ট্রেনের নতুন বগির নাম রাখা হোক ‘আত্মীয়স্বজন বগি’
রেলওয়ে আর ট্রেনের ব্যাপারটা শুরু থেকেই গোলমেলে। বিশ্বাস হচ্ছে না? ভারতে প্রথম রেল যোগাযোগ শুরু হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে, ১৮৫৩ সালে। পরের বছর শুরু হয় বাংলায় এবং বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত রেল চালু হয়। এরপর সারা ভারতজুড়ে রেল যোগাযোগ শুরু হলেও সমস্যা দেখা দেয় টয়লেট নিয়ে। তখন রেলে টয়লেটের ব্যবস্থা ছিল না, স্টেশনে নেমেই এসব সারতে হতো। ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ। যারা এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত না তারা ট্রেনেই সবকিছু করে দিত! টয়লেটবিহীন অবস্থায় রেলগুলো হয়ে যেত লাইভ টয়লেট এবং এভাবে ৫৫ বছর চলেছে ভারতের ট্রেন। ভারতে টয়লেট সংবলিত রেলগাড়ি প্রথম চালু হয় ১৯০৯ সালে।
ট্রেনের টয়লেটের প্রসঙ্গ নিজের ট্রেনে চড়ার ও টয়লেটের একটা অভিজ্ঞতা এখানে বলা যায়। একবার ট্রেনের টয়লেটে ঢুকে দেখলাম বাতি নেই। ভাগ্যিস, সেটা দিনের বেলা ছিল। কাজ সেরে দেখলাম ট্রেনের গায়ে লেখা—'ইহা জাতীয় সম্পদ। নিজের সম্পত্তির মতো রক্ষণাবেক্ষণ করুন।' আরও খেয়াল করে দেখলাম টয়লেটের আয়নাও নেই। সেখানে চক দিয়ে একজন লিখে গেছে—'নিজের সম্পদের মতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে আয়নাখানি লইয়া গেলাম!' টয়লেটের এরকম বহু কাহিনি পাবেন রেলের যাত্রীদের কাছে।
ট্রেনের টিকেট নিয়েও অনেক গালপপ্পো প্রচলিত আছে। ইদানীংকার ঘটনায় যাবার আগে গানের প্রসঙ্গে যাই। মার্কিন মুলুকের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের একটি হচ্ছে—ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস। গানের শুরুটা এমন—'ইফ ইউ মিস দ্য ট্রেন আই মর্ন/ইউ উইল নো দ্যাট আই অ্যাম গন/ইউ ক্যান হেয়ার দ্য হুইসেল অব লাভ আ হান্ড্রেড মাইলস—গড আই অ্যাম ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস অ্যাওয়ে ফ্রম হোম।'
বাংলাদেশের জনপ্রিয় গায়ক তপন চৌধুরীর গান আছে এমন—'ট্রেন চলে গেছে স্টেশনটা ফাঁকা!' ব্যান্ড গায়ক জেমসের জনপ্রিয় একটা গান হচ্ছে—'ছুটছে রাতের ট্রেন—'। আছে তুমুল জনপ্রিয় সেই গান—'দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা বন্ধু চিরকাল/ রেললাইন বহে সমান্তরাল!' আর মার্কিন মুলুকের জনপ্রিয় লোকগান 'ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস'-এর মতো এদেশের লোকগানেও ট্রেনের সরব উপস্থিতি আছে। যেমন—'স্টেশনের রেলগাড়িটা মাইপা চলে ঘড়ির কাঁটা, স্টেশনে বইসা ভাবি কখন বাজবে বারটা!' অথবা 'ঝিক্কির ঝিক্কির ময়মনসিং/আইতে যাইতে কতোদিন'! জামালপুর এলাকার (তামা ও কাঁসা বাজিয়ে এই গান গাওয়ার রেওয়াজ ছিল) বিয়ের গানেও আছে রেলের উপস্থিতি। 'ঐ বুলে দেহা যায় রেলের গাড়ি আইতাছে/রেলের গাড়ি চইড়া জামাইবাবু আইতাছে/খাওগো জামাই বাটার পান/সুন্দরীরে করো দান/কুউউউউ—কুউউউউ ঝিকঝিক, কুউউউউ ঝিকঝিক—'
ছবির নামেও আছে ট্রেন। যেমন—'দ্য ট্রেন'। বাংলা ছবির নাম আছে—'জনতা এক্সপ্রেস'। আছে কবিতাও। যেমন টোকন ঠাকুরের প্রথম বইয়ের নাম 'অন্তরনগর ট্রেন ও অন্যান্য শব্দ'। যারা কবি টোকন ঠাকুরের প্রশংসা করতে যেতেন তাদের বেশিরভাগ নাকি বলতেন—আপনার লেখা 'আন্তঃনগর ট্রেন' পড়লাম! ভাগ্যিস, টিকিট সংকটের সময়ে কেউ তার কাছে আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট চেয়ে বসেননি কিংবা বিনা টিকেটে চড়তে যাননি। এ বছর কোনো একটা টেলিভিশনে একটা নাটক প্রচারিত হয়েছে যার নাম 'আন্তঃনগর প্রেম'!
বিনা টিকেটে যাত্রা করা নিয়ে ঘটে যাওয়া তুলকালাম কাণ্ডে আসার আগে তারাপদ রায়ের একটা বিখ্যাত গল্প এখানে উল্লেখ করতে চাই।
ট্রেন কতটা দেরি করবে ছাড়তে, সেই চিন্তা নিয়ে ট্রেনে চড়েছিলেন রম্যনাথ বাবু। তিনি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন নির্দিষ্ট সময়ের পনেরো মিনিট আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে! রম্যনাথ বাবু যারপরনাই অবাক। কিন্তু তিনি আরো বেশি অবাক হয়ে খেয়াল করলেন কয়েক মিটার যাবার পরে ট্রেনটা আবার পেছনের দিকে এসে স্টেশনেই থামল। রম্যনাথ বাবু কিছু ভাবার বা বুঝে ওঠার আগেই ট্রেন আবারো ছাড়ল এবং কিছুদূর যাবার পরে আবারও ফিরে এল। এভাবে সাত সাতবার। রম্যনাথ বাবুর মাথায় খুন চেপে গেল। তিনি খেয়াল করলেন রেলের গার্ড, টিকেট চেকার, স্টেশন মাস্টার সবাই দাঁড়িয়ে এই আসা-যাওয়ার মজা দেখছে। রম্যনাথ বাবু স্টেশন মাস্টারকে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন—'কী মশাই ছেলে খেলা হচ্ছে বুঝি?' স্টেশনমাস্টার গম্ভীর হয়ে বললেন, 'মোটেই ছেলেখেলা না। আমাদের ড্রাইভার বাবু তার ছেলেকে ট্রেন চালানো শেখাচ্ছেন!' এরপর সত্যি সত্যি একসময় ট্রেন ছাড়ল। শুধু রম্যনাথ বাবু বুঝতে পারলেন না ট্রেন কে চালাচ্ছে! ড্রাইভার না তার ছেলে?
