জ্বালানি তেলের বিশ্ব বাজার কেন উন্মাদ দশায়
মাত্র দুই বছর আগে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল (ক্রুড অয়েল) প্রতিব্যারেল ১৯ ডলারের মতো অতি-সস্তা দরে বিকিয়েছে। এসময় যারা আমেরিকান মিশ্র ক্রুড ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট কিনেছিলেন–তারা পান বিনামূল্যে। অথচ, দুই বছর পর বিশ্ববাজারে ক্রুড ১৩৯ ডলারের মতো শীর্ষ দরে পৌঁছেছে।
২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর তেলের দরে এত বড় হেলদোল আর দেখা যায়নি। ওই সময়ে বিশ্বমন্দার আতঙ্কে চাহিদায় ধস নামলে প্রতিব্যারেল ১৫০ ডলার থেকে ৪০ ডলারের নিচে নামে ক্রুডের দাম।
এবার বিশ্বের প্রধান জ্বালানি পণ্যটির দামে অস্থিতিশীলতা ঘটছে একাধিক কারণে: কোভিড-১৯ মহামারি; জ্বালানি উৎস পরিবর্তনের চেষ্টা; তেল উত্তোলনের নতুন প্রকল্পে প্রয়োজনের চেয়ে কম বিনিয়োগ; ওপেকের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সর্বোপরি রাশিয়ার আকষ্মিক সব সিদ্ধান্ত–যার কারণে বাজার অনুমান করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
ফলস্বরূপ; যানবাহন মালিকদের বাড়তি অর্থ গুনতে হচ্ছে পেট্রোল পাম্পে, আরও চড়া হয়েছে মূল্যস্ফীতির পারদ; নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনকে সামনে রেখে এনিয়ে আমেরিকায় (যুক্তরাষ্ট্রে) চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপের পালা।
মহামারিকালে তেলের মূল্য নিয়ে যুদ্ধ
২০২০ সালের শুরুতে মহামারি তখন বিশ্বের দেশে দেশে প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করছিল, সংক্রমণ এড়াতে লকডাউন দিতে থাকে একের পর এক দেশ। বিশ্ব অর্থনীতির চাকা প্রায় থমকে দাঁড়ায় এসময়। মানুষের অবাধ ভ্রমণ ও কারখানায় উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এ বাস্তবতায় তেল উৎপাদক দেশগুলির খনি থেকে উত্তোলন কমানোয় হতো সঙ্গত পদক্ষেপ।
রাশিয়া সে পথে না গিয়ে উল্টো বাজারে সরবরাহ বাড়ায়, এতে বাজার দরে নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি হয়। আসলে আমেরিকান শেল অয়েল উৎপাদকদের ক্রুড উত্তোলন খরচ অনেকটা বেশি, মস্কো চেয়েছিল বিশ্ববাজারে তেলের দর পতনের মাধ্যমে আমেরিকান উৎপাদকদের দেউলিয়া করতে। এক্ষেত্রে কিছুটা সফলও হয় ক্রেমলিন, আমেরিকান তেল কোম্পানিগুলোকে তখন প্রতিব্যারেল তেল লোকসান দিয়েই বিক্রি করতে হয়।
এদিকে রাশিয়ার কৌশলে প্রমাদ গোনে সৌদি আরব। বাজার অংশীদারিত্ব ধরে রাখতে তখন যুদ্ধে নামে রিয়াদ। আর উত্তোলন বাড়িয়ে আক্ষরিক অর্থেই বাজারকে তেলের প্রাচুর্যে ভাসায়। এমনকি দৈনিক উত্তোলন বাড়িয়ে ১ কোটি ২০ লাখ ব্যারেলে উন্নীত করে, একইসঙ্গে মূল্য কমায় ব্যারেলে ৮ ডলার করে।
সৌদির এই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য এর চেয়ে বাজে সময় আর ছিল না। রিয়াদ যখন বাজারে সরবরাহের জোয়ার সৃষ্টি করে, তখনই বিশ্বব্যাপী শুরু হয় লকডাউন, ধস নামে চাহিদায়।
এর পরে এক পর্যায়ে সৌদি আরবকে উৎপাদন কমিয়ে তেলের বৈশ্বিক মূল্য স্থিতিশীল হতে দিতে রাজি করায় আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন। রিয়াদের সম্মতির পর মে মাসে দৈনিক উৎপাদন ৯৭ লাখ ব্যারেল কমাতে ঐক্যমত্য হয় ওপেক জোটে, যা ছিল ওই সময়ে তাদের মোট দৈনিক উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশের কিছুটা কম।
কিন্তু, এই কর্তন কার্যকর হওয়ার আগেই বিশ্বের জ্বালানি মজুদের ট্যাংকগুলি ভরে উঠেছিল আগের চালানে। এমনকী আমেরিকার ওকলাহোমার কাশিং এর মতো সুবিশাল মজুদাগারে তেল রাখার কোনো জায়গা ছিল না। ফলে এপ্রিলের শেষ নাগাদ আমেরিকায় প্রথমবারের মতো ঋণাত্মক হয়ে তেলের মূল্য, বিশাল মজুদ থেকে নিষ্কৃতি পেতে এ সময় তেল ব্যবসায়ীরা উল্টো ক্রেতাকেই অর্থ দিয়েছেন।
