পেগাসাস স্পাইওয়্যার: কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের বাহন যখন অস্ত্র ব্যবসা
কূটনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের সফল বাহন হিসেবে শক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্র অনেককাল ধরেই অস্ত্রকে ব্যবহার করছে। তবে ভয় দেখাতে নয়। বরং অস্ত্র বিক্রির বিনিময়ে কোনো দেশের কূটনীতির মোড় পরিবর্তন করে নিজ স্বার্থের পথে নিয়ে আসতে এমনটি করা হচ্ছে।
তেল আবিবভিত্তিক নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনের স্টাফ রাইটার রনেন বার্গম্যান এবং দুই দফা পুলিৎজার বিজয়ী ওয়াশিংটনের অনুসন্ধানী সাংবাদিক মার্ক ম্যাজজেনটি যৌথ ভাবে এক প্রতিবেদন তৈরি করেন। প্রতিবেদনে ইসরায়েলের সাইবারঅস্ত্র কূটনৈতিক বিজয় অর্জনের ঘটনাবলী ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে। রনেন বার্গম্যানের সর্বশেষ বই 'রাইজ অ্যান্ড কিল: দ্যা সিক্রেট হিস্টোরি অব ইসরাইল'স টারগেটেড অ্যাসাসিনেশন' সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। আর মার্ক ম্যাজজেনটির সর্বশেষ বইয়ের নাম- 'দি ওয়ে অব নাইফ: দ্যা সিআইএ, এ সিক্রেট আর্মি, অ্যান্ড আ ওয়ার অ্যাট দা এন্ডস অব দি আর্থ।'
বিদেশে আমেরিকান দূতাবাসের পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা তাদের মক্কেল রাষ্ট্রের কাছে অস্ত্র বিক্রির মওকা খুঁজে বেড়ান। মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলোর জন্য বিক্রেতার ভূমিকায় নামেন তারা। ২০১০ সালে উইকিলিকস মার্কিন হাজার হাজার কূটনৈতিক তারবার্তা ফাঁস করে দেয়। এতে দেখা যায়, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা মিত্র দেশের (এক্ষেত্রে মক্কেল পড়লেও দোষের কিছু হবে না) রাজধানীতে তাদের সমকক্ষদের সাথে মোলাকাত করেন। এসব সাক্ষাৎ শেষ হয় প্রায়ই অস্ত্র ক্রয় চুক্তির ঘোষণা দিয়ে। অন্যদিকে মার্কিন অস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান লকহিড মার্টিন বা রেথিয়নের লাভের ঘরে জমতে থাকে আরো মধু ।
পরমাণু বোমার আবির্ভাবের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের যতো পরিবর্তন ঘটেছে তার চেয়েও গভীর পরিবর্তন ঘটেছে সাইবারঅস্ত্রের আবির্ভাবের পর। বরং সাইবার অস্ত্রের অস্থিতিশীল করার সক্ষমতা পরমাণু অস্ত্রের চেয়ে বেশি। সাইবার অস্ত্র তুলনামূলক ভাবে সস্তা, সহজে বিতরণ করা হয়। ব্যবহার প্রণালীও সহজ। এতে হামলাকারীকে পরিণতির বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সাধারণত দরকারই পড়ে না। সাইবারঅস্ত্র বিস্তার মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের প্রকৃতি আগা-গোড়াই বদলে যাচ্ছে। এ সত্য অনেক আগেই রপ্ত করে ইসরায়েল। বাদ বাকি বিশ্বও হালে সে বিদ্যার গুরুত্ব বুঝতে শুরু করেছে।
অস্ত্র-বাণিজ্যকে সব সময়ই ইসরায়েলের টিকে থাকার অনুভূতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচনা করছে তেল আবিব। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান হয়ে ওঠে এ বাণিজ্য। পরবর্তীতে আরো সামরিক গবেষণা ও উন্নয়নের তহবিলের উৎস হয়ে দেখা দেয় এটি। পাশাপাশি বিপদ ভরা দুনিয়ায় নতুন জোট গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ বাণিজ্য। নবগঠিত হীনবল ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন ইসরায়েলকে ঘিরে থাকা শত্রু আরব রাষ্ট্রগুলোর বলয়ের বাইরে থাকা দেশ এবং সংস্থাগুলোর সাথে গোপন সংযোগ স্থাপন করেন। ১৯৫০'এর দশকে এ দিকে পা বাড়ান তিনি। এ পদ্ধতিকে তিনি "পেরিফেরি ডকট্রিন" বা "চৌহদ্দি মতবাদ" হিসেবে আখ্যা দেন। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকা জুড়ে দেশগুলির অভ্যন্তরে গোপন যোগাযোগের জাল বিছাতে শুরু করে তার বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। এর মধ্যে অনেকগুলোই প্রকাশ্যে আরবদের পক্ষে নিয়ে তৎপরতাও চালায়। উন্নত অস্ত্রের যোগান দেওয়াই ছিল সেই সংযোগগুলো তৈরির অন্যতম চাবিকাঠি।
