‘পেট্রল নয়, বিনিয়োগকারীদের খাদ্যের দাম নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত’
জ্বালানি তেল ও খনিজের মূল্য নাটকীয় হারে বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা। এতে করে তারা খাদ্যপণ্যের দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতির প্রভাবকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে না দেখার মতো বিপজ্জনক ভুল করছেন। বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে এমন মন্তব্য করেছেন আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র) বিখ্যাত বিনিয়োগ সংস্থা- ব্ল্যাকরক- এর প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি ফিঙ্ক।
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে ল্যারি বলেছেন, 'খাদ্য (সরবরাহ ও দাম) নিয়ে আমাদের মধ্যে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে না। এটা শুধু মূল্যস্ফীতির বিষয় নয়। এ থেকে ভূরাজনৈতিক (অস্থিতিশীলতার) যে পরিণতি সৃষ্টি হতে পারে তাও বিবেচনায় রাখার মতো'।
ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। ফলে চলতি বছর সব ধরনের জ্বালানিসহ পেট্রোলিয়াম-জাত পণ্যের দাম বেড়েছে- যেগুলি কৃষিকাজে ব্যবহার হতো। ডিজেলের মূল্য বাড়ায় আর সব পণ্যের মতো খাদ্য পরিবহনের খরচও বেড়েছে।
তা ছাড়া, ইউক্রেন একটি প্রধান উৎপাদক দেশ হওয়ায়–চরম আঘাত এসেছে খাদ্যশস্য ও ভোজ্য তেলের দামে।
এদিকে জ্বালানি তেল আমদানির বাড়তি ব্যয়ের চাপে দিশেহারা অনেক উন্নয়নশীল দেশ। জ্বালানি সাশ্রয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সরকারি পর্যায়ে। এতে চাহিদা কমার অনুমান থেকে চলতি সপ্তাহে কমতে শুরু করেছে জ্বালানি তেলের দাম। সে তুলনায় কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমছে না, বরং শীর্ষ অবস্থানেই রয়েছে।
দুনিয়ার শীর্ষ অর্থনীতি আমেরিকার ভোক্তারাও বাড়তি দামের শিকার। জুন মাসের মার্কিন ভোক্তামূল্য সূচকে মুরগি ও আটার দাম বার্ষিক হিসাবে ২০ শতাংশ বেশি ছিল।
এনিয়ে ল্যারি ফিঙ্ক বলেছেন, 'গ্যাসোলিনের দাম নিয়েই আমরা বেশি কথা বলি, কারণ তাতে আমেরিকান ভোক্তারা বেশি প্রভাবিত হন। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খাদ্য। ইউক্রেনে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি যুদ্ধের কারণে ধবংস হয়েছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে সারের দাম প্রায় ১০০ শতাংশ বেড়েছে, অতিরিক্ত এ মূল্যের কারণে কৃষিতে সারের ব্যবহার কম হচ্ছে। ফলস্বরূপ; বৈশ্বিক ফসল উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'
জ্বালানির মূল্য কিছুটা কমায় মার্কিন গাড়িচালকরা পাম্প পর্যায়ে কম দামে কেনার সুযোগ পেতে শুরু করেছেন। সে তুলনায় ভোগ্যপণ্য উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে উচ্চ উৎপাদন খরচের ভার বহন করেই চলতে হচ্ছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে। খরচ না কমার আরেক কারণ সারের দাম বেশি থাকা। কৃষকের উৎপাদন খরচ একারণে বেশি হওয়ায় ভোক্তা পর্যায়েও স্বস্তির ছাপ মিলছে না। উচ্চ খরচ ও কম বিক্রিবাট্টার চাপে রয়েছে কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারক কোম্পানিগুলো।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বব্যাংক এক পূর্বাভাসে বলেছিল, চলতি বছর খাদ্যের বৈশ্বিক দাম ২০ শতাংশ বা শিল্পের কাঁচামালের চেয়েও শক্তিশালীভাবে বাড়বে।
এর অভিঘাত সবচেয়ে মারাত্মক আফ্রিকায়। মহাদেশটি সার্বিকভাবে ইউক্রেন থেকে শস্য আমদানি ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। আফ্রিকায় এখন সারের দাম ৩০০ শতাংশ বাড়তি। পুরো মহাদেশে ২০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যের ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
ঘাটতি পূরণে কৃষকদের অর্থ সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে উন্নয়ন সহযোগীটি, যার আওতায় দেওয়া হবে ১৫০ কোটি ডলার। তারপরও চলতি বছর মোট ফসল উৎপাদন ২০ শতাংশ কম হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
গত শুক্রবার মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেন, 'খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে পৃথিবী এক চরম প্রতিকূল সময়ের সম্মুখীন'। এসময় তিনি জি-২০ দেশগুলির প্রতি অতিরিক্ত খাদ্য মজুদ বন্ধ রাখতে এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা না দেওয়ার আহ্বান জানান। যেসব দেশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে তাদেরকে অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা দানের আহ্বানও জানান জ্যানেট।
একই উদ্বেগের কথা এ সপ্তাহে বলেছেন, মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও আমেরিকার অন্যতম দানবীর বিল গেটস। গেটস বলেন- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গম, ভোজ্যতেল এবং অন্যান্য খাদ্যের সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যের বৈশ্বিক মূল্যকে শক্তিশালী করছে, এতে স্বল্প-আয়ের দেশগুলিতে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বাড়বে, তৈরি হবে (সামাজিক ও রাজনৈতিক) অস্থিতিশীলতা'।
এক ব্লগপোস্টে তিনি লিখেছেন যে, এ অবস্থায় আফ্রিকায় স্থানীয় কৃষি উৎপাদন বাড়াতে 'আরও অনেক বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন'।
- সূত্র: দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস