি-ব্যাগ কেনা হতো 'লিপটন'। মাঝে 'জেরিন' আর 'তাজা' চেষ্টা করে দেখা হয়েছিল – আমাদের পোষায়নি।
তার বহু বছর পরে বাণিজ্য মেলা বা অনুরূপ কোনো কোনো মেলা থেকে কেনা 'এইচআরসি', 'সিলোন', 'শ'ওয়ালেস', 'ডানকান', 'কাজী', 'ব্রুকবন্ড' প্রভৃতি চেষ্টা করে আমরা হয়রান হয়ে ওসব চেষ্টা বাদ দিয়েছি। এখনো ডাস্ট হলে 'মির্জাপুর', টি-ব্যাগ হলে 'তাজা' অথবা 'লিপটন'। আগে বড় বাজারগুলোতে ব্র্যান্ডবিহীন শুধু শুকনো চা বিক্রি করে এমন বেশ কয়েকটা দোকান থাকতো। সেগুলোর নামও হতো বাহারী – হ্যাপি ভ্যালি টি, রয়্যাল ভ্যালি টি, ইম্পেরিয়াল টি, মাউন্টেন টি ইত্যাদি। ব্র্যান্ডিং-এর দাপটে ওসব দোকানের অনেকগুলোই আজ আর নেই।
বাংলাদেশের বাজারে যে সবুজ চা বা গ্রীন টি ঢুকেছে সেটা বছর পঁচিশেকের বেশি আগে নয়। আমার গ্রীন টি ভালোই লাগে, যদি তা ভালো মানের হয়। যখন থেকে গণচীনে যাতায়ত করা শুরু হয় তখন থেকে এই ব্যাপারে পছন্দ-অপছন্দ তৈরি হবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমার কাছে পাতার মধ্যে লঙজিঙ, বিলৌচুন, গঙচা; ফুলের মধ্যে হাঙবাইজু; ফার্মেন্টেডের মধ্যে শ' পু'য়ের চা ভালো লাগে।
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে বাংলাদেশে উৎপাদিত গ্রীন টি না ভালো মানের, না কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডটা অনুসরণ করা না গেলে এই শিল্পটির কোনো বিকাশ হবে না। অথচ বাংলাদেশে গ্রীন টি শিল্পের ভবিষ্যত যথেষ্ট সম্ভাবনাময়।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাকে যখন চা ফোটানোর সুবাস এসে ধাক্কা মারে তখন মনে হয় সামনে বুঝি একটা চমৎকার দিন আছে। সিঙ্গারা, সমুচা, তেলেভাজা, ঝালমুড়ি, চানাচুর, টোস্ট বিস্কুট, বেলা বিস্কুট, বাকরখানি ইত্যাদির সাথে এক কাপ চা ছাড়া ভাবাই যায় না। বৃষ্টি বা শীতের দিনে, যে কোনো সন্ধ্যায় দু'হাতের মাঝখানে ধোঁয়াওঠা এক কাপ চায়ের বুঝি কোনো তুলনা হয় না।