১৯৮০'এর দশকের মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে নিজেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ অস্ত্র রফতানিকারক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে ইসরায়েল। আনুমানিক প্রতি ১০ কর্মীর মধ্যে একজন যে ভাবেই হোক ইসরায়েলের অস্ত্র নির্মাণের সাথে জড়িত কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। এতে ইসরায়েলের পক্ষে কিছু কিছু বিদেশী নেতার আশীর্বাদ জোটানোর পথ খুলে যায়। এ সব নেতা নিজস্ব ক্ষমতা রক্ষার জন্য সামরিক সহায়তাকে অপরিহার্য হিসেবে গণ্য করেন। বিনিময়ে, সেই দেশগুলো প্রায়শই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দেয়। আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য তারা মোসাদ এবং ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীকে তাদের দেশগুলোকে ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়।
সামরিক পরিকল্পকদের কাছে জঙ্গি বিমান তৈরির পরিকল্পনার চেয়ে গুরুত্বের হয়ে উঠল সাইবারঅস্ত্র। ইসরায়েলে ভিন্নতর অস্ত্র শিল্পখাতের আবির্ভাব ঘটল। মার্কিন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি বা এনএসএ'র অনুরূপ ইসরায়েলই প্রতিষ্ঠান হলো ভেটেরানস অব ৮২০০। ইসরায়েলই এ সংস্থা বেসরকারি খাতে গোপন বিনিয়োগ শুরু করল। এ ভাবেই জন্ম নিলো ইসরায়েলের শত শতকোটি ডলারের সাইবার নিরাপত্তা শিল্প।
ইসরায়েলের প্রচলিত অস্ত্র বিক্রয়কারীদের বিক্রয় নীতিই বহাল রইল সাইবারঅস্ত্রের ক্ষেত্রে। প্রচলিত নীতি অনুযায়ী বিদেশে অস্ত্র রফতানির আগে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে রফতানির লাইসেন্স নিতে হয়। এতে বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ওপর তেল আবিব সরকারের প্রভাব বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ অবকাশ বজায় থাকে। কোনো কোনো সময় যে সব দেশ সাইবারঅস্ত্র কিনতে চায় তাদেরও প্রভাবিত করতে পারে ইসরায়েল।
অস্ত্র বা সাইবারঅস্ত্রের বেসাতিতে জড়িত কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এনএসও'র মতো ব্যাপক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। পারেনি ইসরায়েলের কাছে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে উঠতে। তেল আবিবের উপকণ্ঠে বানি জিওন নামের কৃষি সমবায় সংস্থা রয়েছে। ইসরায়েলে মোরগ চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছিল বানি জিওন। এনএসও'র সূচনাও হয় এখান থেকেই। ২০০০ দশকের মাঝামাঝি ভবন মালিক বুঝতে পারেন মোরগ ব্যবসায় যা লাভ হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি লাভের মুখ দেখা যাবে যদি কম্পিউটার প্রোগ্রামে জড়িতদের কাছে এটি ভাড়া দেওয়া যায়। ভবন এবং ভবন চত্বরের হালকা-পাতলা পরিবর্তন ঘটালেন তিনি। তারপরও প্রযুক্তি কোম্পানি তৈরিতে উৎসাহী প্রতিষ্ঠানের দফতর হিসেবে সস্তায় ভাড়া দিলেন।