প্রচলিত জ্বালানি থেকে সরে দাঁড়ানোর জটিলতা:
শুধু ভূরাজনীতিই তেলের বাজারকে তলিয়ে দেয়নি। মহামারিতে চাহিদার যখন পড়তি দশা তার মধ্যেই বাড়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কোম্পানিগুলোর প্রতি দূষণমুক্ত, সবুজ জ্বালানিতে নির্ভরতা তৈরির চাপ। এসময় লোকসানের চোটে ৩০ হাজার কোটি ডলারের নিজস্ব সম্পদ বিক্রি করতে হয় মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে। বিনিয়োগকারীরাও বেগতিক দেখে তাদের হাতে থাকা বৃহৎ তেল কোম্পানিগুলোর শেয়ার বিক্রি করে দেন। এতে খাতটিতে বিনিয়োগের যে কমতি তৈরি হয় তা বৈশ্বিক রূপ নেয় অচিরেই।
গত জুনে নিজস্ব তেল সম্পদ বেচে কয়েক শ' কোটি ডলার শোধ করে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের মতো জ্বালানি খাতের জায়ান্ট। এসময় বিপি জানায়, তারা নতুন তেল ও গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়ে ভাববে এবং প্রয়োজন অনুসারে প্রকল্পের সংখ্যাও কমাবে। প্রচলিত জ্বালানির ব্যবসা থেকে সরে আসার অংশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলেও উল্লেখ করে। আরেক জায়ান্ট শেল-ও এসময় পরিবেশ-বান্ধব ব্যবসার প্রতিশ্রুতি দেয়।
তেল শিল্পের বৃহৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ কমানো শুরু করেছে। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে উঠছে বিশ্ব।
জাতীয় তেল কোম্পানিগুলি যথেষ্ট উৎপাদন করতে পারবে?
২০২০ সালের শেষদিকে বড় অর্থনীতিগুলোয় লকডাউন উঠিয়ে নেওয়া শুরু হয়। এসময় তেল উৎপাদক ১৩ দেশের জোট ওপেকসহ অন্য আরও ১০টি উৎপাদকদের জোট ওপেক প্লাস, যার মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে–সামান্য পরিমাণে উৎপাদন বৃদ্ধি করে। করোনাভাইরাস আবারো বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে তেলের বাজারে ধস নামাতে পারে–এই যুক্তিই দেয় তারা।
তবে এই জোটের সদস্য কয়েকটি দেশ, যেমন নাইজেরিয়া ও এঙ্গোলার তেলক্ষেত্রের অবকাঠামো পুরোনো হয়ে পড়ায় তারা নিজেদের জন্য বরাদ্দ উৎপাদনের কোটাও পূরণ করতে পারেনি।
রাশিয়া যুদ্ধ শুরু করলো
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর সিদ্ধান্ত নিলে দর চড়তে থাকে জ্বালানি তেলের। রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা থাকায় প্রথমদিকে ইউরোপের দেশগুলি মস্কোর ওপর তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিতে দ্বিধা করছিল। তবে মে মাসে ইইউ সদস্যরা সমুদ্রপথে রাশিয়ার তেল রপ্তানির ওপর চলতি বছরের শেষ নাগাদ নিষেধাজ্ঞা দিতে ঐক্যমত্যে পৌঁছায়।
ইউরোপীয় ব্লকটি রাশিয়া ছাড়া অন্য উৎসগুলি থেকে জ্বালানি ক্রয়, দূষণমুক্ত বিকল্প জ্বালানিতে রুপান্তর–ইত্যাদি বাবদ ১৯ হাজার ৫০০ কোটি ইউরো ব্যয়ের প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করে।
অস্থিতিশীল ভবিষ্যৎ
উন্নত দেশের দূষণমুক্ত জ্বালানিতে সরে যাওয়ার চেষ্টা এবং ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আগামীতেও তেল বাজারের ওপর কালোছায়া হয়ে থাকবে।
এক্সনমোবিল- এর প্রধান নির্বাহী ড্যারেন উডস তেল ও গ্যাস খাতে আরও বিনিয়োগের অনুমান করছেন। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, অনিশ্চিত এ সময়ে বড় বিনিয়োগে যেতে বেশ কষ্টই হচ্ছে (বেসরকারি) কোম্পানিগুলোর।
tতবে শেলের প্রধান নির্বাহী বেন ভ্যান বিউরডেন বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পর বাধ্য হয়েই সরকারগুলি বৈশ্বিক জ্বালানি শিল্পের নানান সমস্যার সমাধানে কোমর বেঁধে নেমেছে। তাই তিনি নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের আগের সিদ্ধান্তগুলি বাতিল করবেন না'।
- সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস