বৈষম্য 'বিরোধী' আইন কতটা বৈষম্য দূর করবে?
জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষ স্বাধীন এবং পূর্ণ মানবাধিকার ও সমমর্যাদার অধিকারী। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে সমতা, সমান সুযোগ এবং বৈষম্যহীনতার বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে বিবৃত রয়েছে। সাংবিধানিক বিধানাবলী এবং সকল প্রকার জাতিগত বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে এটি সুষ্পষ্ট যে নাগরিকদের অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে কোন ধরণের বৈষম্য গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন।
২০২১ সালের ক্রিশ্চিয়ান এইডের পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায় যে, এখনও মানুষ মনে করে, ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোন চাকরির জন্যই উপযুক্ত নন। এই সকল জনগোষ্ঠীর সাথে একই ভবনে/বাসায় মানুষ থাকতে রাজি নন। এ সকল জনগোষ্ঠীর সাথে একই রেস্তোরাঁয় খাবার খেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না প্রায় ৯০% উত্তরদাতা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষা কোটা সমর্থন করলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাশাপশি বসার ক্ষেত্রে ৪৭% উত্তরদাতা বলেছেন যে, তারা কোনোভাবেই ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়াদের পাশে বসতে রাজি নন। সাধারণ মানুষ এসকল জনগোষ্ঠীকে করুণা বা দয়ার দৃষ্টিতে দেখেন কিন্তু সম অধিকারের প্রশ্নে নিশ্চুপ।
একটি অগ্রগতি হলো, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের গত অধিবেশনে বৈষম্য বিরোধী বিল- ২০২২ উত্থাপিত হয়েছে যা বর্তমানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটিতে পর্যালোচনা পর্যায়ে রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী অধিবেশনে আইনটি পাশ হবে যা হবে আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার পূরণের ক্ষেত্রে একটি অনন্য উদাহরণ এবং বর্তমান সরকারের অন্যতম মাইলফলক। ২০১৪ সালে, আইন কমিশন, বৈষম্য বিলোপ আইনের প্রথম খসড়া তৈরী করে। পরবর্তীতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০১৮ সালে বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের সাথে আলোচনা ও পর্যালোচনা করে এই আইনটির পরিমার্জন করে। সকল 'বাদ পড়ে যাওয়া' জনগোষ্ঠীর সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা রেখে একটি অভিন্ন খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়, যার দ্বারা বৈষম্যের শিকার সকল নাগরিকের জন্য এই আইনের মাধ্যমে প্রতিকার প্রাপ্তির সুযোগ রাখা হয়। কিন্ত বর্তমান প্রস্তাবিত আইনটির কিছু বিষয় ফিরে দেখার দাবি রাখে, এভাবে আইনটি পাশ হয়ে গেলে এর মূল উদ্দেশ্য পূরণ কতটা সম্ভব হবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।
আইনে বৈষম্যের ধারণা
বর্তমান আইনটিতে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, ভাষা, বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক, মানসিক বা তৃতীয় লিঙ্গ, জন্মস্থান, জন্ম, পেশা এবং অস্পৃশ্যতার অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেকৃত ১২টি ক্ষেত্রে ১৫ ধরণের কাজ বা আচরণকে বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বৈষম্যের মূল জায়গা হলো বিশ্বাস, প্রথাগত ধ্যান-ধারণা, আইনটিতে বৈষম্যের ক্ষেত্রসমূহকে আরও সতর্কতার সাথে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিশেষত, জাত-পাত বিচার, যৌন প্রবৃত্তি/আচরণ, বৈবাহিক অবস্থা- বিশেষ করে বিশেষ বিবাহ আইনে হওয়া বিয়ে, ভূমি অধিকারের অস্বীকৃতি, যৌনকর্মীর সৎকার বা দাফন, বা তার সন্তানের পরিচয় প্রসূত বঞ্চনা ও বৈষম্য - এসব দিকগুলোতে আলোকপাত করা প্রয়োজন রয়েছে।
বৈষম্য কোনো অপরাধ নয়
বৈষম্যমূলক কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করা হয়নি এবং সুস্পষ্টভাবে কোন শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। অথচ আইনটিকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে হলে বৈষম্যমূলক কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করতে হবে। নতুন একটি ধারা যুক্ত করা প্রয়োজন যা প্রস্তাবিত খসড়ায় বিস্তারিতভাবে ছিল। বৈষম্যের ক্ষেত্র অনুসারে বিভিন্ন মাত্রার শাস্তির বিধান থাকা আবশ্যক।