এ ভাবে সস্তায় যারা ভাড়া নিতে আসলেন তাদের মধ্যে ছিলেন শালেভ হুলিও। অন্যদের সাথে তার বেশ পার্থক্য ছিল। তার সাথে সহজেই আড্ডা দেওয়া বা সময় কাটানো যেত। প্রথম প্রথম তাকে তুলনামূলক সহজ-সরল বলেই মনে হয়েছে। তার সঙ্গী ছিল ওমরি লাভি। হুলিও'র স্কুল জীবনের বন্ধু। দুজনেই বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্ব পালন করেছে। তবে গোয়েন্দা বা প্রযুক্তি বিষয়ক সামরিক দায়িত্ব পালন করেনি তারা। বরং যুদ্ধ বিষয়ক কাজই তাদের করতে হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে লাভি এবং হুলিও সহজেই যোগাযোগ করা যায় এমন পণ্য বানানোর চেষ্টা করছে। প্রথম দিকে ভিডিও বিপণন পণ্য তারা তৈরি করে। শুরুতে এ পণ্য ভালো ব্যবসাও করে। ২০০৮'এর বিশ্ব মন্দার ধকলে তাদের এ পণ্য-ব্যবসা পুরোই ধসে যায়। এরপর তারা কমুনিটেক নামে আরেকটি কোম্পানি শুরু করে। সেলফোনের প্রযুক্তি সহায়তায় নিযুক্ত কর্মীদের এবারে তারা একটি নতুন পণ্যের প্রস্তাব দেয়। এ পণ্য খাটিয়ে খদ্দেরের ফোন দূর থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সহায়ক কর্মীরা। তবে দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অবশ্যই সেলফোনের মালিকের অনুমতির প্রয়োজন পড়বে।
তাদের এ পণ্য পালে তেমন বাতাস পেলো না। দুই বন্ধু এবারে ভিন্ন জাতের খদ্দেরের তালাশে নামলেন। এক সাক্ষাৎকারে এ নিয়ে হুলিও বলেন, "ইউরোপের একটি গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের তৈরি পণ্য সম্পর্কে জানতে পারে এবং যোগাযোগ করে আমার সাথে।" তারপর দ্রুতই বের হয়ে আসে যে ক্রেতা-সেবার বদলে অনেক বড় সমস্যার সুরাহা করতে পারবে এ পণ্য।
আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিয়মিতই আড়ি পাততে এবং চলমান যোগাযোগগুলো ধরতে পারে। কিন্তু বার্তাকে সংকেতবদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত প্রোগ্রাম ব্যাপক ভাবে পাওয়া যাওয়ার সাথে সাথেই ঘটনা পাল্টে যায়। আইন প্রয়োগকারী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সুদিনের শেষ হয়। তারা পড়ে মহা ফাঁপরে। আড়ি পাততে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু আড়ি পেতে যে বার্তা ধরতে পারছে তার কোনো অর্থই বের করতে পারছে না। সংকেতবদ্ধ করার আগেই যদি বার্তাকে ধরা যেত তা হলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এ জন্য যে যন্ত্র দিয়ে এ বার্তা সংকেতবদ্ধ করা হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা সেটি সেলফোন বা অন্য কিছুই যাই হোক না কেনো। এ ধরণের যন্ত্রকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সে কাজটি এর আগেই করেছে কমুনিটেক। এবারে অনুমতির তোয়াক্কা না করেই এ কাজটি করতে হবে। সবাই তাই চাইছিল।
আর এ ভাবেই জন্ম নিলে এনএসও। নিজেদের পণ্যের বিস্তার ঘটানোর জন্য যে যোগাযোগ থাকা দরকার তা হুলিও বা লেভি কারোই ছিল না। এবারে তারা তৃতীয় আরেক অংশীদার নিভ কারমিকে নিলেন। নিভ ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ এবং মোসাদে উভয়ই জায়গায়ই কাজ করেছে। এবারে তিনজনের নামের আদ্যক্ষর, নিভের 'এন', শালেভ'এর 'এস' এবং ওমরির 'ও' বেছে, নিয়ে নতুন কোম্পানির নাম রাখল এনএসও। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার এনএসএ'র সাথে এ কোম্পানির নামের উচ্চারণগত মিল সৃষ্টি হলো কাকতালীয় ভাবেই। এতে বেশ খুশি হলো তিন অংশীদারই। এবারে এনএসও'র জন্য নিয়োগ পর্ব শুরু করলো। এ নিয়োগ পর্ব ছিল তাদের ব্যবসায়িক পরিকল্পনার অপরিহার্য অঙ্গ। অবশেষে তেল আবিবের উপকণ্ঠে অবস্থিত হারজলিয়াতে এনএসও'র বিস্তীর্ণ সদর দফতরসহ দুনিয়াজোড়া তাদের দফতরগুলোতে সাতশ'র বেশি লোকবল নিয়োগ দেওয়া হলো। অ্যাপল এবং অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের জন্য পৃথক ল্যাবগুলোর তাক বোঝাই হয়ে গেলো নতুন নতুন স্মার্টফোনের মডেল দিয়ে। এনএসও'র হ্যাকাররা অব্যাহত ভাবে এগুলো খতিয়ে দেখে নতুন নতুন দুর্বলতা খুঁজে বের করার কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। এই দুর্বলতাই লখিন্দরের বাসর ঘরের ছিদ্রপথ হিসেবে কাজ করবে।
