‘আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা’ চালু হোক
'ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০' দেশের আদিবাসী জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য সুরক্ষা ও উন্নয়নের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সুরক্ষা এবং বিকাশের প্রশ্নে আমরা কোনো ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দেখতে পাইনি। আদিবাসী জনগণ রাষ্ট্রের উপনিবেশিক পরিচয়-রাজনীতি এবং জনমিতি-বাহাদুরির ঐতিহাসিক নিশানা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিতে ও ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসে 'হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসী ভাষা' শিরোনামে গণমাধ্যমে কিছু প্রচার প্রচারণা হয়। 'সব কিছু হারিয়ে গেল' বলে নাগরিক জীবনে কিছু উন্নয়নবাদী জাদুঘরমার্কা মেকি-কান্না চলে। কিন্তু আদিবাসী জনগণের ভাষা ও সাহিত্যের ন্যায়বিচার সুরক্ষায় রাষ্ট্র জান-জবান নিয়ে দাঁড়ায় না। রাষ্ট্র বরাবরের মতই বৈষম্যের বন্দুক নিয়ে চোখ রাঙিয়ে থাকে, আর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ঠোঁট ফুলিয়ে আমরা বলি 'সব ভাষাকে বাঁচাতে হবে'।
রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে ভাষা এমনি এমনি বেঁচেবর্তে থাকে না। এর জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা ও পরিচর্যার প্রয়োজন হয়। দেশের আদিবাসী জাতিসমূহের প্রত্যেকের মাতৃভাষার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক দর্শন ও নীতি বৈষম্যহীন এবং ন্যায়পরায়ণ হতে হবে। আদিবাসী ভাষাসমূহের টিকে থাকার প্রশ্নে দেশে 'মাতৃভাষায় আদিবাসীদের প্রাথমিক শিক্ষা' একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কিন্তু এখনো সব মাতৃভাষায় এই শিক্ষা চালু হয়নি। একটি ভাষা টিকে থাকার অনেক শর্তের ভেতর কাজ করে তার সাহিত্য ও যাপিতজীবনের চর্চার নিরাপত্তা, স্বীকৃতি ও মর্যাদা। রাষ্ট্রীয়ভাবে আদিবাসীদের ভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিয়ে 'আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা' চালু করা জরুরী। প্রতি বছর আদিবাসী ভাষায় এবং আদিবাসীদের রচিত ও নির্মিত সাহিত্যকীর্তিসমূহকে গুরুত্ব দিয়ে এই রাষ্ট্রীয় সম্মাননা চালু করা যেতে পারে।
সরকারের পক্ষে এই কাজটির দায়িত্ব নিতে পারে বাংলা একাডেমি কিংবা আদিবাসী বিষয়ক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। সাহিত্যকর্মের জন্য আদিবাসী শিল্পী সাহিত্যিকদেরও গুরুত্বপূর্ণভাবে একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদকসহ দেশের অন্যান্য সকল পদক ও পুরস্কারের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা জরুরি। মান্দি সমাজের শেরানজিংপালা, রেরে, আজিয়া, চাকমাদের রাধামন-ধনপুদি বা মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সমাজের রাসপালা, হাজংদের দেবীদুর্গাপালার মতো আদিবাসী জনগণের রয়েছে অবিস্মরণীয় সব মৌখিক আখ্যান। 'আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা' দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই মৌখিক ও লিখিত সাহিত্যকীর্তি উভয়কেই গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে বিবেচনা করা জরুরী।
২.