আরো একটি কমিটি
প্রস্তাবিত আইনে আইন মন্ত্রী মহোদয়ের নেতৃত্বে একটি ২৮ সদস্যের জাতীয় মনিটরিং কমিটি করার কথা বলা আছে, যেখানে ১৭ জন সচিব বা তাদের প্রতিনিধি (যুগ্ম-সচিব) থাকবেন। এছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে- বিভাগীয়, জেলা কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা পর্যায়ের যেসকল কমিটি রয়েছে সেগুলোই অকার্যকর- যেমন-বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটি, পাচার প্রতিরোধ কমিটি, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি। আইনটিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বিধায় স্বয়ং আইনমন্ত্রী হবেন কমিটির প্রধান ও অন্যান্য সচিবগণ হবেন জাতীয় কমিটির সদস্য। কিন্তু এটি কতটা বাস্তবসম্মত? এরূপ অনেক কমিটি বিদ্যমান রয়েছে যেমন পাচার প্রতিরোধ আইন ২০১২ জাতীয় সংস্থা, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন ২০১৭তে জাতীয় কমিটি। কিন্তু জাতীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ কতটা সময় দিতে পারেন? কমিটির সভা হয়? কমিটিকে জেলা ও বিভাগীয় কমিটিকে তদারকির ভার দেয়া হয়েছে, সেটাও কতটা বাস্তবসম্মত হবে তা ভেবে দেখার দাবি রইল।
সেল গঠন
লেজিসলেটিভ উইংয়ের অধীনে বৈষম্য-বিরোধী সেল গঠন একটি নতুন ধারণা যা এর প্রচলিত কার্যপদ্ধতির আওতাভুক্ত নয়। এ ধরনের সেল এর উদাহরণ হলো মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেল। এই সেলের অস্তিত্ব ও কার্যপরিধি উক্ত মন্ত্রণালয়ের সবাই জানেন কিনা সে বিষয়েই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। ফলে এ ধরনের সেল গঠিত হলে তা কার্যকর করার দক্ষতা ও সময় আমাদের আছে কি?
অভিযোগ দায়ের ও প্রতিকার
আইনটিতে শুধু অভিযোগের কথা বলা আছে, কিন্তু প্রতিকার কি দেয়া হবে তার কোনো দিক নির্দেশনা নেই। যেমন - কোন ক্ষেত্রে কি ক্ষতিপূরণ, কি নিষেধাজ্ঞা বা ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি প্রতিকার বিধান থাকতে পারতো। বৈষম্য মানুষের শুধু আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতিই বয়ে আনে না, এর মানসিক ক্ষতির ক্ষতিপূরণের দিকটি বিবেচনার বিষয়েও সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
মানবাধিকার কমিশন অনুপস্থিত
মানবাধিকার কমিশনকে সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করা হয়েছে আইনটিতে। একটি প্রতিষ্ঠিত কমিশন থাকার পরেও আইন মন্ত্রণালয় নিজে আইনটির বেশিরভাগ দায়িত্ব নিয়েছে- যেমন সেল গঠন, জাতীয় কমিটির নেতৃত্ব ইত্যাদি। এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। প্রস্তাবিত বিলে ছিল যে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বৈষম্যমূলক মামলার তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে কাজ করবে যা হতে পারতো নিরপেক্ষ। কারণ বৈষম্যের অভিযোগ কিন্তু রাষ্ট্রের অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও আসতে পারে, তখন এই নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী কমিটি কতটা নিরপেক্ষ থাকবেন। বর্তমান বিলটিতে বলা হচ্ছে মনিটরিং কমিটি, জেলা কমিটি, বিভাগীয় কমিটি বা জাতীয় কমিটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সহায়তার জন্য অনুরোধ করতে পারবে এবং তদানুসারে উক্ত সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি সহায়তা প্রদান করবে। এখানে সেসকল সংস্থা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে তাদের এই বিষয়ে কি দক্ষতা বা ধারণার প্রয়োজন রয়েছে, অন্যথায় এই তদন্ত নতুন কিছু আনবে না। এখানে সরাসরি মানবাধিকার কমিশন উল্লেখ থাকতে পারতো।
আরেকটি বিষয় হলো প্রস্তাবিত বিলে 'হিজড়া' ও 'ট্রান্সজেন্ডার' জনগোষ্ঠীকে 'তৃতীয় লিঙ্গ' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি প্রগতিশীল আইন হিসেবে যদি আমরা এটিকে দেখি, তাহলে লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষদের ক্ষেত্রে 'তৃতীয় লিঙ্গ' শব্দটি ব্যবহার না করে ট্রান্সজেন্ডার ব্যবহার করা হলে অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে পারে আইনটি।
পরিশেষে আইনটির নাম থেকে 'বিরোধ' শব্দটির বদলে 'বিলোপ' শব্দটি অনেক বেশি অর্থ বহন করে।