এনএসও'র গবেষণা দলের প্রায় সব সদস্যই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সাবেক কর্মী। এদের বেশির ভাগই ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতর এএমএএন'এর সদস্য। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো এই সামরিক গোয়েন্দা অধিদফতর। এ ছাড়া অনেকেই এএমএএন'এর ইউনিট ৮২০০'র সদস্য। এনএসও'র সবচেয়ে মূল্যবান হিসেবে বিবেচিত সব কর্মীই গোয়েন্দা বিষয়ক অভিজাত প্রশিক্ষণ পাঠ্যধারা বা কোর্স উৎরে এসেছেন। এদের মধ্যে গোপন এবং মর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত গোয়েন্দা ইউনিট ৮২০০'এর এআরএএম বা আর্ম কর্মসূচিতে জড়িতদের কেউ কেউও ছিলো। সাধারণ ভাবে বলা হয়, সবচেয়ে মেধাবী এবং যোগ্যদের মধ্যে হতে হাতে গোণা কেবল অল্প কয়েকজনকেই বেছে নিয়ে 'আর্ম'এর অতি উন্নত সাইবারঅস্ত্র কর্মসূচি সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশ্বে এ ধরণের প্রশিক্ষণ পাওয়া মানুষের সংখ্যা খুবই কম পাওয়া যাবে। এনএসও ছাড়া আর কোথাও এ ধরণের ব্যাপক সংখ্যক ব্যক্তিকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। হারজলিয়াতে হাতে গোণা এমন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নয় বরং এ ধরণের কয়েকশ ব্যক্তির দেখা মিলবে। এতে এনএসও'র ভেতরে তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ টান টান উত্তেজনাকর এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ সব প্রকৌশলী দৈনিক 'শূন্যদিনগুলো' খুঁজে পাওয়ার অবিরাম চেষ্টা চালায়। 'শূন্যদিনের' মানে হলো ফোনের দুর্বল স্থান খুঁজে বের করা যার মধ্য দিয়ে 'পেগাসাস' ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাগুলো সেখানে একটি মাত্র 'শূন্যদিন' খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় প্রাণপাত করে সেখানে এনএসও লক্ষ্য একাধিক 'শূন্যদিন।' এই খাটুনির সুবিধাটা হলো এই যে কোনো ভাবে যদি ওই ফোনের নির্মাতারা 'শূন্যদিন' ফাঁস হয়ে গেছে বলে জানতে পারে তবে তা তড়িঘড়ি বন্ধ করে দেয়। ফলে বিপাকে পরে তাদের সাইবার অস্ত্র। কিন্তু একটা 'শূন্যদিন' বন্ধ করলে আরেকটা দিয়ে দ্রুত নিজের তৎপরতা অব্যাহত রাখতে পারে এনএসও।
এনএসও প্রকৌশলীরা 'পেগাসাসে'র প্রথম কোডিং শেষ করেন ২০১১ সালে। শক্তিশালী এই সাইবারঅস্ত্র দিয়ে পশ্চিমের ভালো ভালো খদ্দের ধরতে পারবে বলে আশা করেছিল এনএসও। তবে শুরুতেই অনেক দেশ বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো ভিন দেশী গোয়েন্দা পণ্য কেনা নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়ে। বিশেষ করে ইসরায়েলের শীর্ষস্থানীয় সাবেক গোয়েন্দা কর্তাদের দিয়ে পরিচালিত ইসরায়েলই পণ্য নিয়ে উদ্বেগের শেষ ছিল না। নামী-দামি খদ্দেরদের অনেকেই আশঙ্কা করেন, হয়ত গোয়েন্দা সফটওয়্যার পেগাসাসের ভেতরে আরেক গোয়েন্দা সফটওয়্যার চুপিসারে বসানো আছে। তা দিয়ে মোসাদ হয়ত তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার মধ্যে সেদিয়ে যাবে।
