আদানির এনডিটিভি কেনার প্রস্তাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার শঙ্কায় ভারতের সাংবাদিকরা
ভারতের অন্যান্য গণমাধ্যম যখন একে একে কট্টর জাতীয়তাবাদ ধারণ করেছে, তখন মুক্তধারার গণমাধ্যম হিসেবে বছরের পর বছর ধরেই সরকারের সমালোচনায় সরব ভারতীয় টেলিভিশন সংস্থা এনডিটিভি (এনডিটিভি.এনএস)।
কিন্তু ব্যবসায়ী টাইকুন গৌতম আদানি এনডিটিভি কিনে নিচ্ছেন এমন খবর প্রকাশের পরেই ভারতের শেষ কয়েকটি স্বাধীনধারার গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন দেশটির সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজ।
ভারত ও এশিয়ার শীর্ষ ধনী আদানির নিলামে অংশ নেওয়া ঠেকাতে চাইছে খোদ গণমাধ্যমটিই। তারা নিলামে আদানি অংশ নেওয়ার নীতিগত বাধার কথা উল্লেখ করে বিষয়টি সম্পূর্ণ 'অপ্রত্যাশিত' বলেও মন্তব্য করেছে।
মুক্তবাজারে প্রবেশের সঙ্গে ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এনডিটিভি ভারতের স্বাধীনধারার গণমাধ্যমগুলোর অন্যতম পথিকৃৎ। দেশটির সাংবাদিকরা আদানির এই 'খেলা' নিয়ে রীতিমতো উদ্বিগ্ন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনডিটিভির এক সিনিয়র সাংবাদিক রয়টার্সকে বলেন, 'আমরা সবাই খুব হতাশ'।
'আমাদের সম্পাদকীয় লেখার যে স্বাধীনতা আছে তা খর্ব হবে। আর এটাই প্রধান উদ্বেগের বিষয়,' বলেন তিনি।
এনডিটিভি ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় নিউজ ওয়েবসাইট ছাড়াও হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার বেশ কয়েকটি চ্যানেল পরিচালনা করে।
এদিকে আদানি গ্রুপ এক বিবৃতিতে জানায়, 'এনডিটিভি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ডিজিটাল ও সম্প্রচার মাধ্যম'।
তবে অধিগ্রহণের সঙ্গে চ্যানেলের স্বকীয়তার সাথে আপস করা হবে কি না এ প্রসঙ্গে আদানি গ্রুপের মুখপাত্রকে জিজ্ঞাসা করা হলেও কিছু জানা যায়নি।
কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল তখনও গণমাধ্যমটি তাদের সমালোচনা করত। অন্যদিকে মোদি ও তার জাতীয়তাবাদের ব্র্যান্ডধারী রাজনীতির সমালোচনাতেও আগে থেকেই সরব এনডিটিভি।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদি গণমাধ্যমটিকে সাধারণের নাগালের বাইরে থাকা অভিজাতদের অংশ হিসেবে মন্তব্য করেন। মোদি আসার পর ভারতও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার র্যাংকিং-এ নিচের দিকে নামতে থাকে।
ভারতের শিল্প পরিবারগুলো সরকারের সঙ্গে আপস করলে তাদের অধীনে থাকা গণমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতাও খর্ব হয় বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস।
প্রণয় রায় ও রাধিকা রায় দম্পত্তির মালিকানাধীন এনডিটিভি ইতোপূর্বে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগে মোদি সমর্থকদের সমালোচনার মুখে পড়ে।
গৌতম আদানি এর আগে জানিয়েছিলেন যে তিনি মোদির ঘনিষ্ঠ নন। কিন্তু বাস্তবতা হলো মোদির রাজনৈতিক ভাগ্যের সঙ্গে একই সময়ে আদানির অর্থভাগ্যও খুলেছে। ফোর্বসের শীর্ষ ধনীর তালিকায় এসেছে তার নাম। এমনকি উভয়েই গুজরাটের বাসিন্দা। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে নরেন্দ্র মোদির আদানির ব্যক্তিগত জেট ব্যবহারের নজির আছে। এর বাইরে দুজনের ঘনিষ্ঠতার তেমন চাক্ষুষ প্রমাণ মিলে না।
মোদির সঙ্গে সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, মিডিয়া পর্যবেক্ষকরা বলছেন করপোরেট টাইটানদের হাতে একে একে ভারতের মিডিয়া চলে যাওয়া দেশটির সাংবাদিকতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ভারতের আরেক ধনকুবের মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ ভারতের অন্যতম বৃহত্তম মিডিয়া হাউজ নেটওয়ার্ক১৮ নিয়ন্ত্রণ করে।
'মিডিয়া মালিকানা হলো করপোরেটদের জন্য তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের একটি মাধ্যম,' বলেন ভারতের গুটিকয়েক স্বাধীন প্রকাশনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ক্যারাভান ম্যাগাজিনের রাজনীতি বিষয়ক সম্পাদক হরতোষ সিং।
'এসব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। তারা শুধু সরকারের বক্তব্যই প্রচার করে না, বরং সরকারকে চ্যালেঞ্জ করে বা ভিন্ন কোনো বক্তব্য প্রচার করে এমন সবই এড়িয়ে যায়। আমি দেখতে পাচ্ছি এনডিটিভির ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটতে চলেছে,' বলেন তিনি।
ভারতের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যখন সমালোচনা তুঙ্গে তখনই আদানি গ্রুপের থেকে এনডিটিভি কেনার প্রস্তাবটি আসে।
চলতি বছর রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারত সর্বকালের সর্বনিম্ন ১৫০ তম অবস্থানে নেমে এসেছে।
গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে সরকারের ভূমিকার বিষয়টি অস্বীকার করে উল্টো র্যাংকিং-এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভারত। একইসঙ্গে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় দেশটি সচেষ্ট বলেও দাবি করে বিজেপি সরকার।
- সূত্র: রয়টার্স