গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে যাচ্ছে, বিপুল সম্পদের খোঁজে বিনিয়োগ করছেন বিলিয়নিয়াররা
জলবায়ু সংকটে পৃথিবীবাসীর দুর্ভোগের অন্ত নেই। দিনে দিনে যার প্রকোপ বাড়ছে দেশে দেশে। বাংলাদেশও জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির কাতারে উপরের দিকেই রয়েছে। কিন্তু, কথায় আছে– 'কারো বা পৌষ মাস, কারো বা সর্বনাশ'। এই সংকট যেন পৌষ মাস হয়েই এসেছে দুনিয়ার শীর্ষ ধনীদের বরাতে। তারা আরও সম্পদশালী হওয়ারই সুযোগ পাচ্ছেন।
জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সবুজ জ্বালানি ও নবায়নযোগ্য উৎসের শক্তি উৎপাদনে। বৈদ্যুতিক গাড়ি ও তার ব্যাটারি উৎপাদনেরও জোর প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বব্যাপী। কিন্তু, এসব সমাধানকে কাজে লাগাতে চাই মূল্যবান কিছু দুর্লভ খনিজ (রেয়ার আর্থ মেটারিয়াল) , যার বিপুল মজুদ রয়েছে উত্তর মেরু বলয়ের গ্রিনল্যান্ডে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ নজিরবিহীন মাত্রায় গলতে শুরু করায় গ্রিনল্যান্ডে এসব সম্পদের অনুসন্ধান করা হয়ে পড়েছে আরও সহজ। আর তাই জেফ বেজোস, মাইকেল ব্লুমবার্গ, বিল গেটসসহ আরও অন্যান্য ধনকুবের এমন অভিযানে বিনিয়োগ করছেন।
প্রাকৃতিক খনিজের এই তালাশকে 'গুপ্তধনের অনুসন্ধান' বলেই শিরোনাম করেছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন।
গণমাধ্যমটির সূত্রে জানা যাচ্ছে, গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের ডিস্কো দ্বীপ এবং নুসুয়াক উপদ্বীপের পাহাড় ও উপত্যকায় যে পরিমাণ দুর্লভ খনিজের মজুদ রয়েছে- তা দিয়ে শত শত কোটি বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি তৈরি করা যাবে।
পৃথিবীর প্রত্যন্ততম এই এলাকায় বিলিয়নিয়ারদের নিয়োগকৃত অনুসন্ধানীরা হেলিকপ্টার, ট্রান্সমিটারসহ অত্যাধুনিক সব যন্ত্র নিয়ে অনুসন্ধানে ব্যস্ত রয়েছেন।
খনিজ অনুসন্ধানী এমন একটি স্টার্টআপ কোম্পানি ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক কোবল্ড মেটালস।
কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কুর্ট হাউস বলেন, 'এখানে যার সন্ধান আমরা করছি, তা বিশ্বের প্রথম বা দ্বিতীয় বৃহত্তম নিকেল ও কোবাল্টের মজুদ হতে পারে'।
পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বরফের চাদর প্রতিনিয়ত হারাচ্ছে উত্তর মেরু অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তনের 'গ্রাউন্ড জিরো'ই আজ আর্কটিক। তবে একইসাথে অঞ্চলটি এই সংকট মোকাবিলায় দরকারি খনিজ সংগ্রহের উৎস হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।
কোবল্ড মেটালস কোম্পানির প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেন যে, মার্কিন ধনকুবেররা তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন। এবিষয়ে মাইকেল ব্লুমবার্গ ও বিল গেটসের মন্তব্য জানতে তাদের সাথে যোগাযোগও করে সিএনএন। কিন্তু, তারা এতে সাড়া দেননি।
গ্রিনল্যান্ডে বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং এর ব্যাটারি উৎপাদনের খনিজ অনুসন্ধানে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান ব্লুজে মাইনিং এর সাথে অংশীদারিত্ব স্থাপন করেছে কোবল্ড। অবশ্য শুধু যানবাহনই নয়, নবায়নযোগ্য শক্তি সংরক্ষণের আধার বিশাল সব ব্যাটারি বানাতেও দরকার এসব খনিজের।
মাটির বুকে সঞ্চিত এই ধনরাশি অনুসন্ধানে কোবল্ড ও ব্লুজে যৌথভাবে অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছে এমন একটি ক্যাম্প সাইটে গিয়ে সিএনএন প্রতিবেদক– ভূতত্ত্ববিদ, ভূপদার্থবিদ, বাবুর্চি, পাইলট ও মেকানিকসহ নানান পেশার ৩০ জন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান। এতে বোঝা যায়, এই কর্মযজ্ঞ কতোটা গুরুত্বের সাথে চলছে। বিশ্বের প্রথম গণমাধ্যম হিসেবে ওই সাইটের কর্মকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ ধারণের সুযোগ পেয়েছে সিএনএন।
সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অনুসন্ধানী টিমের সদস্যরা মাটির নমুনা সংগ্রহ করছেন। ভূপৃষ্ঠের তড়িৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্র জরিপে ড্রোন ও হেলিকপ্টার ওড়াচ্ছেন ট্রান্সমিটারসহ। এর মাধ্যমে তারা মাটির নিচের শিলাস্তরের বিন্যাস সম্পর্কেও তথ্য পাচ্ছেন। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে আবার উন্নত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সফটওয়্যারের সাহায্যে। বিশ্লেষণের মাধ্যমে আগামী গ্রীষ্মে ঠিক কোন স্থানে খনন করলে বেশি সাফল্য আসবে সে সম্পর্কে জানা যাবে।
ব্লুজে মাইনিং- এর প্রধান নির্বাহী বো মলার স্টেনসগার্ড সিএনএন'কে বলেন, 'গ্রিনল্যান্ডে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও তার পরিণতি প্রত্যক্ষ করাটা আমার জন্য সব সময়ই ছিল গভীর উদ্বেগের বিষয়। একে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে এটাও সত্যি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এখানে খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলন আরও সহজ হয়ে উঠেছে'।
তিনি আরও জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগর দীর্ঘসময় বরফমুক্ত থাকছে, এতে করে রসদ ও ভারি সরঞ্জাম নিয়ে তার টিমের জাহাজও সহজে চলাচল করতে পারছে। আবার উৎপাদন শুরু হলে জাহাজে করেই সহজে বিশ্ববাজারে রপ্তানি করা যাবে এসব ধাতুর খনিজ।
সাগরের বরফের সাথে সাথে গলছে শত শত বছর ধরে গ্রিনল্যান্ডের স্থলভাগকে ঢেকে রাখা বরফের আচ্ছাদন। এতে ভূমি হয়ে পড়ছে উন্মুক্ত এবং তাতে করে খনিজ অনুসন্ধানের সুযোগ বেড়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্কটিক রিসার্চ কমিশনের চেয়ারপার্সন মাইক ফ্রাগা বলেন, 'বরফ গলার ঘটনা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। ফলে গ্রিনল্যান্ডের প্রত্যন্ত স্থলভাগে যাতায়াত আরও সুগম হবে এবং তাতে সম্ভাব্য খনি উন্নয়নের কাজে গতি আসবে'।
গ্রিনল্যান্ড ও ডেনমার্কের ভূতাত্ত্বিক জরিপ অনুসারে, গ্রিনল্যান্ডে কয়লা, কপার, স্বর্ণ, জিঙ্কসহ দুর্লভ খনিজ বা রেয়ার আর্থ মেটারিয়ালের বিপুল মজুদ আবিষ্কারের সম্ভাবনা রয়েছে।
গ্রিনল্যান্ডের সরকার বরফমুক্ত ভূমিতে সম্পদ আবিষ্কারের বেশকিছু গবেষণার তথ্য পর্যালোচনা করেছে। এর ভিত্তিতে সরকার মনে করছে, খনিজ সম্পদ উত্তোলনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যকরণের সুযোগ রয়েছে দেশটির সামনে।
মাইক ফ্রাগা জানান, দেশটি খনিজ সম্পদ উত্তোলনে আগ্রহী হলেও, তারা পরিবেশ সুরক্ষাকে বিবেচনায় রেখেছে। কারণ পরিবেশের সচেতনতা– গ্রিনল্যান্ডের সংস্কৃতি ও অধিকাংশ মানুষের জীবিকার সাথে জড়িত।
তিনি বলেন, 'গ্রিনল্যান্ড সরকার দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে টেকসই, দায়িত্বশীল এবং অর্থনৈতিকভাবে উপযোগী পরিকল্পনাকে সমর্থন করে'।
ব্লুজে মাইনিং এর স্টেনসগার্ড উল্লেখ করেন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিশাল চ্যালেঞ্জ নিয়ে হাজির হয়েছে। এই সংকট সমাধানের একটি অংশ হবে অতি-গুরুত্বপূর্ণ এসব খনিজের ব্যবহার।
তবে উত্তর মেরু নিয়ে গবেষণাকারী বিজ্ঞানীদের কাছে প্রধান উদ্বেগ গ্রিনল্যান্ডের বরফের আচ্ছাদন হারিয়ে যাওয়া। এতে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, তাতে করে তলিয়ে যেতে শুরুও করেছে বিশ্বের অনেক উপকূলীয় জনপদ আর দ্বীপমালা।
বরফ ও হিমবাহ নিয়ে গবেষণাকারী নাসার একজন বিজ্ঞানী হলেন নাথান কুর্টজ। তিনি বলেছেন, 'গত কয়েক দশক ধরে উত্তর মেরু অঞ্চলে বরফের আচ্ছাদন অদৃশ্য হচ্ছে–কিন্তু, সবচেয়ে বড় শঙ্কার কথা আগামী ২০-৩০ বছরের মধ্যে এটি পুরোপুরি অদৃশ্য হওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে'।
- সূত্র: সিএনএন