আসলে বাংলাদেশের ট্রেন কখন কে চালায়? গত চৌদ্দ বছর কেমন ছিল ট্রেন? একটি দৈনিকের শিরোনাম—'ঢাকায় পাতাল রেল: প্রকল্প নিয়ে স্বপ্নেই খরচ ৩২১ কোটি টাকা!' আরও একটি জনপ্রিয় দৈনিকের শিরোনাম—'রেলে সব আছে শৃঙ্খলা নেই'। আছে ট্রেনে ঢিলমারা বাহিনী। আছে ট্রেন উল্টে যাবার ঘটনা। আছে ট্রেনের কেনাকাটায় শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ব্যাপার। আছে টেনের জায়গা দখলের ব্যাপার। আছে ব্যক্তিগত ব্যাপারও। যে ব্যক্তিগত ব্যাপার তথ্য হয়ে দাঁড়ায়, সেসব আর ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে না। এদেশের এক রেলমন্ত্রী ৬৭ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। বর্তমান রেলমন্ত্রীও (এখন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে) দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বর্তমান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের দ্বিতীয় বিয়েতে নাকি অভিনন্দন জানান সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। কিন্তু বিষয় অন্য, স্ত্রীর ভাইরা যদি বিনা টিকেটে ভ্রমণ করে এবং সাহসী কোনো চেকারের পাল্লায় পড়ে গোল বাধে তখনই?
ঘটনাটা এমন—গত ৫ মে ২০২২-এ বিনা টিকেটে ঈশ্বরদী থেকে ঢাকাগামী ট্রেনে ওঠেন তিন যাত্রী। তারা এসি কামরায় ভ্রমণ করছিলেন। ট্রেনের টিকেট পরীক্ষক শফিকুল ইসলাম তাদের জরিমানা করেন এবং জরিমানা ও টিকেটের টাকা আদায় করে তাদের সাধারণ কামরায় পাঠান। এই তিন যাত্রী তখন বারবার বলছিল তারা রেলমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোক। পরে জানা গেল তারা আসলেও মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোক আর এ কারণে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিলেন টিকেট পরীক্ষক শফিকুল ইসলাম। এরপর জানা গিয়েছিল মন্ত্রীর বয়ান যে তিনি এদের চেনেন না। পরে আরও ভালোভাবে জানা গেল যে ট্রেনে বিনা টিকেটে চড়া তিন যাত্রীর একজন, মো.ইমরুল কায়েস রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তারের নিকটাত্মীয়। ইমরুল কায়েসের মা ইয়াসমীন আক্তার ও শাম্মী আক্তার মামাতো-ফুফাতো বোন, যদিও এটা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠলে টিকেট পরীক্ষক শফিকুল ইসলাম আবারও চাকরিতে ফিরতে পেরেছেন!
তাহলে রেল এখন কে চালায়? মন্ত্রী নাকি মন্ত্রীর স্ত্রী? এটা নিয়ে কী পাবলিকের মাথাব্যথা আছে? এসব করে কি ট্রেন তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে?
শফিকুলের সৌভাগ্য, তার চাকরি যাবার খবরটা ভাইরাল হয়েছিল। এদেশে অনেক কিছুর জন্য এখন 'ভাইরাল' লাগে। তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান সাহেব পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন যখন এক চিত্রনায়ক ও নায়িকার সাথে তার অডিও ভাইরাল হয়েছিল। রেলমন্ত্রী এখনও স্ত্রী ও তার আত্মীয়স্বজনদের চিন উঠতে পারেননি।
পুনশ্চ: প্রথমেই লিখেছিলাম ট্রেনের ব্যাপারটাই গোলমোলে। ১৯৫৬ সালে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে এক রেল দুর্ঘটনায় ১১২ জন যাত্রী মারা গেলে রেলমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগপত্র পাঠান। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সেটা গ্রহণ করেননি। তিন মাস পর তামিলনাড়ুতে আরও একটা রেল দুর্ঘটনায় ১৪৪ জন যাত্রী মারা গেলে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পদত্যাগ করেন।
সুমন কবীরের গানে আছে—বেহুলা কখনো বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি। বাংলাদেশের রেলমন্ত্রীদের পদত্যাগের কোনো নজির নেই, এটাও কি বাংলাদেশের রীতি?
প্রত্যেক ট্রেনের সাথে তাই আত্মীয়স্বজন নামে একটা বগি জুড়ে দেয়া এখন সময়ের দাবি!
- আহসান কবির: রম্যলেখক