সুনাম ও খ্যাতির দরকার আছে বুঝতে পারে এনএসও। একদিকে বিক্রি বাড়ানো অপরদিকে উচ্চ প্রশিক্ষিত কোডারদের ধরে রাখার জন্য এর বিকল্প কিছুই হতে পারে না। এই সব কোডারের অসীম পরিশ্রমের ফসলই হলো সাইবারঅস্ত্র 'পেগাসাস।' এবারে এনএসও'র চেয়ারম্যান হিসেবে মেজর জেনারেল অ্যাভিগাডোর বেন-গালকে নিয়োগ দিলো হুলিও। হলোকাস্ট নামে পরিচিত হিটলারের ইহুদি নিধন যঞ্জ থেকে বেঁচে যাওয়া এবং রণ-কর্মকর্তা হিসেবে ইসরায়েলে ব্যাপক শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করেছেন তিনি। এনএসও'র চারটি প্রধান স্তম্ভ নির্ধারণ করেন তিনি। এগুলো হলো, এনএসও নিজে কখনোই 'পেগাসাস' চালাবে না। এনএসও পণ্য কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানি নয় বরং শুধুমাত্র সরকারের কাছে বিক্রি করা হবে। কোন সরকারের কাছে বিক্রি করা হবে তা দেখে-শুনে নির্ধারণ করা হবে। প্রতিটি বিক্রির লাইসেন্স নেওয়ার বেলায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা রফতানি নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বা ডিইসিএ'কে সহযোগিতা করা হবে।
এই সব সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে কাজের বেলায় ইসরায়েল পররাষ্ট্র নীতির মিত্র হয়ে ওঠে এনএসও। এনএসও'র বিস্তারের জন্য তদারকির গুরুত্ব বুঝতে পারেন বেন-গাল। এই তদারকির কারণেই পেগাসাস কোন কোন দেশের কাছে বিক্রি করতে পারবে না সে বাধ্য-বাধকতা এনএসও'র ওপর বর্তাবে। পাশাপাশি খদ্দের দেশের পেগাসাস ব্যবহার নিয়ে জনমনে বিরাগ তৈরি হলে তা থেকে রক্ষা পাবে এনএসও। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানাল, স্বেচ্ছায় তদারকি মেনে নিতে এনএসও রাজি আছে। বেন-গালের এ কথায় ইসরাইল কর্তৃপক্ষ সত্যিই খুশি হলো। সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেনজামিন নেতানিয়াহু। তার সাবেক এক সামরিক সহযোগী এই তদারকির সুবিধার দিক পরিষ্কার ভাষায় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই সাইবারঅস্ত্র কাদের হাতে যাবে তা নিয়ন্ত্রণ করবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে ইসরায়েল তার সুবিধা আদায় করে নেবে এবং কূটনৈতিক অঙ্গনেও মোটা ধরণের লাভ করবে।
এনএসও'র ভাগ্য দ্রুত খুলতে শুরু করল। মেক্সিকোতে মাদক সম্রাটদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের যুদ্ধ চলছিল। মাদক ব্যবসায়ীরা সংকেতবদ্ধ ব্ল্যাকবেরি ফোনে যোগাযোগ করতে পছন্দ করে। এই ফোনকে হ্যাক করার পথ খুঁজছিল মেক্সিকো সরকার। এটি হ্যাক করার পথ খুঁজে পেয়েছে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা এনএসএ। তবে মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাটি খুবই সীমিত পরিসরে তা ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে সম্মত হয়। এ পরিস্থিতিতে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ফেলিপ ক্যালডেরনের সাথে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন হুলিও এবং বেন-গাল। তারা আক্রমণাত্মক বিক্রয় প্রস্তাব দেয়। এনএসএ যা করতে পারে পেগাসাসও তা পারে তবে এটি করবে মেক্সিকান কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুরোপুরি মেনে। পেগাসাস পুরোই মেক্সিকান কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে জানান তারা। ক্যালডেরন নড়েচড়ে বসলেন। পেগাসাস কিনতে আগ্রহী হলেন।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এনএসওকে জানায় যে মেক্সিকোর কাছে পেগাসাস বিক্রিতে কোনও সমস্যা নেই। বিক্রির চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গেল।
