আমির হামজার নাম সবাই জেনে গেছেন!
আমির হামজাকে অভিনন্দন। তার নাম সবাই জেনে গেছেন। ইতিহাসের আমির হামজা ২২ মার্চ ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হন। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন আমির হামজা নামের একজন কবি। ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভের পর একটি সামাজিক বিপ্লবে শত্রু চিহ্নিত করে তাকে হত্যা করা হয় এবং এই কবি সমাহিত হন একটি গণকবরে। বাংলার পুঁথি সাহিত্যে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হামজা ১৭৬৫ থেকে ১৮১৫ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। ওহুদের বীর আমির হামজাকে নিয়ে ফার্সি গ্রন্থ 'দস্তান-ই-আমির হামজা' অনুসরণে সৈয়দ হামজা এবং ফকির গরীবুল্লাহ প্রশস্তিগাথা রচনা করেন। তারও আগে ১৬৮৪ সালে আবদুন নবী 'আমীর হামজা' রচনা করেন।
আমির হামজা বিংশ ও একবিংশ শতকেও থাকতে পারেন এবং এই নামের মানুষ বিপুল সুকৃতির অধিকারীও হতে পারেন। নিজ যোগ্যতায় কিংবা স্বজনের যোগ্যতায় তিনি পুরস্কৃতও হতে পারেন।
স্বাধীনতাবিরোধীও যদি কখনো স্বাধীনতা পুরস্কার পান, সরকার (কোন দলের সরকার সেটি মুখ্য নয়, মুখ্য সরকার নামের প্রতিষ্ঠান) নিশ্চয় বিরোধিতার মাহাত্ম্য আবিষ্কার করতে পিছপা হবে না। সাহিত্যের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার যখন কেউ পান, তিনি সাহিত্যাঙ্গণের শীর্ষ ব্যক্তিদের একজন হবেন এটাই তো প্রত্যাশিত।
সাহিত্য পুরস্কারের সংবেদনশীলতা অনেক বেশি বলেই ২০২২ সালে ঘোষিত স্বাধীনতা পুরস্কার—সাহিত্য বিভাগের জন্য বিজ্ঞ পরিষদ কর্তৃক বিবেচিত নাম আমির হামজা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে পড়েছেন এবং সাহিত্যের জন্য পুরস্কার আদৌ আমলা অধ্যুষিত কর্তৃপক্ষের কাছে রাখা নিরাপদ ও যৌক্তিক কি না সে প্রশ্ন উঠে এসেছে।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত পুরস্কার-মন্তব্যে বহু গ্রন্থের প্রণেতা মুনতাসীর মামুন বলেছেন, 'সাহিত্যে আমির হামজা সম্মাননা পেয়েছেন শুনে প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, সপ্তদশ শতকের কবি আমির হামজাকে পুরস্কারটি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সম্মাননাটি পেয়েছেন একজন মরণোত্তর ব্যক্তি। পরে দেখলাম, এ অন্য এক আমির হামজা, যিনি সাহিত্যিকমহলে পরিচিত নন এবং তার কাজ সম্পর্কেও কেউ কিছু জানেন না।'
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন জিজ্ঞেস করেছেন, 'উনি কে? আমি তো তাকে চিনি না।'
আরেকজন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমলার মতো শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন, 'যারা তাকে পুরস্কার দিয়েছেন, নিশ্চয়ই ভালোবেসেই দিয়েছেন।'
ভালবেসেই যদি পুরস্কার দিয়ে থাকেন, তারা কেন যে সরকার ও রাষ্ট্রকে তাদের ভালোবাসার সাথে জড়িয়ে বিব্রতকর অবস্থায় ফেললেন তা বলা ও বোঝা মুশকিল।
খবরের কাগজ দেখে যা মনে হয়েছে, বাণিজ্যসচিব আমির হামজাকে স্বাধীনতা পুরস্কার পাবার জন্য অত্যন্ত যোগ্য প্রার্থী বিবেচনা করেছেন বলে পুরস্কার প্রদানকারী পর্ষদও ভেবেছে এ সুপারিশ খণ্ডন করা গুনাহর কাজ হবে। সুতরাং, তাকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানে আর দেরি কেন?
