ক্রমাগত হত্যার দেশ
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে এবং 'স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি' চাওয়াটা বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের ব্যানার-পোস্টারের অক্ষর হয়েই থেকে গিয়েছে- এই সহজ সত্য স্বীকার না করলে মহাকালের ইতিহাসের কাছে অপরাধী হতে হবে৷ গতকাল, শনিবার রাত পৌনে এগারোটায় সীতাকুণ্ডের একটি রাসায়নিকের ডিপোতে আগুন লাগার ঘটনায় এই লেখাটি লেখার সময় পর্যন্ত ৪০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং প্রায় চার শতাধিক আহত মানুষ নগরের বিভিন্ন হাসপাতালে যমরাজের সাথে যুদ্ধের চেষ্টা করছেন। বিস্ফোরণের তীব্রতা ছিল স্মরণকালের ভয়াবহ। চট্টগ্রাম শহরের ছাত্রসহ সর্বস্তরের মানুষ নেমে এসেছেন সীতাকুন্ডের ডিপোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আহত-নিহত মানুষদের পাশে।
গতকাল রাত বারোটা বেজে আজকের তারিখ হয়ে যাওয়ার পর জানা গেলো নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের সংকট প্রবল আকার ধারণ করেছে৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের শিক্ষার্থীরা দুটি বাস বোঝাই করে রক্ত দিয়ে এসেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। সিভিল সার্জন মহোদয় শহরের সব চিকিৎসককে আহ্বান জানিয়েছিলেন যাতে তাঁরা জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালের দিকে চলে আসেন। বাংলাদেশ যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গত ৫০ বছর ধরে চলছে তাতে দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসকরা মূলত ঈশ্বরপ্রেরিত দূত, বিশেষত ইন্টার্ন তরুণতর ডাক্তাররা যাদের হৃদয়ে এখনো পুষ্পগন্ধ অবশিষ্ট আছে, শুধুই মাংসগন্ধে ভরাট হয়নি৷ একাধিক ফার্মেসি, চিকিৎসক ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রয়োজনীয় ঔষধ ইঞ্জেকশন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মানুষের পাশে। এমনকি শহরের হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকার অনেক সিএনজি চালক বিনা পয়সায় আহত যাত্রী পরিবহন করছেন। কোনো সামষ্টিক দুর্যোগে বাঙালির ঐক্যবদ্ধতা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ, আমরা জানি।
মুশকিল হচ্ছে, ফায়ার সার্ভিসের যে সদস্যরা বিস্ফোরণে স্রেফ উবে গেলেন তাঁরা জানতেন না সেখানে রাসায়নিক ছিল। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড জলের স্পর্শ পেয়ে অধিক অক্সিজেন উৎপাদন করায় আগুনের পরিধি বেড়েছে। এই লেখাটি প্রস্তুত করা পর্যন্ত, ডিপোর মালিকপক্ষ জানান নাই সেখানে ঠিক কি কি রাসায়নিক ছিল? ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের যেহেতু জানানো হয়নি, সেহেতু আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি এটি অবহেলাজনিত কিংবা ইচ্ছেকৃত হত্যাকাণ্ড।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঘটনা তো এই প্রথম নয়। প্রতি বছর হয় কোনো কারখানায় শ্রমিক পুড়ে মরবেন, হয় কোনো কারখানা ধসে পড়বে, লঞ্চ ডুবি হবে মধ্য সমুদ্রে, রাসায়নিক পদার্থের গুদামে আগুন লাগবে, লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকবে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে, যা ধনতন্ত্রের উত্তেজনায় নিত্যদিন আরও অমানবিক রাষ্ট্র হয়ে উঠছে।
সাধারণত শতাধিক লাশ নিশ্চিতের পরেই আমরা জানতে পারি কারখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক ছিল না, রাসায়নিক রাখা হয়েছিলো উন্মুক্ত পরিবেশে পর্যাপ্ত সংরক্ষণের নিয়মাবলী পালন ছাড়াই। জানা যাবে, যে লঞ্চ ডুবল তার লাইসেন্স ছিলো না। সুদূর অতীতের ইতিহাস উদ্ভূত প্রাচীন লঞ্চটি প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে এই দেশে জলে সাঁতার কাটে, অত্যন্ত পুরনো দালানে ঝুঁকিপূর্ণ দশায় শ্রমিকেরা কাজ করেন৷
মরে গেলো কোনো আমলে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পাওয়া যায়, আর কোনো আমলে যৎসামান্য টাকা। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় ডিপোর মালিক পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছেন৷ শবের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার আর না-শব আহতকে ৩০, বিন্দুজীবন আর সে বিন্দু নিভে যাওয়ার মধ্যবর্তী ফারাক মাত্র ২০ হাজার। এভাবে অত্যন্ত সাধারণ নাগরিক, যারা নাকটি কোনোমতে ভাসিয়ে পারাপারহীন অকূল সমুদ্রে কোনো মতে টিকে আছে্ তাঁদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন কারা যেন টুস করে চুবিয়ে দিচ্ছে বার বার৷
তদন্ত কমিটি হয় প্রতিবার, সেই রিপোর্ট মানুষের চোখে আসে না। সেই যে কৃষ্ণবর্ণের চব্বিশে এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়লো, নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আজো অজানা। সেই হত্যাকাণ্ড নিয়েও আমরা চিন্তিত ছিলাম, ক্রন্দনরত ছিলাম, তারপর সব শুনশান, শ্মশানের ক্রন্দনপরবর্তী নিরবতা যেন। এমন একেকটি ঘটনায় পরিবার তছনছ হয়ে যায়, শরণার্থী হয়ে যায়, রাষ্ট্রের কর্তাদের অপরিকল্পনায় মানুষ শব্দের অন্তর্গত মনুষ্যত্ব উবে যায়৷ যিনি মাত্র কালকেই যোগ দিলেন চাকরিতে, পরিবারের অভাব ঘোচাবেন বলে, তিনি মরে গেলেন৷ পুলিশের একজন সাহসী কর্মীকে দেখলাম ছিন্ন পা নিয়ে বসে থাকতে। দেখলাম প্রকাশ্য দিনের আলোয় একটা কাটা হাত। শুনলাম একজন বাবাকে তাঁর ছেলে শেষবার ফোন করে বলছেন পা উড়ে যাওয়ার কথা, বলছেন বাবাকে ক্ষমা করে দিতে, কলেমা পড়িয়ে শোনাতে। বাবা তারপর ছেলের স্বর শোনেননি৷ প্রার্থনার সেই স্বরসহ ছেলেটি লুপ্ত হয়ে গেছে।
নানা অপরিকল্পনায় যে মুন্ডুগুলো কাটা পড়ছে, তারা যদি কথা বলে ওঠে একসাথে আরব্যরজনীর উজ্জ্বল পুনর্জাগরণময় পৃষ্ঠার মতো? সামলানো যাবে সেই অভিঘাত?
আমি ভাবছি অন্য কথা, রাসায়নিকের ডিপো না হয়ে যদি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হতো? যদি হতো? এই লেখা লেখার সময় কি পেতাম?
৫ জুন, দুপুর দেড়টায় লেখা