বাংলা সাময়িকপত্রে আদিবাসীকথা পুস্তকের ভাষ্যমতে, নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আদিবাসী-চর্চা শুরু হয় যতদূর সম্ভব ১৮৮৫ সাল থেকে। বিগত শতকের সত্তর পরবর্তী সপ্ত দশকে চাকমা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প ও সঙ্গীতে প্রথমবারের মত জোয়ারের সৃষ্টি হয়। চাকমা সমাজের এই নবজাগরণের যুগে বেশ কয়েকটি প্রতিশ্রুতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্মলাভ করে। ১৯৭২ সনে রাঙ্গামাটি শহরে জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর (জুভাপ্রদ), মুড়োল্যা সাহিত্য ও সংস্কৃতি গোষ্ঠী এবং গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী নামে তিনটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠে। ১৯৭২ সনেই বিঝু উপলক্ষ্যে জুভাপ্রদ তাদের প্রথম সাহিত্য সংকলন 'বিজু' এবং মুড়োল্যা সাহিত্য ও সংস্কৃতি গোষ্ঠী 'লুরা' নামে সংকলন প্রকাশ করে। ১৯৭৪ সনে গিরিসুর শিল্পী গোষ্ঠী চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা ভাষার কিছু 'আধুনিক গান' নিয়ে প্রকাশ করে গানের সংকলন 'শিঙ্গা'। ১৯৭০ সনে ১২টি শিশুতোষ চাকমা কবিতা নিয়ে রাঙ্গামাটি থেকে প্রকাশিত হয় সুগত চাকমার (ননাধন) ছোট কলেবরের কবিতার বই 'রাঙামাত্যা'। আদিবাসীদের ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি, শিল্প বিষয়াদির চর্চা, গবেষণা, প্রকাশনা ও প্রচারণার জন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সনে ঢাকায় গঠিত হয় 'রাঙ্গামাটি ঈসথেটিকস কাউন্সিল (রা-ক), পরবর্তীতে রাঙ্গামাটির স্থলে জুম বসিয়ে করা হয় জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক)। মুরল্যা লিটারেচার গ্রুপ ১৯৮০ ও রাঙ্গামাটি ঈসথেটিকস কাউন্সিল ১৯৮১ সনে চাকমাদের নিজস্ব উদ্যোগে পরপর রাঙ্গামাটি থেকে বাংলা বর্ণমালা ও চাকমা ভাষায় রাধামন-ধনপুদির প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশ করে। মৃত্তিকা চাকমার সম্পাদনায় সম্পূর্ণ চাকমা ভাষায় বাংলা হরফে ত্রৈমাসিক কবিতাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় রাঙ্গামাটি থেকে ১৯৮১ সনে।
৩.
কেবল চাকমা নয়, দেশের সকল নিপীড়িত জাতির শিল্প সাহিত্যের এক লড়াকু শ্রেণী ইতিহাস রয়েছে। এমনকি বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্য বিকাশেও রয়েছে আদিবাসী জনগণের ঐতিহাসিক ভূমিকা। ত্রিপুরা মহারাজ ধর্মমানিক্য ৮৬০ ত্রিপুরাব্দে (১৪৫০ খৃষ্টাব্দ) শুক্রেশ্বর এবং বানেশ্বরকে দিয়ে রাজমালা বাংলায় অনুবাদ করান। ত্রিপুরা জাতির সাহিত্য চর্চার সুবর্ণ অধ্যায় সূচিত হয়েছিল ১৮৬০ খৃস্টাব্দ থেকেই। সুরেন্দ্র কুমার দেববর্মা 'ত্রিপুরা ভাষা' নামে একটি সাহিত্যপত্রও প্রকাশ করেন ১৯০৩ সনে। ১৯১৭ সনে মহেন্দ্র দেববর্মার নাটকের বই পতিব্রতা প্রকাশিত হয়, রাধামোহন দেববর্মার ককবরক মা গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯০০ সালে। বাংলাদেশে ১৯৩৬ সনে খুশী কৃষ্ণ ত্রিপুরার গীতি সংকলন 'খা কাচাংমা খুম্বার' প্রকাশিত হয়। ১৩৭০ ত্রিপুরাব্দে প্রকাশিত হয় তার ককবরক ককতাং গ্রন্থটি। সুরেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বরেন ত্রিপুরা, নববিক্রম ত্রিপুরা, প্রবাংশু ত্রিপুরা, মহেন্দ্রলাল ত্রিপুরা ও শোভা ত্রিপুরাদের নিজস্ব ককবরক ও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা নানান বাধা আর নির্যাতনকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে এগিয়েছে।
৪.
ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর এলাকার মান্দি, কোচ, হাজং, বানাই, ডালু, হদি, রাজবংশী, লেঙাম জনগোষ্ঠীদের ভেতর মূলতঃ মান্দি ও হাজংদের ভেতরেই চলতি সময়ে মুদ্রিত সাহিত্যচর্চা বেশি দেখা যাচ্ছে। নেত্রকোণার দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ১৯৭৭ সনে প্রতিষ্ঠিত 'উপজাতীয় সাংস্কৃতিক একাডেমী' থেকে আদিবাসী সমাজের সাহিত্য দর্পণ ঘোষণা করে প্রায় অনিয়মিত 'জানিরা' নামে একটি প্রকাশনা প্রকাশিত হচ্ছে। এই পত্রিকায় মূলতঃ কিছু গান কবিতা এবং খুবই গতানুগতিক আলোচনা ছাপানো হয়। দারিং ১৯৯৯ সনে রোমান হরফে কিন্তু মান্দিদের আঞ্চলিক ভাষায় মোট সতেরটি গল্প লিখেছেন ছোটদের জন্য। মান্দিদের ভেতর জেমস জর্ণেশ চিরান, মতেন্দ্র মানখিন, সঞ্জীব দ্রং, জেমস ওয়ার্ড খকসী, বচন নকরেক, বাবুল ডি নকরেক, পরাগ রিছিল, রাখী ম্রং, মিঠুন রাখসামদের কবি ও লেখকেরা মূলতঃ বাংলা ভাষাতেই নিজস্ব সাহিত্য আওয়াজ তুলেছেন। সিলেটের আদিবাসীদের ভেতর মূলতঃ মৈতৈ মণিপুরী, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, খাসিয়া, মান্দি, হাজং, লেঙাম এবং চা বাগানের বিশাল আদিবাসী বাগানিয়া জনগণ বেশ জোরেশোরে সাহিত্য আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন । মৈতৈ মণিপুরী ভাষার কবি একে শেরাম ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার কবি শুভাসিস সিনহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখক। উত্তরাঞ্চলের সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, মাহালী আদিবাসীদের ভেতরও সাহিত্যচর্চা এবং লেখালেখির বেশ একটা জীবন্তধারা বহমান।
৫.
বাংলাদেশে আমরা আদিবাসীদের ভাষায় কিংবা বাংলা হরফে আদিবাসী ভাষায় বা আদিবাসীদের নিজস্ব হরফ এবং ভাষায় মূলতঃ কবিতা চর্চা করতেই দেখি বেশীরভাগ কবি ও লেখককে। অনেকেই গবেষণা প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, স্মৃতিচারণ, আলোচনা লিখে থাকেন। সম্পূর্ণ চাকমা বর্ণমালা ও ভাষায় দেবাশীষ চাকমার উপন্যাস ফেবো প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে, এটি প্রকাশ করে পোগাদাঙ, এর প্রচ্ছদ করেছেন হাপং ত্রিপুরা মিলন। এছাড়াও কিছু বাংলা হরফ এবং ভাষায় লেখা গল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন কেউ কেউ, বেশকিছু নাট্যচর্চা অব্যাহত আছে আদিবাসী ভাষায় এবং এলাকায়। চাকমা, মৈতৈ মণিপুরী, মান্দি, বিষ্ণপ্রিয়া মণিপুরী, ত্রিপুরা, সাঁওতালদের ভেতর মাতৃভাষা এবং অনেকের ক্ষেত্রে নিজস্ব বর্ণমালায় সাহিত্যচর্চার চল বেশী। ম্রো ভাষা ও বর্ণমালা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন ইয়াঙান ম্রো। সবকিছুর পরেও এও নিদারুণভাবে সত্য যে দিনে দিনে প্রশ্নহীন কায়দায় রক্তাক্ত হতে হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে আদিবাসী ভাষাসমূহ। আন্তজার্তিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট এখনো দৃশ্যমান সক্রিয়তা স্পষ্ট করেনি। পাশাপাশি আদিবাসী ভাষাসমূহের ব্যাকরণগত গবেষণাও করার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু আদিবাসীদের ভেতর যারা নিরন্তর সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন তাদের সৃষ্টি আখ্যানের কোনো রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার এখনও নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্র 'জাতীয় সাহিত্য' বলতে কেবলমাত্র 'বাংলা ভাষা ও হরফে রচিত' সাহিত্যকেই বোঝে এবং বোঝায়। রাষ্ট্রের এই অধিপতি মনস্তত্ত্ব বদলানো জরুরি। প্রতিবছর আদিবাসী ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানো উচিত। আদিবাসী জনগণের ভাষা ও সাহিত্য সুরক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রীয়ভাবে 'আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্য সম্মাননা' চালু করার মাধ্যমে মুমূর্ষু ভাষার পাশে ন্যায়পরায়ণতার খ্রাম নিয়ে দাঁড়াক রাষ্ট্র। খ্রাম, দামা, মাদল, প্লু বাজুক আদিবাসী জমিন থেকে জুমে, জুম থেকে বাংলা একাডেমি কি জাতীয় সংসদ অবধি। নিশ্চিত হোক আদিবাসী ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিক অহংকার।
- লেখক: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