১৯৭৭ সাল থেকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এর জন্য ১৩টি বিষয়ে 'দেশ ও মানুষের কল্যাণে অসাধারণ অবদান রাখিয়াছেন, এমন সীমিত সংখ্যক ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনা করা হইবে। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক জীবনের কৃতিত্ব (lifetime achievement) সবচাইতে বেশি গুরুত্ব পাইবে।'
বিষয়গুলো হচ্ছে: স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিদ্যা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, পল্লী উন্নয়ন, সমাজসেবা/জনসেবা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, গবেষণা ও প্রশিক্ষণ এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত অন্য যে কোনো ক্ষেত্র। সর্বশেষ বিষয়টির পরিধি দিগন্ত বিস্তৃত, সরকার নিজস্ব প্রাধিকার খাটিয়ে যে কোনো বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
কেউ কিংবা কারো সন্তান ও স্বজন পুরস্কারের জন্য লালায়িত হবেন, আবার কেউ পুরস্কার প্রত্যাখ্যানও করতে পারে এ বিবেচনা সরকারের আছে। প্রত্যাখ্যানের ঘটনা ঘটলে তা যে সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে তা বিবেচনায় এনে স্বাধীনতা পুরস্কার-সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে:
'পুরস্কারের জন্য মনোনীত কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠান/সংস্থা পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাইলে বা নির্দিষ্ট তারিখে পুরস্কার প্রদান করিবে মর্মে কোনো সুনিশ্চিত সম্মতি পাওয়া না গেলে নির্বাচিত ব্যক্তি/গোষ্ঠী/প্রতিষ্ঠান/সংস্থার নাম পুরস্কারপ্রাপ্তদের চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হইবে না। অর্থাৎ তাঁহার/তাঁহাদের নাম পুরস্কারপ্রাপ্ত হিসেবে ঘোষণা করা হইবে না।'
এটি অবশ্যই বিব্রতকর অবস্থা থেকে বাঁচার উত্তম পন্থা। কিন্তু নাম ঘোষিত হওয়ার পর যদি তা পুরস্কার প্রদানকারী কমিটির অপ-বিবেচনার কারণে বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করে সে অবস্থা থেকে গা বাঁচানোর/উত্তরণের কোনো সুযোগ আদেশাবলির কোনোটিতেই নেই।
গণমাধ্যমের একজন কর্মী সাইয়িদ রহমান আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সাহিত্যিক আমির হামজাকে চিনি কি না। সাহিত্যের পরিধি সম্ভবত অনেক বেড়ে গেছে এই ভেবে বললাম ইউটিউবের কল্যাণে এ নামের একজন ধর্মীয় বক্তার কথা শুনেছি, যুগপৎ রম্য ও সুরেলা ভাষা ব্যবহার করে থাকেন। নাকি অন্য কেউ?
সাহিত্য আমলা-বিচারকদের হাতে কতটা আদৃত হতে পারে তার প্রমাণ তারা দিয়েছেন।
মুনতাসীর মামুন সম্ভবত পুরো স্বাধীনতা পুরস্কার নির্বাচনেরই প্রক্রিয়া পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন।
আমার পর্যবেক্ষণ শুধুমাত্র সাহিত্যে সীমিত রেখে এই প্রস্তাবই করতে চাই, পুরস্কারের সাথে যদি সাহিত্য জড়িয়ে যায় তাহলে বাছাইয়ের কাজটি বাংলা একাডেমিকেই করতে দিন। তাতে বিভিন্ন সরকারের আমলের দলবাজির অভিযোগটি উঠলেও পুরস্কারটি পাবেন অধিকতর যোগ্য ও পরিচিত ব্যক্তি। অন্তত বাংলা একাডেমির সাবেক কর্মী, হালের চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন বলবেন না, 'উনি কে?'
- পাদটীকা: এমনও কি হতে পারে পুরস্কারদাতারা বলবেন, 'থুক্কু, আমরা আর সাহিত্য পুরস্কারের ধারেকাছেও থাকব না'?