মেক্সিকোর তদন্তকারীরা সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি, বা সিআইএসইএন-এর এক দফতর থেকে কাজ নামেন। মেক্সিকোর এ সংস্থার নাম বদল হয়েছে এবং এখন একে জাতীয় তদন্ত কেন্দ্র বলা হয়। পেগাসাস যন্ত্রপাতিগুলোর সাথে মাদক সম্রাট জোয়াকুইন গুজমানের সিনালোয়া কার্টেলের এক ব্যক্তির মোবাইল ফোন নম্বরের সংযোগ ঘটানো হলো। ব্ল্যাকবেরিকে হ্যাক করা কাজ এমন নির্বিবাদেই সারা গেল। ওই ফোনে থাকা বার্তাগুলো দেখতে পায় তদন্ত কর্মকর্তারা। সেইসাথে অন্যান্য ব্ল্যাকবেরি ফোনগুলোর অবস্থানও দেখতে পায়। সিআইএসইনের এই সাবেক নেতা বলেন, "হঠাৎ করে আমরা যেন নতুন ভাবে দেখতে এবং শুনতে শুরু করলাম। এ যেন এক ভেলকি বাজি!" তার কথায়, নতুন সাইবারঅস্ত্র তাদের মাদক বিরোধী পুরো অভিযানকে যেন নতুন জীবন দান করল। তিনি আরো বলেন, "সবাই হঠাৎ করেই প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম যে আমরা জিততে পারব।" মেক্সিকোর মাদক বিরোধী অভিযানের জন্য কেবল নয় এটি ইসরায়েলের জন্যও এক বিজয় ডেকে আনে। মেক্সিকো ল্যাটিন আমেরিকার একটি প্রভাবশালী দেশ। এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের শত্রু দেশগুলোর সমর্থিত ইসরায়েল-বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে এক ধরণের
কূটনৈতিক পরিখা যুদ্ধ চালিয়েছে। এনএসও নিয়ে মেক্সিকোর সাথে চুক্তির মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের প্রতি দেশটির বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন এসেছে এমন কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। কিন্তু এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে তার প্রমাণ রয়েছে। জাতিসংঘের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া মেক্সিকোর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। মেক্সিকো ধীরে ধীরে "না" ভোটের বদলে ভোট দানে বিরত থাকতে শুরু করে। তারপরে, ২০১২ সালে ক্যালডেরনের স্থলাভিষিক্ত হলেন এনরিক পেনা নিয়েতো। ২০১৬ সালে তিনি ইসরায়েলে যান। ২০০০ সাল থেকে কোনো মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট যেখানে আনুষ্ঠানিক সফরে যাননি। নেতানিয়াহু পরের বছর মেক্সিকো সিটিতে যান। কোনো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর এটাই ছিল দেশটিতে প্রথম সফর। এর কিছু পরেই মেক্সিকো ঘোষণা করে, জাতিসংঘ বেশ কয়েকটি প্যালেস্টাইনপন্থী প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবে।
এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর মুখপাত্র বলেন যে অন্যান্য দেশ পেগাসাস কিনতে চাইলে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কখনই তা থেকে কোনো সুবিধা আদায় করতে চাননি। "প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বিদেশী নেতাদের সাথে কথা বলেছেন এবং রাজনৈতিক বা অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে তাদের এই ধরনের ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছেন এমন দাবি পুরোই মিথ্যা। ইসরায়েলি আইন অনুযায়ী, পেগাসাস বা ইসরায়েলি কোম্পানিগুলির অনুরূপ পণ্যসমূহের বিক্রির জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রবলয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তদারকিতে বিক্রি হয়েছে।"
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস